Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

অধিকতর তদন্ত’ ধামাচাপা ৫ বছর

খাদ্যে নিয়োগ দুর্নীতি মামলা

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

বিচারের জন্য প্রস্তুত ছিল মামলাটি। ৮ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল হয়েছিল আগেই। তারিখ পড়েছে অভিযোগ গঠন শুনানির। এ পর্যায়ে আদালত থেকে একটি মামলা ফেরত আনে তৎকালিন কমিশন। ঘটনাটি ২০১৬ সনের। কিন্তু সেই ঘটনার পরিসমাপ্তি টেনে যাননি ২০২১ সালেও। কারণ, যে উদ্দেশে চার্জশিট দাখিল হওয়া মামলাটি আদালত থেকে ফেরত আনা হয় (রি-কল), সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। এ কারণে পুরো মেয়াদজুড়ে মামলাটি পড়ে রয় দুদকের কাছেই। তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, খাদ্য অধিদফতরে জালিয়াতির মাধ্যমে ৪৪ পরিদর্শক নিয়োগ, নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত: অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করে তৎকালিন কমিশন। ওই মামলার প্রধান আসামি নিয়োগ কমিটির সভাপতি এলাহী দাদ খান। তাকে বিচারের হাত থেকে বাঁচাতেই মামলাটি ‘অধিকতর তদন্ত’র কথা বলে আদালত থেকে ফেরত আনেন তৎকালিন চেয়ারম্যান। মামলাটি ফেরত আনার বিষয়ে কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। তার একক আগ্রহে এবং হুকুমে মামলাটি বিচারিক পর্যায় থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও মামলাটির প্রতিবেদন দাখিল হয়নি আদালতে।

সূত্রমতে, খাদ্যে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলাটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত একটি মামলা। এ কারণে মামলাটি তদন্ত পর্যায়ে একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। কযেক হাত হয়ে মামলাটি আসে তৎকালিন উপ-পরিচালক হামিদুল হাসানের হাতে। তিনি ২০১৬ সালের ১০ মার্চ মামলাটির চার্জশিট (নং-৩৭) দেন। ওই বছর ১৩ মার্চ দুদক কার্যালয়ে চেয়ারম্যান হয়ে আসেন অবসরপ্রাপ্ত এক সিনিয়র সচিব। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি নির্দেশ দিলেন আদালত থেকে মামলাটি ফেরত আনার। যেমনি হুকুম তেমনি তামিল। বড় কর্তার ‘প্রিয়পাত্র’ হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে সংস্থার কোনো কর্মকর্তাই তখন চার্জশিট দাখিলের পর মামলা ফেরত আনার আইনগত ভালো-মন্দ দিকটি অবহিত করেননি। সদ্য যোগদানকারী তৎকালিন দুদক চেয়ারম্যান শুধু নির্দেশ দিলেন, খাদ্য অধিদফতরে ৪৪ কর্মকর্তা নিয়োগের দুর্নীতি মামলার ১ নম্বর আসামি ‘প্রিয়জন’ এলাহী দাদ খানকে বাদ দিয়ে নতুন করে চার্জশিট দিতে। তার এই হুকুমে অনেক সিনিয়র কর্মকর্তারা নীরব হয়ে গেলেন। এটি কী করে সম্ভব? প্রধান আসামিকে বাদ দেয়া! সরাসরি ‘না’ বলতে পারলেন না কেউ। লিগ্যাল সেকশন থেকে সিরিপিসি, দন্ডবিধি ইত্যাদি সামনে মেলে ধরা হলো। বলা হলো, আইন অনুযায়ী চার্জশিট দাখিলের পর মামলার ‘পুনঃতদন্ত’ হয় না। তবে কমিশন চাইলে ‘অধিকতর তদন্ত’ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে চার্জশিটভুক্ত কোনো আসামিকে বাদ দেয়া যায় না। বরং অধিকতর তদন্তে আগত নতুন আসামি যুক্ত করা সম্ভব। কিছুতেই প্রবোধ মানলেন না সেই চেয়ারম্যান। তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করলেন। কেটে গেল এক বছর। এ কর্মকর্তাও নতুন কোনো ফল বের করতে পারলেন না। বদলে ফেলা হলো তাকেও। এভাবে বদল করলেন ৫ তদন্ত কর্মকর্তা। এলাহী দাদ খানকে আইনত : বাদ দেয়া সম্ভব হয়নি কোনো কর্মকর্তার পক্ষেই। আর এ কারণে তিনি খাদ্যের সেই আলোচিত নিয়োগ দুর্নীতি মামলার কোনো প্রতিবেদনই আর আদালতে দাখিল করলেন না। ধামাচাপা দিয়ে রাখলেন টানা ৫টি বছর। এ অবস্থায় গত ১০ মার্চ চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন সাবেক এই আমলা। টাইম মেশিনে চেপে যদি ২০১৬ সনের এই দিনটিতে ফেরত যাওয়া যেতো, তাহলে দেখা যেতো, দুদক চেয়ারম্যানের আদেশ অগ্রাহ্য করার এমন একটি অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ডিপি, কিংবা বদলি। তার ধমকে কর্মকর্তাদের হতো ত্রাহিদশা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে খাদ্যে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ৫ বছর ধামাচাপা দিয়ে রাখলেও কাউকে একটি শোকজও করা হয়নি। ‘ক্লিনম্যান, সৎ, স্বচ্ছ এবং আপসহীন’ দুদক সম্প্রতি বিদায় নেয়া চেয়ারম্যানের এখানে কেবল বৈপরীত্যই প্রতীয়মান হয়।

কি ছিল খাদ্যে জনবল নিয়োগের সেই দুর্নীতি মামলায়? এজাহারের বর্ণনা মতে, খাদ্য অধিদফতরের তৃতীয় শ্রেণীর ১০টি ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৫৫২টি শূন্যপদ পূরণের জন্য ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় খাদ্য অধিদফতর। প্রার্থীদের আবেদনপত্র তালিকাভুক্ত করাসহ ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত যাবতীয় কাজের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্টসের (ডিপিসি) সঙ্গে অধিদপ্তরের চুক্তি হয়।

মামলার তদন্তে দেখা যায়, অধিদফতরের বিভাগীয় বাছাই কমিটির ৫ জন সদস্য ও ডিপিসির ৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধভাবে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরির সুযোগ করে দিয়েছেন। পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশে কম্পিউটার সফটওয়্যার পরিবর্তন করে মেধাবীদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের ফলাফলে অধিক নম্বর প্রাপ্তি দেখিয়ে ৪৪ জনকে চাকরি দেয়া হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা প্রতীয়মান হওয়ায় ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর সংস্থার তৎকালিন উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল হক বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন।

এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, ‘খাদ্য পরিদর্শক’ পদে চাকরি লাভকারীরা হলেন, শরীয়তপুরের মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কোম্পানীগঞ্জের মো. জহিরুল ইসলাম, সিলেট সদর উপজেলার অপূর্ব কুমার রায়, সাভারের আবু জাকির মোহাম্মদ রিজওয়ানুর রহমান, ফরিদপুরের বোয়ালমারীর আসমা রহমান, মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের আসমা ইসলাম, সিলেটের বিয়ানীবাজারের জাহানারা জলি, শেরপুরের নয়াবিল টিপিসির অলিউর রহমান, জামালপুর সদরের সানজিদা সুলতানা, কিশোরগঞ্জের সরারচর এলএসডির উম্মে হানী, সিলেটের বিশ্বনাথের মোহাম্মদ মোহাইমিনুল ইসলাম ভূঞা, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের প্রতাপ কুমার সরকার, পাবনার চাটমোহরের কোহিনুর আক্তার, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার মির আরিফুর রহমান, নেত্রকোনার কলমাকান্দার মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব, ময়মনসিংহের গয়েশপুরের মো. সাজ্জাদ হোসেন খান পাঠান, নেত্রকোনো সদরের হিমেন চন্দ্র সরকার, ঢাকা সিএসডির মোহাম্মদ রইছ উদ্দিন, শেরপুর সদরের সালমা আক্তার, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ এলএসডির শামছুন নাহার, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের ইয়াসির আরাফাত, টাঙ্গাইলের নাগরপুরের মো. এদিব মাহমুদ, পটুয়াখালীর গলাচিপার হালিমা আহমেদ, ঝালকাঠি সদরের রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, কুমিল্লার বরুড়ার মোহাম্মদ তেয়ব উল্যাহ খান, নওগাঁর ধামুইরহাটের শেখ মো. জাকারিয়া হাসান, বদলগাছীর মো. নূরুজ্জামান, পোরশার মো. আতিকুর রহমান, বগুড়ার শিবগঞ্জের মমতাজ বেগম, জামালগঞ্জ এলএসডির কানিজ শারমিন, পাবনার আটঘরিয়ার মো. জুনায়েদ কবীর, মানিকগঞ্জের সিংগাইরের সেলিনা আক্তার, সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের মোহাম্মদ আলী মিঞা, রংপুরের মিঠাপুকুরের রানীপুকুর টিপিসির জাকিয়া সুলতানা, কুড়িগ্রামের রাজারহাটের অনিমেষ কুমার সরকার, নীলফামারীর জলঢাকার জেসমিন আক্তার, সৈয়দপুরের মো. রায়হান কবির, রংপুর সদর পীরগঞ্জের মিঠাপুকুর টিপিসির মো. শরিফুল ইসলাম, সাতক্ষীরার দেবহাটার বিল্লাল হোসেন, বাগেরহাটের মংলার মো. আবুল হাশেম, পটুয়াখালীর কাঠালতলীর ইসরাত জাহান মান, বরগুনার আরিফা সুলতানা, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আশীষ কুমার রায় ও চাকরিতে যোগ না দেয়া মো. আবুল কাসেম। জালিয়াতির ‘সুফলভোগী’ হিসেবে মামলায় এই ৪৪ জনসহ মোট ৫৩ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগ ছিলো, এ নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা করে ঘুষ নেয়া হয়। নিয়োগ-বাণিজ্য করে নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তারা অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, জালিয়াতির মাধ্যমে দেয়া এই নিয়োগের মূল হোতা খাদ্য অধিদফতরের তৎকালিক পরিচালক (প্রশাসন) ও বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সভাপতি এলাহী দাদ খান। নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্তরা হলেন, খাদ্য ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপ-সচিব (পরবর্তীতে যুগ্ম সচিব) নাসিমা বেগম, সরকারি কর্মকমিশনের তৎকালিন উপ-পরিচালক ও উপ-সচিব মাহবুবুর রহমান ফারুকী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালিন উপ-সচিব ইফতেখার আহমেদ ও তৎকালিন সিনিয়র সহকারী সচিব রোকেয়া খাতুন, ডিপিসির তৎকালিন ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আইউব আলী, তৎকালিন সিস্টেম অ্যানালিস্ট আসাদুর রহমান, হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আরিফ হোসেন ও অ্যাসিসট্যান্ট ডাটাবেজ অ্যাডমিন আবুল কাসেম। তাদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে প্রার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্তু তৎকালিন কমিশন শুধু নিয়োগ প্রক্রিয়ার জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এলাহী দাদ খানকে ১ নম্বর আসামি করে ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। জালিয়াতির সুফলভোগী হিসেবে ৪৪ জনকে চার্জশিট থেকে বাদ দেয়।

দুদকের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, চার্জশিট দাখিল হয়ে যাওয়ার আইন অনুযায়ী কোনো মামলার পুনঃতদন্ত হতে পারে না। তবে ‘অধিকতর তদন্ত’র লক্ষ্যে আদালতে আবেদন দিয়ে মামলা ফেরত আনা যায়। সে ক্ষেত্রে অধিকতর তদন্তে আগত নতুন আসামিদের নাম চার্জশিটে যুক্ত হতে পারে। এ মামলাটির ক্ষেত্রে এজাহারে বর্ণিত ৪৪ সুফলভোগীকে অন্তর্ভুক্ত করে আবারও চার্জশিট দেয়া যেতো। কিন্তু প্রধান আসামি এলাহী দাদ খানের নাম বাদ দেয়ার আইনগত কোনো সুযোগই নেই। আদালতে এটি গ্রহণযোগ্যও হতো না।

দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, চার্জশিট দাখিল হয়ে যাওয়া মামলাটি অধিকতর তদন্তের কথা বলে আদালত থেকে ফেরত আনা হয়েছিল দুদকের বিগত চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত আগ্রহে। এ মামলার পুনঃতদন্ত কিংবা অধিকতর তদন্তের বিষয়ে কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। ওই চেয়ারম্যানের প্রিয়পাত্র এলাহী দাদ খানকে অব্যাহতি দেয়ার জন্যই চার্জশিট ‘রি-কল’ করা হয়। আইনত: তাকে অব্যাহতি প্রদান সম্ভব হয়নি বলেই বৃহৎ এই নিয়োগ দুর্নীতির মামলাটির বিচার এখনও আটকে আছে। মামলার কোনো প্রতিবেদনই আদালতে জমা পড়েনি।
সূত্রটি জানায়, সম্প্রতি বিদায় নেয়া দুদক চেয়ারম্যান অসদুদ্দেশে মামলাটি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এ ধরনের অভিযোগে বিগত চেয়ারম্যান বহু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করেছেন। ১৯৪৭ সনের ২নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় চার্জশিটও দিয়েছে। আইনজ্ঞরা মনে করেন, এ মামলায় চার্জশিট প্রদানে বিলম্বের বিষয়টি শক্তিশালী একটি টিমকে দিয়ে তদন্ত করানো উচিৎ। কারণ, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এ প্রেসিডেন্ট ব্যতিত কাউকেই ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) দেয়া হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতি মামলা

২৭ জুন, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ