Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হঠাৎ তৎপর এবিটি নীরব জেএমবি চট্টগ্রামে ২ মাসে গ্রেফতার ২১ জঙ্গি

প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মোজাহেদীন বাংলাদেশ-জেএমবির তৎপরতা থেমে যাওয়ার পর হঠাৎই সক্রিয় হয়ে উঠেছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)।
এসব জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে সতর্ক রয়েছে পুলিশ, চলছে অভিযান। মাত্র দুই মাসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে এবিটির সন্দেহভাজন ১৩ সদস্য ২১ জঙ্গি। নিকট অতীতে চট্টগ্রামে এবিটির তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। অথচ এখন প্রায় ধরা পড়ছে এ জঙ্গি সংগঠনের সন্দেহভাজন সদস্যরা। গ্রেফতারের পর তাদের অনেককে দফায় দফায় রিমান্ডে আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ তাদের কাছ থেকে জঙ্গিদের ব্যাপারে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যও পেয়েছে। পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে এবিটির আড়ালে মূলত অন্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরাও চট্টগ্রামে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে।
নগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এদের নেপথ্যে কারা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। জঙ্গিরা যাতে ফের সংগঠিত হতে না পারে সে জন্য যা যা করণীয় পুলিশ তা করছে। জঙ্গিদের মদদদাতাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি জঙ্গিদের অস্ত্রের উৎস বন্ধ করতেও সক্রিয় রয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে জেএমবি এবং হিযবুত তাহরীরের তৎপরতা ছিল দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে জেএমবি এখানে বেশি সক্রিয় ছিল। বিগত ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলার মতো চট্টগ্রামেও তারা ২১টি পয়েন্টে সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর একই বছরের ৩ অক্টোবর নগরীর পরীর পাহাড়ের আদালত ভবনে দুই বিচারকের এজলাসে বই ও জ্যামিতি বক্সে রাখা বিশেষ বোমা ছুঁড়ে মারে জঙ্গিরা।
একই বছরের ২৯ নভেম্বর আদালত ভবনের প্রবেশপথে পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলা চালায় জেএমবি। এতে পুলিশ কনস্টেবল রাজিব, সীতাকু-ের ফুটবলার সাহাবুদ্দিন ও আত্মঘাতী জেএমবি জঙ্গি হোসেন আলী ওরফে হোসেন মাহমুদ নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো অনেকে।
তখন জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করা হলে নগরীর কাট্টলীসহ কয়েকটি এলাকায় বেশ কয়েকটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। র‌্যাব-পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গিদের তৎপরতা সীমিত হয়ে আসে। ধরা পড়ে অনেক জঙ্গি। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এখনো প্রায় ৪০ জঙ্গি বন্দী আছে। তাদের অনেকের সাজাও হয়েছে।
কয়েক বছর জঙ্গিবিরোধী অভিযান কিছুটা শিথিল হওয়ায় ফের জঙ্গিরা সংগঠিত হতে শুরু করে। তারা নগরীতে কয়েকটি অপরাধও করে বসে। গত বছর নগরীর বায়েজিদ এলাকায় কথিত নেংটা ফকিরের আস্তানায় হানা দিয়ে ফকির ও তার খাদেমকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ওই খুনের ঘটনায় জড়িত যুবক জেএমবির জঙ্গি।
পরে নগরীর সদরঘাট এলাকায় গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে ওই জঙ্গি। তৎকালীন এডিসি ডিবি বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি অভিযানে নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগরের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় বেশ কয়েকজন জেএমবি জঙ্গিকে। তারা পুলিশের কাছে স্বীকার করে নিজেদের তহবিল সমৃদ্ধ করতেই সদরঘাটে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ছিনতাই করতে যায় তারা। তবে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে নিজেদের গ্রেনেডে মারা যায় দুই জঙ্গি। তাদের হামলায় মারা যান একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারও।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন নেংটা ফকির ও তার খাদেমকে গলা কেটে হত্যা করার কথা স্বীকার করে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় নিহত দুই জঙ্গি সেখানে দুটি একে-২২ রাইফেল ফেলে যায়। পরে পুলিশ জেএমবির আস্তানা থেকে আরো একটি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করে। ডিবির অভিযানে নগরীর অদূরে হাটহাজারীর আমানবাজারের একটি জঙ্গি আস্তানা থেকেও আমেরিকান স্নাইপার রাইফেল উদ্ধার করে।
গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর নগরীর সদরঘাটে ওই ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে গত বছরের শেষ দিকে পুলিশ জেএমবির দু’টি আস্তানা আবিষ্কার করে। উদ্ধার হয় অস্ত্র ও দেশে তৈরি গ্রেনেড। একজন জঙ্গি কমান্ডার পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারাও যায়। সেই থেকে জেএমবি হঠাৎ করে নীরব হয়ে যায়।
আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবিটি। গত ১১ জুলাই জেলা পুলিশ সীতাকু- থেকে এবিটির বায়তুল মাল সম্পাদক মুসহাব ইবনে উমায়েরকে গ্রেফতার করে। পিকলু সরকার নামে ওই যুবক কিছুদিন আগে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়। তাকে গ্রেফতারের পর মূলত চট্টগ্রামে সংগঠনটির কার্যক্রম সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পায় পুলিশ। পুলিশের দাবি, তারা সীতাকু-ের শিল্পাঞ্চলে বড় ধরনের নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এরপর ১৭ জুলাই মো: শিপন ওরফে ফয়সাল (২৫), খোরশেদ আলম (৩১) ও রাসেল মো: ইসলামকে (৪১) আটক করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জেলা পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে উমায়েরের যোগসূত্রে ৩১ জুলাই পতেঙ্গা থেকে এবিটির ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরা হলোÑ মো: আক্কাছ আলী ওরফে জাহেদুল ইসলাম ওরফে নয়ন (২৩), মো: আতিকুল হাসান ইমন (২৬), জামশেদুল আলম হৃদয় (২১), মো: রুবেল (২৬) এবং মো: মহিউদ্দিন (১৮)।
ডিবি পুলিশের তথ্যমতে, আটক ওই ৫ জনের মধ্যে আক্কাছ আলী ছাত্রশিবিরের সাথী ছিল। তার কাছ থেকে পুলিশ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করে। ডিবি পুলিশ তখন সাংবাদিকদের জানায়, এবিটির সাথে ছাত্রশিবিরের যোগসূত্র আছে। যদিও জামায়াত-শিবির এসব তথ্য অস্বীকার করেছে।
এরপর ১৮ আগস্ট আনসারুল্লাহর আরো তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি। তাদের কাছেই মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহেদি নামে একজনের তথ্য পায় নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর এবিটির দুই সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ছাত্র মো: নিজাম উদ্দিন (২৫) ও গার্মেন্ট কর্মী মো: রোকন উদ্দিনকে (২৪) গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় নগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারও আগে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্র ও এবিটির জঙ্গিকে আটক করে পুলিশ।
এবিটির পাশাপাশি হিযুবত তাহরীরের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের দফায় দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিদের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এবিটির আড়ালে তারা ফের চট্টগ্রামে সংগঠিত হচ্ছে। তবে কয়েকটি গ্রুপ ধরা পড়ায় তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে গেছে। তাদের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রামে বড় ধরনের নাশকতার। তবে পুলিশি অভিযানে তা ভ-ুল হয়ে গেছে।
যারা এই অঞ্চলে জঙ্গিদের সংগঠিত করছে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের ধরতে অভিযানের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। তাদের ধরা গেলে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ভেঙে পড়বে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হঠাৎ তৎপর এবিটি নীরব জেএমবি চট্টগ্রামে ২ মাসে গ্রেফতার ২১ জঙ্গি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ