Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুঃস্বপ্নের বাড়ি ফেরা

প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৮ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা : স্থবির ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক : ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ৬৫ কি:মি: যানজট : ট্রেনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই : পদে পদে সীমাহীন ভোগান্তি

নূরুল ইসলাম : কল্যাণপুর শ্যামলী বাস কাউন্টারে সপরিবারে সকাল থেকে বাসের অপেক্ষায় বসে আছেন একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা নাজমুল আহসান। সকাল সাত টার বাস ধরার জন্য সেই ভোর সাড়ে তিনটার দিকে ঘুম থেকে জেগেছেন। ছেলেমেয়েরাও অনেক দিন পর দাদা বাড়ি যাওয়ার আনন্দে আত্মহারা ছিল। বিকাল ৫টা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। তখনও ফেরেনি সকাল সাড়ে ৬টার গাড়ি। কখন ফিরবে কেউ জানে না। নাজমুল আক্ষেপ করে বলেন, প্রচ- গরমে ছেলেমেয়েরা অসুস্থ হওয়ার পথে। দুপুরে ওদেরকে হোটেল থেকে খাবার কিনে খাইয়েছি। ঈদে স্বপ্নের বাড়ি ফেরা আমাদের কাছে এখন দুঃস্বপ্নই মনে হচ্ছে। আল্লাহই জানেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে আদৌ বাড়িতে পৌঁছতে পারবো কি না। ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে সারাদিন ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছি। কিন্তু সেটারও একটা সীমা আছে। আর কিছুক্ষণ দেখবো। না হলে আর উপায় নেই, ফিরে যেতে হবে। নাজমুলের মতো হাজার হাজার যাত্রী রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বাসের অপেক্ষায় গতকাল সারাদিনই অপেক্ষায় কাটিয়েছেন। যারা রওনা করতে পেরেছেন তাদের দিন কেটেছে রাস্তায়। দেশের প্রায় সবগুলো মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটে আটকা পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। যাত্রাপথে এসব মানুষের ভোগান্তি অতীতের সকল রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রশাসনও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, যানজট নিরসনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মহাসড়কের যানজটপ্রবণ স্পটগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, এবার ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা পুরোপুরি স্বস্তিদায়ক করতে পারব এমন আশ্বাস দিচ্ছি না। তবে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। পুলিশ বলছে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘটে ফেরি পারাপার বন্ধ থাকার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের বাসগুলো টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা হয়ে প্রবেশ করায় এবং অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। গতকাল রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ৬৫ কিলোমিটার যানজট ছিল। অন্যদিকে, যানবহানের চাপে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে থাকছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও এবার যানজট ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। সব মিলে ভুক্তভোগিদের কাছে এবারে স্বপ্নের ঈদযাত্রা দুঃস্বপ্নের মতোই। নদীপথে ভ্রমণের জন্য সদরঘাটেও ছিল যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। আর ট্রেনে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। তবে গতকাল পর্যন্ত ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের কোনো খবর পাওয়া যায় নি।
ভুক্তভোগিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও চট্টগ্রামমুখী ঘরমুখো যাত্রীদের এবার বেশি বোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ফেরি পারাপারে সমস্যার কারণে দুই পারে গতকাল দিনভর যানবাহনের দীর্ঘ সারি ছিল। উত্তরাঞ্চলগামী যানবাহনগুলো ঢাকা থেকে বেরিয়ে গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে যানজটে পড়ে। তবে রাতের দিকে থেমে থেমে যানবাহন চলছে। ঢাকামুখী বাসগুলোকে দীর্ঘ জটে পড়ার পর ঢাকায় ঢুকতে অতিরিক্ত ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা লেগেছে। এতে একই বাসে যারা ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চল যাবেন তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর ও মেঘনা ও গোমতী সেতুর মুখ থেকে পেছনের দিকে ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে হাজার হাজার গাড়ি আকটা পড়ে। এতে করে এই দুই সেতু পার হতেই সময় লেগেছে তিন থেকে চার ঘণ্টা। আবার ঢাকা থেকে বের হতে সময় লেগেছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। সব মিলে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে যেখানে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগার কথা সেখানে ৬/৭ ঘণ্টা লেগেছে।
গাবতলীতে বাসের জন্য অপেক্ষা
গতকাল সকালে গাবতলী টার্মিনালে বাস ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও অনেকে দেখা পাননি কাঙ্ক্ষিত গাড়ির। কখন আসবে ঈদের অগ্রিম টিকেটের সেই গাড়ি- তাও বলতে পারছিলেন না কাউন্টারের লোকজন। সকালে গাবতলী টার্মিনালে উত্তরবঙ্গগামী বাস কাউন্টারগুলোর সামনে যাত্রীদের ব্যাপক ভিড় দেখা যায়। যাদের অনেকে ভোর থেকে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। এনজিওকর্মী মাহফুজ ঈদ করতে যাবেন গ্রামের বাড়ি নাটোরে। তিনি বলেন, আমার গাড়ি ছিল সাড়ে ৭টায়। সাড়ে ১২টা সময়ও বাস আসে নাই। কখন আসবে- তাও কেউ বলতে পারছে না। ঈদে গাইবান্ধা যেতে এস এ পরিবহনের অগ্রিম টিকেট কেনা মতিউর রহমানও একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, প্রতিবারেই এমন অবস্থা হয়। কিন্তু এবার যেটা হচ্ছে সেটা অস্বাভাবিক। চার ঘণ্টা ধরে বসে আছি। গাড়ি এখনও আষে নি। কখন আসবে তাও কেউ বলতে পারছে না।
জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রুটের কেয়া পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার মফিদুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই এই সমস্যা হচ্ছে। মূল কারণ হচ্ছে পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি চলছে না ঠিকমত। তাই খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরার বাসগুলো সব এলেঙ্গা দিয়ে ঢুকছে। এ কারণ এলেঙ্গা থেকেই জ্যাম শুরু হয়েছে। মফিদুল জানান, তাদের একটি বাস বৃহস্পতিবার সকালে পঞ্চগড় থেকে রওনা হয়ে বিকালে এলেঙ্গা পৌঁছায়। সেখান থেকে ঢাকা এসেছে শুক্রবার সকাল ৭টায়। নওগাঁর শ্যামলী পরিবহনের বাস সকালে ছাড়ার কথা থাকলেও সারাদিনে তা ঢাকায় পৌঁছতে পারেনি। এমনিভাবে ভোরের এসআর পরিবহনের বাস গাবতলী থেকে ছেড়েছে বিকাল ৫টায়। সকাল ৮টার রোজিনা পরিবহনের বাস গাবতলী ছেড়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।
স্থবির ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
আমাদের স্থানীয় সংবাদদাতারা জানান, ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে অতিরিক্ত পণ্য, যাত্রী ও গরুবাহী যানবাহনের চাপ এবং এলোপাথাড়ি যানবাহন চলাচলের কারণে গতকাল টানা ৩য় দিনের মতো স্থবির হয়ে পড়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ। হাইওয়ে পুলিশের দাবি, মহাসড়কে যানজট স্থায়ী ছিল না। থেমে থেমে চলেছে যানবাহন। ভুক্তভোগিরা জানান, কাঁচপুর ব্রিজ থেকে শুরু করে মহাসড়কের সানারপাড়, মুগদাপাড়া, ভবের চর, গজারিয়া, মেঘনা ও দাউদকান্দি গোমতী সেতুর উভয় প্রান্তে যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে নাকাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ঢাকা থেকে কুমিল্লায় যাতায়াতের ২ ঘণ্টার সময়ের পরিবর্তে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগছে বলে যাত্রী ও পরিবহন চালকরা জানিয়েছেন। তাদের মতে, গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে যানজট আরও প্রকট আকার ধারণ করে। কাঁচপুর, মেঘনা ও দাউদকান্দি গোমতী সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের চাপ বেড়ে যাওয়ায় হাইওয়ে পুলিশ চাপ সামলাতে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে।
তিল ধারণের ঠাঁই নেই ট্রেনে
এদিকে, রাজধানী থেকে রেলপথে বাড়ি ফেরার চিত্রও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গতকাল সকাল থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ঘরমুখো মানুষের ঢল দেখা গেছে। প্রতিটি ট্রেনেই গাদাগাদি করে ফিরছে মানুষ। বগিতে ছাড়াও ট্রেনের ছাদে গাদাগাদি করে উঠেছে যাত্রীরা। যদিও ছাদে না ওঠার জন্য কমলাপুরে রেলওয়ে পুলিশকে মাইকিং করতে দেখা গেছে। কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী জানান, গতকাল পর্যন্ত ট্রেনের কোনো সিডিউল বিপর্যয় ঘটেনি। প্রায় সবগুলেঅ ট্রেনই মোটামুটি সময় মেনেই চলছে।
সদরঘাটে যাত্রীদের ঢল
অন্যদিকে নৌপথে বাড়ি ফেরার জন্য রাজধানীর সদরঘাটেও গতকাল যাত্রীদের ঢল দেখা গেছে। দুপুরের পর থেকে পুরান ঢাকার সদরঘাটে হাজার হাজার যাত্রীর ঢল নামে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে ৯০টি লঞ্চ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। তিনি জানান, এবার নৌপথে যাত্রীদের চাপ গতবারের তুলনায় ানেক বেশিই মনে হচ্ছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুঃস্বপ্নের বাড়ি ফেরা

১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ