Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভারতীয় পণ্যে বাজার সয়লাব

সীমান্তে চোরাচালান ২

প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : দেশে সীমান্ত এলাকা এখন চোরাকারবারীদের দখলে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সংশ্লিষ্ট  অসাধু সদস্যদের সহযোগিতায় চলছে চোরাই পথে ভারতীয় পণ্যের আমদানি। অস্ত্র, গোলাবারুদ, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সারা বছরেই আসছে ভারত থেকে। তবে ঈদকে সামনে রেখে চোরাকারবারীদের তৎপরত কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, চোরাই পণ্য আটকের পর তা আবার পেছনের দরজা দিয়ে হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে চোরাকারবারীদের হাতে। বিজিবির হাতে আটক মালামালের একটি বড় অংশ কাস্টমসে জমা না হয়ে কথিত নিলামের নামে নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এ অভিযোগ স্থানী ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার। তারা বলছেন, ভারতীয় পণ্যে এখন বাজার সয়লাব। ভারতীয় পণ্য চোরাই পথে বাংলাদেশ প্রবেশের সুযোগ দেয়াতে ভারত হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ও এদেশীয় ব্যবসায়ীরা।
সীমান্ত এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের সব কয়টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আসছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত পথে অবৈধভাবে আসছে ভারতীয় পণ্য। ফেব্রিক্স, শাড়ি, বাচ্চাদের জামা-কাপড়, ধুতি, পাঞ্জাবির কাপড়, গেঞ্জি, শার্ট ইত্যাদি। ভারতীয় শাড়ী ও থ্রি-পিসের বড় উৎসই হচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্ত লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের বাজারগুলো। রাজশাহীর নিউমার্কেটের একজন পোশাক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে এরই মধ্যে রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলার বিপণি বিতানগুলো ভারতীয় পোশাকের দখলে চলে গেছে। গুণগতমান যাই হোক ভারতীয় পোশাক শুধু আকর্ষণীয় নামের কারণেই ক্রেতাদের বেশি আকর্ষণ করছে।
একজন ব্যাগেজ পার্টির সদস্য জানান, ভারতে গিয়ে একজন যাত্রী কয়েক লাখ টাকার মালামাল নিয়ে আসতে পারে। শুধু দুই পারের শুল্ক বিভাগ ও সীমান্তরক্ষীদের একটু ম্যানেজ করলেই কোনো সমস্যা হয় না। এসব পোশাক এনে সরাসরি ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়েও শুল্ক ছাড়া ভারতীয় পোশাক আনছে চোরাচালানিরা। হিলি দিয়ে আসা বিভিন্ন কাপড় ট্রেনে খুব সহজেই রাজশাহীতে আসছে। আবার ঢাকায়ও যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় কাপড় উদ্ধার করা হয়।
লালমনিরহাটের প্রায় দুশ’ কিলোমিটারজুড়ে কাঁটাতার বেষ্টিত সীমান্তবর্তী জেলা। এ সীমান্তের কাঁটাতার গলিয়েই দেদারসে আসছে ভারতীয় কাপড়। জেলার ৫ উপজেলার ২০টি পয়েন্টে সক্রিয় চোরাচালানিরা। কাঁটাতার পেরিয়ে আসা ভারতীয় কাপড় সাধারণত রংপুর নিয়ে পার্সেল করা হয়। তারপর পার্সেল সার্ভিস, বাসের লকার বা ট্রেনে তা ঢাকায় পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সীমান্ত এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ভারতীয় কাপড় কম দামে কিনে রাজধানীতে বেশ উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা যায়। ঢাকার ইসলামপুরে কাঁটা কাপড় বা থান কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারতীয় টি-শার্ট যাচ্ছে কালীগঞ্জ বাজারে। শাড়ি, থ্রি-পিস যাচ্ছে ঢাকার নিউমার্কেট ও বঙ্গবাজারে। মাঝে মধ্যে পুলিশ বা বিজিবির অভিযানে ভারতীয় কাপড় উদ্ধার হলেও তা অতি সামান্য বলে জানান তারা।
একটি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৬ জুন সাতক্ষীরা সীমান্তের ৩৮ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন  ৩৭ লাখ টাকার ভারতীয় শাড়ি, থ্রি-পিস ও বিভিন্ন ধরণের মালামাল বিক্রি করে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর কাছে। পরবর্তীতে ওই মালামাল রাস্তায় আটক করে অন্য একটি সংস্থা। এ নিয়ে বিজিবির ৩৮ ব্যাটালিয়ন ও ওই সংস্থার মধ্যে শুরু হয় দেন দরবার। পরবর্তীতে অবৈধ লেন দেনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে রফাদফা হলে এসব ভারতীয় মালামালের চালানটি নির্বিঘেœ ঢাকায় চলে আসে। স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী জানান, বিজিবি পানির দামে ওই মালামাল ৩৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে। ওই ব্যবসায়ী আরো জানান, চোরাই মালামাল আটকের পর তা বিক্রি করার এখতিয়ার বিজিবির নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেনাপোল বন্দর কাস্টমসের কমিশনার শওকত হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, চোরাই মালামাল আটকের পর তা যত সম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিকটস্থ কাস্টমস গোডাউনে জমা দিতে হবে। মালামালের একটি তালিকা করে তা কাস্টমসে জমা দেয়ার  বিধান রয়েছে। বিজিবি বা অন্য কোন সংস্থা তা বিক্রি করার বিধান নেই। কাস্টমস আইনানুগভাবে নিলামের মাধ্যমে এসব মালামাল বিক্রি করতে পারবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিজিবির আইনে কি আছে তা আমার জানা নেই, তবে আমি যতটুকু জানি তা হলো কোন চোরাই পণ্য জব্দ করার পর তা কাস্টমসের কাছে জমা হবে। নিলামের মাধ্যমে কাস্টমস বিক্রি করতে পারবে।
শুধু সাতক্ষীরাই নয়, কমিল্লা সদর, চৌদ্দগ্রাম, ফেনী, রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোরসহ বিভিন্ন সীমান্তে  আটক করা মালামাল বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। কুমিল্লা সদর ব্যাটালিয়ন ২২ ও ২৩ আগস্ট তিন দফায় প্রায় ৭০ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য কথিপয় ব্যবসায়ীর কাছে কম দামে বিক্রি করে। তাদের বিক্রি করা মালামালের একটি চালান প্রায় ১৪ লাখ টাকার মালামাল ২৪ আগস্ট দাউদকান্দি থানা পুলিশ জব্দ আটক করে আদালতে পাঠিয়েছে। জানা যায়, বিজিবির কুমিল্লা সদর ব্যাটালিয়নের নাহিদ নামের একজন মেজর ওই মালামাল ছেড়ে দেয়ার জন্য একাধিকবার দাউদকান্দি থানা পুলিশকে নিদের্শ দেয়। পরবর্তীতে এসব মালামাল না ছাড়াতে তিনি পুলিশের ওপর চরম নাখোশ হয়ে দেখে নেয়ার হুমকি দেন।
এ ব্যাপারে তার বক্তব্য জানতে কুমিল্লা সদর ব্যাটালিয়নে যোগাযোগ করলে, অফিস থেকে জানানো হয় মেজর নাহিদ স্যার দেশের বাইরে আছেন। তিনি স্বপরিবারে দেশের বাইরে বেড়াতে গেছেন। তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে, ওই কার্যালয়ের বিজিবির একজন কর্মকর্তা জানান, দাউদকান্দি থানায় যেসব মালামাল আটক করেছে তা বৈধভাবেই নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী ষড়যন্ত্র করে পুলিশকে দিয়ে এগুলো আটক করেছে।
দামুড়হুদা সীমান্তের ৭টি রুট দিয়ে অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে ভারতীয় শাড়ি, থান কাপড়, সুতা, থ্রি-পিস, প্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট, শাল ও জুতা-সেন্ডেলসহ বিভিন্ন কসমেটিকস। জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে চোরাচালানিদের লাগেজ পার্টি বলা হয়। এ পার্টির মূল মালিক বা মহাজনরা অধিকাংশই ঢাকা, পোড়াদহ ও ঈশ্বরদীর। তারা বৈধপথে কলকাতায় গিয়ে লাখ লাখ টাকার পণ্য কিনে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার নির্দিষ্ট ব্যক্তির হেফাজতে রেখে আসে। পরে সময় সুযোগ বুঝে ভারত ও বাংলাদেশের দালালরা কমিশনের মাধ্যমে ওইসব পণ্য ৫০০ টাকা জোন (লেবার/কামলা) হাজিরায় সড়ক ও রেলপথে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়। অভিযোগ আছে, টাকার বিনিময়ে এসব অবৈধ মালামালের অলিখিত বৈধতা দিচ্ছে কতিপয় অসৎ বিজিবি-পুলিশ সদস্য ও কাস্টমসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। লাগেজ প্রতি বিজিবির নামে তোলা হয় ৩ হাজার টাকা, পুলিশের নামে ১ হাজার ২৫০ টাকা, কাস্টমসের নামে ১ হাজার ৫০০ টাকা। চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন ৫টি থেকে ৫০টি পর্যন্ত লাগেজ আসে।
জানা গেছে, লাগেজগুলো প্রথমে বাংলাদেশী সীমান্তবর্তী জয়নগর গ্রামে পৌঁছায়। সেখান থেকে জোন (লেবার/কামলা) হাজিরায় পুরুষ ও মহিলারা বস্তায় ভরে এসব পণ্য দর্শনা হল্ট স্টেশন হয়ে ট্রেনে বা সড়ক পথে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। স্থানীয়রা জানান, মালামালের মূল মালিকরা এখানে কেউ থাকেন না। ব্যবসাটা চলে বিশ্বাসের ওপর কমিশনের মাধ্যমে।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার মো. রশীদুল হাসান জানান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুড়িগ্রাম শহরের কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে জানান, শুধু জেলা শহরে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা মূল্যের ভারতীয় চোরাই শাড়ি, থ্রি-পিস বিক্রি হয়। এছাড়া শীত মৌসুমে ভারতীয় শাল বিক্রি হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকার। এ হিসাবে ৯ উপজেলায় বছরে প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের শাড়ি ও এক কোটি টাকা মূল্যের ভারতীয় শাল বিক্রি হয়। ঈদ উপলক্ষে এ চোরাচালান আরও বেড়েছে। তারা জানান, সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাচ্ছে সুতা (প্যারাসুট) ও টাঙ্গাইলের শাড়ি। আর ভারত থেকে আসছে শাড়ি, থ্রি-পিস, শাল ও মোটরসাইকেল। এসব পণ্যের মূল্য লেনদেন হয় হুন্ডির মাধ্যমে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফুলবাড়ী উপজেলার বিদ্যাবাগিশ, গোড়ক মন্ডল, গঙ্গাহাট, বালারহাট, ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ভাওয়ালগুড়ি, সিংঝাড়, বাগভান্ডার, পাথরডুবি, নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা সীমান্ত, কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর, রৌমারী উপজেলার ভন্দুর চর, চর ফুলবাড়ি, চর পাহাড়তলি, মোল্লার চর এবং রাজিবপুর উপজেলার বালিয়ামারী, জাওনিয়ার চর ও কাউয়ারচর সীমান্তে সক্রিয় চোরাচালানিরা।
এদিকে সাতক্ষীরা ৩৮ ব্যাটালিয়নের বিজিবির সিও এর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ গত রাত সাড়ে ৭টায় টেলিফোনে আবারও যোগাযোগ করা হলে, ৩৮ ব্যাটালিয়নের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, সিও স্যার দেশের বাইরে। মেজর শামীম স্যার এখন দায়িত্বে আছেন। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে মেজর শামীমের সাথে বার বার যোগাযোগ করলেও তিনি মোবাইল কল রিসিভ করেননি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারতীয় পণ্যে বাজার সয়লাব

৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ