Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজস্ব ঘাটতি ৫১ হাজার কোটি টাকা

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতিতে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। লক্ষ্যমাত্রা যদি অর্জন করতে হয়, তাহলে বাকি তিন মাসে রাজস্ব আদায় করতে হবে আরও এক লাখ ৫৩ হাজার ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। যা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।

চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকে অবাস্তব বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, কর আদায়ে উচ্চবিলাসী লক্ষ্যমাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাবসহ নানা কারণে চলতি বছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব না। একই সঙ্গে করোনাভাইরাস না হলেও স্বাভাবিক সময়েও এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব ছিলো না। তথ্যমতে, দেশের রাজস্ব খাতের ৮৬ শতাংশ আহরণ করে এনবিআর। মূলত আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস এই তিন খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়।

সূত্র মতে, চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত দুই লাখ ২৭ হাজার ৭৬৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৮০৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ঘাটতি ৫০ হাজার ৯৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ১১৭ কোটি ৭ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায়ে সঙ্কটে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের। সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা মহামারিসৃষ্ট কঠোর বিধিনিষেধ। এ অবস্থান থেকে যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়, তাহলে বাকি তিন মাসে রাজস্ব আদায় করতে হবে আরও এক লাখ ৫৩ হাজার ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। যা প্রায় অসম্ভব।

গত অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হলেও করোনা প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট প্রতিক‚ল পরিবেশে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সামনের তিন মাসে আরও এক লাখ ৫৩ হাজার ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা আদায় করতে হবে এনবিআরের। এনবিআর থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে সাময়িক হিসাবে মোট এক লাখ ৭৬ হাজার ৮০৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির তিন বিভাগে। এর মধ্যে মার্চ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে ভ্যাট খাত থেকে। এ খাতে আদায় হয়েছে ৬৭ হাজার চার কোটি ৭৪ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

শতাংশ হিসাবে সাফল্য দেখিয়েছে আমদানি ও রফতানি শুল্ক খাত। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশের বেশি রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আদায় হয়েছে ৫৩ হাজার ৯৯৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে, মার্চ পর্যন্ত আয়কর খাতে ৫৫ হাজার ৮০৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে আদায় হয় ৫২ হাজার ৮৪৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৫৯, ৮ দশমিক ৯৬ ও ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে আমদানি-রফতানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। আমদানি-রফতানির স্থবিরতায় কমেছে রাজস্ব আদায়। রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া ডিজিটাল না হওয়ায় অনেকেই করমুখী হচ্ছে না। কর আদায়ে অটোমেশন প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা।

যদিও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম করোনাকালীন আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক বলে প্রাক-বাজেট উপলক্ষে বিভিন্ন আলোচনায় দাবি করে এসেছেন। একই সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের গতি বাড়াতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের এক হাজারের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানো, অটোমেশন এবং আইন পরিবর্তনসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে স¤প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ট্যুরিজম ও পরিবহন খাতসহ অনেক খাতে স্থবিরতা সত্তে¡ও আমরা ভালো করছি। ভ্যাটের ক্ষেত্র বৃদ্ধিতে দরকার অটোমেশন। এনবিআরে অটোমেশন প্রক্রিয়া চলমান আছে। কর প্রদান ও ভ্যাট প্রদান সহজীকরণে কাজ করে যাচ্ছে এনবিআর। যদিও সবকিছু এলামেলো করে দিয়েছে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব এবং চলমান লকডাউন

এ বিষয়ে এনবিআরের তিন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, মার্চ মাসে যতটুকু আদায় হয়েছে, সামনে রাজস্বের প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাবে। রোজার ঈদ উপলক্ষে অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতি আসে। রাজস্ব আদায়েও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। লকডাউনে সবকিছু আরও পিছিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এ মুহ‚র্তে এনবিআরের বাড়তি কোনো ঊদ্যোগ নেয়ারও সুযোগ নেই।

এদিকে, লকডাউনের আগে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ হাজার কোটি টাকা কমানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছে। যা চ‚ড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে এক লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এরপর আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা এবং আমদানি শুল্ক থেকে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়।

চলতি বছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকে অযৌক্তিক দাবি করে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, বিগত অর্থবছরে যা আদায় করতে পেরেছি তার ওপর একটা সার্টেইন পার্সেন্টেজ বৃদ্ধি করে টার্গেট সেইভাবে বানানো উচিত। এই টার্গেটটা ঠিক করবে এনবিআর। সেটা তারা সরকারকে দেবে, সরকার সেই অনুযায়ী বাজেট বানাবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। করোনা ও অর্থনীতির দুর্দশা বিবেচনায় না নিয়ে এনবিআরের ওপর অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই এমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব না। এটা যেহেতু অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে করা হয়নি সেহেতু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বাস্তব অর্জনের বিরাট একটা পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। করোনা যদি না যায়, অর্থনীতি যদি সচল না হয় তাহলে কর আদায়ে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না। এমনকি এ বছর যদি করোনা না থাকতো তাহলেও এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হতো না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ