পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখার পর ভারত ৬টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশকে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। ফেনি নদীর পানি ত্রিপুরায় নেয়ার সময় থেকে যৌথ নদী কমিশনে ৬ নদীর পানি নিয়ে আলোচনার ইস্যু মানুষ জানতে পারে। ভারতের সঙ্গে পানি ভাগাভাগির ৬ আলোচিত নদীর অন্যতম হলো কুড়িগ্রামের দুধকুমার। অথচ পানির অভাবে শুকিয়ে ঠনঠন দুধকুমার নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। নদী পাড়ের কৃষকরা এখন ছেলেমেয়েদের সবুজ ধান-গম-আলু-বাদামের ফসল দেখিয়ে বলে ‘ওই খানে দুধকুমার নামে একটি নদী ছিল’।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি হয়ে দাশিয়ার ছড়া (ভারতের সাবেক ছিটমহল) থেকে ফিরতে ভ‚রুঙ্গামারী উপজেলায় দুধকুমার নদী চোখে পড়ল। নদী তো নয়, যেন ধু-ধু বালুচর আর ফসলের মাঠ। পানিপ্রবাহ না থাকায় নদী শুকিয়ে গেছে; কোথাও কোথাও চর পড়েছে। অনেক যায়গায় স্থানীয় কৃষকরা নদীর বুকেই চাষাবাদ করছেন। দুধকুমারের পাড়ে দাঁড়িয়ে শহীদুল হক নামের স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক জানালেন, দুধকুমার নদী আর ফুলকুমার নদী এরা যেন দু’টি ভাই। পানির অভাবে দুটি নদীর অবস্থা করুণ। আপনি যতদুর যাবেন দেখবেন কোথাও পানি নেই; মানুষ হেঁটেই নদী পার হচ্ছেন। অথচ কয়েক মাস আগে বন্যার সময় পানিতে নদী টইটুম্বুর ছিল দুধকুমার। জেলেরা নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। এখন পানি না থাকায় কৃষক নদীর বুকে নানান ফসল ফলাচ্ছেন। নদীর বুকে ফসল এটা কী মানা যায়?
নদীপাড়ে সরেজমিন ঘোরার সময় দুধকুমারের আশপাশের মানুষজন জানালেন, দুধকুমার কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তের নদী। তিব্বতের মনকোশ নদী ভুটানের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে নাম ধারণ করে হরিডাক। কুড়িগ্রাম জেলার ভ‚রুঙ্গামারী উপজেলার সোনাইহাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নামধারণ করে দুধকুমার। পাটেশ্বরীর কাছে এ নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে গোদাধর, গঙ্গাধর নামক দু’টি উপনদী। এ দুটি নদীর প্রবাহ গ্রহণ করে দুধকুমার সর্পিল গতিতে ৫১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে নুনখাওয়া নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিশে গেছে। দুধকুমারের সাথে মিশে আছে আর একটি নদী নাম ফুলকুমার। এরা যেন দু’টি ভাই। দুধকুমার বড়। ফুল কুমার ছোট। বড় কুমার দুরন্ত, ছোট কুমার নম্র। আবহমানকাল থেকে দুধকুমারের দু’তীরে বাস করেন অসংখ্য মানুষ। তারা এক সময় নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন নদীতে চাষাবাদ করেন।
রংপুর বিভাগের গাইবান্ধায় পড়েছে ঘাঘট নদী। এটা তিস্তার একটি শাখা নদী। গাইবান্ধা শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ঘাঘট আগে খুব গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল। নদীর মাছ খুবই সুস্বাদু। এ নদীর উৎপত্তি নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ থানার কুজিপাড়া গ্রামে। অতঃপর রংপুরের গংগাচড়ার পশ্চিম সীমানা দিয়ে রংপুর সদর থানা অতিক্রম করে পীরগাছায় প্রবেশ করেছে। এরপর আলাইকুড়ি নদীকে সাথে নিয়ে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর হয়ে যমুনায় মিশেছে। গাইবান্ধা শহরের ৮ কিলোমিটার পূর্বদিকে মানাস নদী ঘাঘটের সাথে যুক্ত হয়েছে। ঘাঘট ধীরগতির নদী হিসেবে পরিচিত। পানির অভাবে উনবিংশ শতাব্দীতে নদীর মোহনা ভরাট হওয়ায় তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পানির অভাব আর দখল দুষণে ধীরে ধীরে সঙ্কীর্ণ হয়ে এটি এখন গাইবান্ধা শহরে ড্রেন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘাঘটের প্রধান স্রোত দক্ষিণ দিকে মানাসের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আলাই নদী হয়ে যমুনায় মিলেছে। জুলাই-আগস্ট মাসে পানির সর্বোচ্চ প্রবাহ থাকে। চিত্রে ক্ষীণধারায় বয়ে চলছে এ নদীটি।
রংপুরের হারাগাছে যখন তামাক চাষের চিত্র দেখতে যাই তখন চোখে পড়ে মানাস নদী। নদী তো নয় পানির অভাব আর স্থানীয়দের দখল দুষণে ছোট ড্রেনের মতো হয়ে গেছে। নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জে তিস্তার একটি শাখা নদী থেকে মানাসের উৎপত্তি। অতপর গংগাচড়া হয়ে কাউনিয়ার হারাগাছ বন্দরের পশ্চিম দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রবাহ পথে মীরবাগ রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বে বড় ব্রীজের নিচ দিয়ে পীরগাছা উপজেলায় প্রবেশ করে। পরে আলাইকুড়ি নদীতে মিশে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জের ভিতর দিয়ে ঘাঘট নদী হয়ে অবশেষে যমুনায় পড়েছে। ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী কার্যত পানি প্রবাহের অভাবে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলের আখিরা একটি ছোট নদী। এক সময় আখিরার তীরে নদীবন্দর ছিল। নৌকায় পণ্য আনানেয়া করা হতো। রংপুর জেলা পীরগঞ্জ উপজেলা ও দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষের সময় জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সরবরাহের জন্য এ নদী খনন করা হয়। পীরগঞ্জের বড়বিল (ধোপ) নামক খাল থেকে রংপুর সদর থানার সদ্যঃপুষ্করিণী এলাকার চৌদ্দভ‚ষণ বিল পর্যন্ত একটি খাল খনন করা হয়। এর পর বড় বিল থেকে আর একটি খাল খনন করে ঘোড়াঘাটের উত্তরে করতোয়ার সঙ্গে মিশে যায়। ঘোড়াঘাট বন্দর থেকে এ নদী দিয়ে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হতো। আকারে ও আকৃতিতে খালের মতো হলেও এ এলাকার মানুষের আকুতি তিস্তা চুক্তি করে পানিপ্রবাহ বাড়িয়ে নদীটিকে বাঁচানো হোক।
রংপুরের এক স্থানীয় সাংবাদিক নদী নিয়ে কাজ করেন। তিনি নিয়ে গেলেন মরা নদীর পাড়ে। সত্যিই নদী পানি প্রবাহের অভাবে মরে গেছে। স্থানীয়রা জানান, তিস্তায় পানি থাকলে এ নদী পানিতে টইটুম্বুর করে। রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার চৈত্রকোল গ্রাম থেকে উৎপত্তি হয়ে সর্পিল গতিতে এ নদী বয়ে গেছে আটিয়াবাড়ি গ্রামে। এরপর গন্ধরপুর, কোমরসই ও কাদিরাবাদের মাঝ দিয়ে প্রভাবিত হয়ে সোনাইল গ্রামের পশ্চিম দিয়ে মহারাজপুর ঘাটের কাছে করতোয়ার মিশেছে। বর্ষাকাল ছাড়া এ নদীতে পানি থাকে না। তাই মানুষ নাম দিয়েছে মরা নদী। এ নদীর তীরে কাদিরাবাদ মদনখালি স্থানে কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে। রংপুরের আরেকটি নদীর নাম টোপা। ঘাঘট নদী থেকে এ নদীর উৎপত্তি। এ নদীতে এক সময় পানসি নৌকা চলত। নদী তীরে গড়ে উঠেছিল বন্দর। রংপুর শহরের ক্যাডেট কলেজের কিছু দুরে রংপুর-বগুড়া সড়কের বড় ব্রীজের নিচ দিয়ে মাহিগঞ্জের দিকে চলে গেছে। বৃটিশ শাসনামলেও মাহিগঞ্জের পশ্চিমে এ নদীর তীরে বড় বন্দর গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে মাহিগঞ্জে নদীটি ভরাট হয়ে গেছে।
এ ছাড়াও রংপুরে এক সময় শ্রোতম্বিনী নদী ছিল ধাইজান, দেওনাই, চারালকাথা, যমুনেশ্বরী, আলাইকুমারী, কাতগাড়ী, স্বর্ণমতী, বুলাই, হংসরাজ বিল, বুড়াইল, বুড়িখোড়া-চিকলীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক। নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার দড়ি ভেজা বিলের স্রোত হতে ধাইজান নদীর উৎপত্তি। এটি জলঢাকা কিশোরগঞ্জ প্রবাহতি হয়ে কিশোরগঞ্জের যমুনেশ্বরীতে পড়েছে। আবার কিশোরগঞ্জের ধাইজান নদী রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার যমুনেশ্বরীতে মিলিত হয়েছে। আরেকটি নদীর নাম বুলাই। এ নদী নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার বড় ঘাট এর স্রোত থেকে উৎপত্তি। যমুনেশ্বরী নদীতে পতিত হওয়ার আগে এটি দক্ষিণ দিকে নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ, জলঢাকা এবং রংপুর জেলার বদরগঞ্জের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বুড়িখোড়া-চিকলী নদী নীলফামারী জেলার ডোমার থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে সোনারাই বিলের বুড়িখোড়া-চিকলীর উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থল থেকে আকাঁবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়ে রংপুর জেলার বদরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে দেওনাই-চারানকাটা নদীর সাথে মিলিত হয়ে যমুনেশ্বরী নদীতে পড়েছে। দেওনাই-চারালকাথা-যমুনেশ্বরী নদী নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তের দিয়ে প্রবাহিত স্রোত থেকে উৎপত্তি। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাঁটাখালী নদীর সাথে মিলিত হওয়ার আগে দক্ষিণ দিকে ডোমার, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ হয়ে তারাগঞ্জ উপজেলার কাছে রংপুর জেলায় প্রবেশ করে। রংপুর জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিঠাপুকুর উপজেলায় করতোয়ার সাথে মিলেছে। আবার এ নদী দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করেছে।
হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলে বৃহত্তর রংপুরে আরো অনেকগুলো ছোট ছোট নদী রয়েছে। উত্তরের উঁচু পাহাড়ী এলাকা হতে অসংখ্য নদী উৎপত্তি হয়ে রংপুর জেলার বিভিন্ন অংশের ওপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। নদীগুলো বড় বড় ভ‚মিকম্প ও পাহাড়ী ঢলে গতিপথ বদল করেছে। কিন্তু তিস্তায় পানি প্রবাহের অভাবে এসব নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। যমুনেশ্বরী নদীর কথাই ধরা যাক। এ নদী গতিপথ তিন বৃহত্তর জেলা রংপুর, বগুড়া ও পাবনার ভিতর দিয়ে প্রায় দু’শত মাইল পাড়ি দিয়ে বাঘাবাড়িতে হুড়া সাগরে পতিত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে এবং নদীপাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পানির অভাবে বেশিরভাগ আঞ্চলিক নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
কুড়িগ্রামের দুধকুমার নদীর পাড়ে যখন ঘুরছি; তখন স্থানীয়দের অনেকেই ছবি তোলা ও নদীপাড়ে বসে থাকার কারণ জানতে চান। সংবাদকর্মী পরিচয় দিলে তাদের কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, এক সময় দুধকুমার ও নাম ফুলকুমার নদীতে বড় বড় নৌকা চলত। নদী দিয়ে পাট বোঝাই নৌকা জামালপুরের সরিষাবাড়ি যেত। অথচ এখন নদী দু’টি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ভারত এ নদীর পানি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের তো অনেক আগেই দুধকুমারের পানি ভাগাভাগি করে নিয়ে ভারতের ওপর চাপ দেয়া উচিত ছিল। এখন চুক্তি করে হলেও দুধকুমারে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা উচিত। না হলে মানচিত্র থেকে নদীটি হারিয়ে যাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।