পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে। খোশ আমদেদ মাহে রমজান। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেই বছর ঘুরে এলো মাহে রমজান। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে শুরু হলো ১৪৪২ হিজরির পবিত্র রমজান মাস। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণরেখা হতে উষার শুভ্ররেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। অতঃপর নিশাগমন পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)।
রমজান হলো সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য সাওমের মাস। ‘সাওম’ অর্থ বিরত থাকা; এর বহুবচন হলো ‘সিয়াম’। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলায় সাওমকে বলা হয় ‘রোজা’। ইসলামি পরিভাষায় সাওম (রোজা) হলো ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইবাদতের উদ্দেশ্যে পানাহার থেকে বিরত থাকা।
দেশের আকাশে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হিজরি রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে। তাই মুসলমানদের সিয়াম সাধনার (রোজা) মাস শুরু হচ্ছে আজ ১৪ এপ্রিল বুধবার থেকে। আগামী ৯ মে রোববার দিবাগত রাতে পবিত্র লাইলাতুল কদর পালিত হবে। গতকাল রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভাপতি ও ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান। শাবান মাস এবার ২৯ দিনেই শেষ হলো। রমজান মাস শেষে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে।
জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশের সব জেলা প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, আবহাওয়া অধিদফতর, মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের আকাশে হিজরি ১৪৪২ সনের রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে।
এশার নামাজের পর গতকাল মঙ্গলবার রাতেই ২০ রাকাত তারাবি নামাজ পড়েন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। রোজা রাখতে শেষ রাতে সেহরি খান। রোজার প্রথম দিন ঢাকায় সেহরির শেষ সময় ছিল রাত ৪টা ১৫ মিনিট। আজ বুধবার প্রথম রোজার ইফতারের সময় ৬টা ২৩ মিনিট।
এদিকে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে গতকাল মঙ্গলবার থেকে রমজান শুরু হয়েছে। পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বৈশ্বিক মহামারি করোনার এই সময়ে পবিত্র রমজান মাসে যথাযথ স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি মেনে ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণীতে দেশের সকল নাগরিকের প্রতি জীবনের সর্বস্তরে পরিমিতিবোধ, ধৈর্য্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আসুন, পবিত্র মাহে রমজানের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাবতীয় ভোগবিলাস, হিংসা-বিদ্বেষ, উচ্ছলতা ও সংঘাত পরিহার করি এবং জীবনের সর্বস্তরে পরিমিতিবোধ, ধৈর্য্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করি। এছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ইসলামী ধারার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে দেশবাসীকে ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি গরিব-দুঃখিদের সাহায্য সহায়তার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
পবিত্র রমজান মাস তামাম দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য ইবাদতের বিশেষ মৌসুম। এ মাসে জান্নাতের সব দরজা খুলে দেয়া হয়; যাতে মানব জাতি অভিশপ্ত শয়তানের কুমন্ত্রণার বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে মুক্ত অবস্থায় এবাদত বন্দেগি করতে পারেন। মু’মিন মুসলমানরা সিয়াম-সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে পরম কাক্সিক্ষত আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভ করতে পারেন। তাই রমজান মাসে মু’মিন মুসলমানদের ঘরে-ঘরে রোজা আদায়, কুরআন তেলাওয়াত, দান-খায়রাত ইত্যাদি নেক কাজ বেশি বেশি করে থাকেন।
ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, রমজান মাসে তারাবিহ’র নামাজ আদায় বিশেষ আমল। পুরুষদের তারাবিহ’র নামাজ মসজিদে জামাতে আদায় করা সুন্নাত। ওজরের (বাহানা) কারণে কারো মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হলে এবং জামাত করা না গেলে তখন ঘরে একা নামাজ আদায় করলেও পূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে। করোনাকালে অনুরূপ পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজও বিশেষ অবস্থায় একাকী আদায় করা যাবে। এতেও পরিপূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে গত বছরের মতো এবারও রমজান মাসে মসজিদে তারাবিতে মুসল্লির সংখ্যা বেঁধে দিয়েছে সরকার। গত সোমবার ধর্ম মন্ত্রণালয় এক নির্দেশনায় জানিয়েছে, যে কোনো মসজিদে তারাবিতে খতিব, ইমাম ও হাফেজসহ সর্বোচ্চ ২০ জন অংশ নিতে পারবেন। গত বছর করোনা মহামারির কারণে পবিত্র রমজানে মসজিদে জমায়েত সীমিত করে ইমাম-খতিবসহ ১২ জনের তারাবি নামাজ পড়ার নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল সরকার। গত কয়েক মাসে করোনা পরিস্থিতির উন্নতিতে এই বিধি-নিষেধ শিথিল হলেও সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় আজ ১৪ এপ্রিল বুধবাব থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ যাচ্ছে দেশ।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পবিত্র রমজান মাসে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রতি ওয়াক্তে সর্বোচ্চ ২০ জন মুসল্লি অংশগ্রহণ করবেন। তারাবির নামাজে খতিব, ইমাম, হাফেজ, মুয়াজ্জিন ও খাদিমসহ সর্বোচ্চ ২০ জন মুসল্লি অংশগ্রহণ করবেন। জুম্মার নামাজে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুসল্লিরা অংশ নেবেন।
রমজান মাসে প্রাপ্ত বয়স্ক (৭ বছরের বেশি বয়স) মুসলমানদের জন্য ফরজ হলো পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করা। রমজানের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুটি ওয়াজিব, যথাক্রমে সদকাতুল ফিতর প্রদান করা এবং ঈদের নামাজ আদায় করা। এছাড়াও রমজানের চাঁদ দেখা, সাহ্রি খাওয়া, তারাবির নামাজ আদায় করা, তাহাজ্জত নামাজ আদায় করা, ইফতার করা ও অন্য রোজাদারদের ইফতার করানো, পবিত্র কোরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করা এবং ইতিকাফ করা, রমজানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোয় শবে কদর সন্ধান করা এবং ঈদের জন্য শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা সওয়াবের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ পবিত্র কোরআন-এ বলেছেন, ‘রমজান মাসে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে, তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে।’ মহানবী রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতে রায়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন শুধু রোজাদারেরাই প্রবেশ করবেন। তাদের প্রবেশের পরে এই দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হবে। তারা ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি, খন্ড: ৩, হাদিস: ১,৭৭৫)।
রমজান মাসের চাঁদ দেখার আগ থেকেই কার্যত মুসলমানদের ঘরে ঘরে রোজার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। শেষ রাতে সেহ্রি খেয়ে রোজা রেখেছেন দেশের ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মানুষ। এই মাসে প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিবাভাগে পানাহারবঞ্চিত থেকে সংযমের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করে মহান আল্লাহ’র অনুগ্রহ কামনা করছেন তারা। রমজান মাস পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ায় রোজা রাখার পাশাপাশি বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত, দান-খয়রাতের মাধ্যমে বিগত জীবনের পাপতাপ মুক্তির জন্য দোয়াও করছেন। বরকতময় এই মাসে আল্লাহ রহমত ও ক্ষমা লাভের জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকেন।
রমজান মাস শুরু হতে না হতেই পাল্টে গেছে মুসলমান পরিবারগুলোর সদস্যদের প্রত্যাহিত জীবনধারা। যাপিত জীবন, কেনাকাটা সবকিছুতেই এসেছে পরিবর্তন। রমজান মাসে বেশি বেশি করে গরিব-দুঃখীদের দান খয়রাত করা হয়। রমজানপূর্ব সময়ে প্রত্যেক মুসলিম পরিবারে অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। যেমন রমজানে সাহরি-ইফতার, গরিব-দুঃখীদের সহযোগিতা করা, জাকাত আদায় ইত্যাদি শুরু হয়েছে। অন্য রোজাদারগণ যাতে কষ্ট না পান সে জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কেনা থেকে বিরত থেকে এসব জরুরি খাতে অর্থ ব্যয় করার প্রস্তুতি নেয়া উচিত। রমজানে বিশ্বের বহুদেশে পণ্যের মূল্য কমিয়ে দেয়া হয়। রোজাদারগণ যাতে রোজা রাখতে পারেন সে জন্য ব্যবসায়ীরা লাভ কম করে থাকেন। কিন্তু দেশের কিছু অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা শুধু চরম অন্যায়ই নয়, অমানবিকতাও বটে। এ ব্যাপারে সবার সচেতন হওয়া আবশ্যক। হজরত উমর (রা.) বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রাখে (কৃত্রিম উপায়ে খাদ্য গুদামজাত করে সংকট তৈরি করে) আল্লাহ তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৫)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।