Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ফল-ফসলের ব্যাপক ক্ষতি

উত্তরাঞ্চলে বাড়ছে মরুকরণ নিচে নেমে গেছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্তিত্ব সঙ্কটে জীববৈচিত্র্য

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে দেশের আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এতে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। খরতাপে পুড়ছে দেশ। বৃষ্টির অভাবে ফল-ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বেড়ে গেছে নানা রোগের সংক্রমণ। দেশের উত্তারঞ্চেলে আম-লিচুর ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এতেকরে সেচের অভাবে নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতের ফসল।

ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহিত না হওয়ায় নদীগুলো শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ছে এবং তারই প্রভাবে মরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলার ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিপর্যস্ত হচ্ছে। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার প্রভাবে জীববৈচিত্র্য অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ছে। বনভূমি বিরান হয়ে দেশের উত্তরাঞ্চল দ্রুত মরুভ‚মিতে পরিণত হচ্ছে।
দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল নামে খ্যাত নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়ায় মরুময়তার লক্ষণ অন্য সব এলাকার তুলনায় বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ একটা সময়ে এতদঞ্চলের আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। সেই সুষম আবহাওয়া এখন আর বিরাজ করছে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ড. আব্দুল মতিন বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে মরুকরণ অনেকটা ত্বরান্বিত হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মকালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং শীতে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা অনভূত হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলে। গত শীত মৌসুমে তাপমাত্রা প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি চলে গিয়েছে, আর গত গ্রীষ্মে ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করেছে। চলতি মৌসুমেও ওই এলাকায় ইতোমধ্যে ৪০ ডিগ্রী তাপমাত্রা বিরাজ করছে। কোনো এলাকা মরুকরণের জন্য বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাই যথেষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত ‘সোনোরান’ মরুভ‚মির কথা। এটি উত্তর আমেরিকার শুষ্ক ও উষ্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। তিনি বলেন, মরুকরণ প্রক্রিয়ারোধে সরকারের প্রকৃতপক্ষে কোনো উদ্যোগ নেই।

খরার কারণে রাজশাহীর আম বাগানগুলোতে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। এ অবস্থায় দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। ঝরে পড়া ঠেকাতে আম বাগানে নিয়মিত সেচ ও কীটনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন ফল গবেষকরা।
রাজশাহী জেলার প্রতিটি বাগানে ঝুলছে হরেক রকম আম। তবে গত পাঁচ মাস ধরে এই অঞ্চলে তেমন বৃষ্টিপাত নেই। খরার কারণে আমের বোঁটা নরম হয়ে যাচ্ছে। এতে বাগানগুলোতে পরিপক্ব হওয়ার আগেই ঝরে পড়ছে আমের গুটি।

বাগান মালিকরা জানান, গাছে মুকুল আসার সময় বৃষ্টি হয়নি। এখনো খরা অব্যাহত আছে। পানির অভাবে আমের গুটি পরিপক্ক হওয়ার আগেই ঝরে পড়ছে। গাছের গোড়ায় পানি দিয়েও তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া নানা রকম রোগ বালাইও বেড়ে গেছে। গাছে ওষুধ দিয়ে আম টিকানোর চেষ্টা করছেন বলেও জানান তারা। এ অবস্থায় আমের আশানুরূপ উৎপাদন নিয়ে চিন্তিত বাগান মালিকরা।
দেশের অন্যতম আম উৎপাদনকারি জেলা নওগাঁয় চলতি মৌসুমের প্রায় ৬ মাস ধরে অনাবৃষ্টির কারণে তীব্র খরায় গাছ থেকে অনবরত ঝড়ে পড়ছে আমের গুটি। জেলার বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর, পত্মীতলায় আমে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণের পাশাপাশি মরিচা রোগ দেখা দেয়ায় আমের শরীরে মরিচাসহ আম ফেটে যাচ্ছে। এই রোগাক্রান্ত বেশিরভাগ আম কালো রং ধারণ করছে। এ সব আমে কীটনাশক, প্রতিষেধক ব্যবহার করেও কোনো সুফল মিলছে না বলে অভিযোগ আম চাষিদের।

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। আবহাওয়ার পরিবর্তন, প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব ও ব্যাপক হারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় এ অঞ্চলে অবিশ্বাস্য হারে নামছে পানির স্তর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রেকর্ড পরিমাণে ১৫০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় এরই মধ্যে অকেজো হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ হস্তচালিত নলকূপ। গভীর নলকুপগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না। এর ফলে বৈশাখের এই তীব্র খরতাপে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। পানির স্তর নিচে নামতে থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে গবেষণা সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন। ডাসকো’র কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এক যুগ আগেও এসব অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে কোথাও কোথাও ১৫০ ফুট বা তারও নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভ‚গর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও এ অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ। বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু এলাকাগুলোতে পানির সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর, রাজশাহীর তনোর ও গোদাগাড়ী, এবং নওগাঁর পোরশা, সাপাহার এবং নিয়ামতপুর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে ৪৭ মিটার উঁচু। বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে উঁচু গোমস্তাপুরের পার্বতীপুর ইউনিয়ন। এসব এলাকায় এখন পানির জন্য হাহাকার চলছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশে সেচের জন্য যে পানি ব্যবহার হয় তার ৭৫ শতাংশই মাটির নিচ থেকে তোলা। এক কেজি বোরো ধান উৎপাদন করতে প্রায় তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। গম ও ভুট্টায় প্রতি কেজি উৎপাদনে প্রায় ৪০০-৬০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এক বিঘা বোরো ধান চাষে প্রয়োজন হচ্ছে ২৪ লাখ লিটার পানি। বার্ষিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭১০ মিলিয়ন ঘনলিটার। অথচ বৃষ্টিপাতে তা পূরণ হচ্ছে মাত্র ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিয়ন ঘনলিটার। প্রতি বছরই ঘটতি হচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনলিটার।



 

Show all comments
  • Dadjack ২৬ এপ্রিল, ২০২১, ১:৩২ পিএম says : 0
    Because of our sins the climate have been changed and as such A'llah curse descended upon us. O'Muslim give up all sins and repent to Allah then Allah will save us from these calamities.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফল-ফসল

১৭ এপ্রিল, ২০২২
২৬ এপ্রিল, ২০২১
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ