Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ট্রেন চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনে

২৭০টির মধ্যে ১৯৯টি আয়ুষ্কাল শেষ : অর্ধশত বছর বয়সী ইঞ্জিনও আছে

প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : সারাদেশে ট্রেন চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) দিয়ে। বর্তমান সরকারের আমলে ভারত থেকে আনা ৪৬টি এবং কোরিয়া থেকে আনা আরও ২৫টি ইঞ্জিন বাদ দিলে ২৭০টির মধ্যে ১৯৯টি ইঞ্জিনের ইকোনমিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। রেলওয়েতে ইঞ্জিনের সাথে চালকেরও সংকট আছে। ইঞ্জিন ও চালক সংকটে পশ্চিমাঞ্চলের ৪৪টি ট্রেনের মধ্যে ২০টি ট্রেন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, পূর্বাঞ্চলেও একই রকম সংকটে ট্রেন পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঢাকা বিভাগীয় ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার (লোকোমোটিভ) বলেন, পূর্ব-পশ্চিম দুই বিভাগের ইঞ্জিন ও চালক সংকট প্রকট। তারপরেও চালিয়ে নিতে হচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, নতুন ইঞ্জিন এলে এই সমস্যা আর থাকবে না। সূত্র জানায়, আগামী মার্চের মধ্যেই নতুন ইঞ্জিন ও বগি আসা শুরু হবে। জুন মাসের মধ্যেই রেলওয়ের বহরে যুক্ত হবে ২৭০টি নতুন বগি এবং ৭০টি ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভ। ইন্দোনেশিয়া এবং ভারত থেকে আমদানি করা হবে এসব ইঞ্জিন ও বগি।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, কাগজে-কলমে রেলওয়ের ব্রডগেজ ও মিটার গেজ মিলে মোট ইঞ্জিনের সংখ্যা ২৯৪টি। এর মধ্যে বর্তমানে চলমান আছে ২৭০টি। সারাদেশে ট্রেন চলাচল করে মোট ৩৩৯টি। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে (ঢাকা-চট্টগ্রাম) ২০১টি। যার মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা ৪২টি। পশ্চিমাঞ্চলে ট্রেনের সংখ্যা ১৩৬টি। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন ৪৪টি। সূত্র জানায়, কাগজে কলমে ট্রেনের সংখ্যা ৩৩৯টি বলা হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা আরও অনেক কম। কারণ ৩৩৯টি ট্রেনের বিপরীতে ইঞ্জিন সচল আছে ২৭০টি। এর মধ্যে কমপক্ষে ৫-৭টি ইঞ্জিন আবার বিকল থাকে অথবা ছোটখাটো ত্রুটির জন্য মেরামতে পাঠানো হয়।
সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট ডিভিশনে মাত্র একটি ইঞ্জিন ছাড়া অবশিষ্ট ৩১টিই ইকোনমিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে ১৮টি দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে এবং ছয়টি ইঞ্জিন পরিত্যক্ত অবস্থায় কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় (কেলোকা) পড়ে রয়েছে। এছাড়া যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চালনায় অনুপযোগী বাকি আটটি দিয়ে শান্টিং কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগীয় কার্যালয় ছয়টি সেকশন নিয়ে পরিচালিত। এসব সেকশন হলো Ñ লালমনিরহাট-বুড়িমারী, লালমনিরহাট-তিস্তা-রমনাবাজার, লালমনিরহাট-পার্বতীপুর, লালমনিরহাট-সান্তাহার, পার্বতীপুর-বিরল বর্ডার ও কাঞ্চন-পঞ্চগড়। ট্রেনের সময়সূচি অনুযায়ী এসব সেকশনে প্রতিদিন মেইল এক্সপ্রেস ২৪টি, লোকাল-মিক্সড ২৬টি ও আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ১২টি ট্রেন চলাচল করার কথা। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ট্রেন চালক এবং ইঞ্জিন না থাকায় চারটি মেইল এক্সপ্রেস, ১৬টি লোকাল-মিক্সড ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ২০টি মেইল এক্সপ্রেস, ১০টি লোকাল-মিক্সড ও ১২টি আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন কখনও নিয়মিত আবার কখনও অনিয়মিতভাবে চলাচল করছে। এসব ট্রেন পরিচালনার জন্য রেলওয়ের নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী প্রতিদিন ৬২টি ইঞ্জিন প্রয়োজন। অথচ লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ের কাছে আছে মাত্র ৩২টি ইঞ্জিন। এর মধ্যে ছয়টি মেরামত অযোগ্য হওয়ায় কেলোকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ট্রেন চালনায় অনুপযোগী আটটি ইঞ্জিন শান্টিং কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অবশিষ্ট ১৮টি ইঞ্জিনকে কোনও রকম জোড়াতালি দিয়ে ৪২টি ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে। রেলওয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী সারাদেশে রেলের অনুমোদিত জনবল রয়েছে ৪০ হাজার ২৬৪টি। এর বিপরীতে কর্মরত আছে ২৭ হাজার ৫৩৫টি। শুন্য আছে ১২ হাজার ৭২৯টি পদ।
সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চলে ট্রেন পরিচালনার জন্য মঞ্জুরিকৃত চালক (লোকো মাস্টার ) ১ম গ্রেড ও লোকো মাস্টার ২য় গ্রেডে পদ সংখ্যা ৮০টি। এ পদে কর্মরত আছেন নিয়মিত ২৯ জন ও চুক্তিভিত্তিক সাতজন। ৫১টি পদ শূন্য রয়েছে। সাব লোকো মাস্টার (এসএলএম) মঞ্জুরিকৃত ৪২টি পদের স্থলে কর্মরত আছেন ১৭ জন। ২৫টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া সহকারী লোকো মাস্টার ১ম গ্রেডে মঞ্জুরিকৃত ৪৬টি পদের স্থলে কর্মরত আছেন ৩৯ জন ও সহকারী লোকো মাস্টার ২য় গ্রেডে মঞ্জুরিকৃত ৮৬টি পদের স্থলে কর্মরত আছেন ৪৬ জন। এ পদের ১ম গ্রেডে সাতটি ও ২য় গ্রেডে ৪০টি পদ শূন্য রয়েছে। বর্তমানে সর্বমোট মঞ্জুরিকৃত ২৫৪টি পদের স্থলে ১৩১ জন কর্মরত থাকলেও ১২৩টি পদই শূন্য রয়েছে। এতে সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সূত্র জানায়, রেলওয়েতে অর্ধশত বছরের পুরাতন ইঞ্জিন রয়েছে। ১৯৬১ সালে আমেরিকা থেকে ২২শ সিরিজের (এমইজি-৯) ১১টি, ১৯৬৯ সালে কানাডা থেকে ২৩শ সিরিজের (এমইএম-১৪) ৮টি, কানাডা থেকে ১৯৭৮ সালে ২৪শ সিরিজের (এমইএম-১৪) আরও ৯টি এবং ১৯৮১ সালে হাঙ্গেরি থেকে ৩৩শ সিরিজের (এমএইচজেড-৮) তিনটি ইঞ্জিন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের জন্য আনা হয়েছিল। এরপর আর কোনও ইঞ্জিন কেনা হয়নি। তবে ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য আনা ২৯শ সিরিজের (এমইআই-১৫) একটি ইঞ্জিন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগকে দেওয়া হয়। এসব ইঞ্জিনের ইকোনোমিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর নির্ধারিত। কিন্তু আমেরিকা থেকে আনা ১১টির আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে ৩৪ বছর আগেই। কানাডা থেকে প্রথম ধাপে আনা ৮টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে ৪৬ বছর হয়েছে। অর্থাৎ এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ২৬ বছর আগেই। দ্বিতীয় ধাপে কানাডা থেকে আনা ৯টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়ে ৩৭ বছর হয়েছে। এগুলোরও মেয়াদ পেরিয়েছে ১৭ বছর আগে। হাঙ্গেরি থেকে আনা তিনটির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়ে ৩৪ বছর হয়েছে। এ তিনটি ইঞ্জিনের মেয়াদ ফুরিয়েছে ১৪ বছর আগে। রেলওয়ের সহকারী এক ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জানান, চালক বা ক্রু স্বল্পতার কারণে ট্রেন পরিচালনার জন্য অপরিহার্য ক্রু লিংক যথাযথভাবে বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে কিংবা রিলিফ ট্রেন পাঠানোর প্রয়োজন হলে অন্য কোনও একটি ট্রেন বাতিল করতে হচ্ছে কিংবা অস্বাভাবিক বিলম্ব করতে হচ্ছে। তাছাড়া কোনও ক্রু অসুস্থ হয়ে পড়লে কিংবা বিশেষ প্রয়োজনে ছুটিতে গেলেও ট্রেন বাতিল করার উপক্রম হচ্ছে। ক্রু সংকটের এই বেহাল দশার মধ্যেও ট্রেনের ক্রুদের সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করা হয় না বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন চালক। আলাপকালে এক চালক বলেন, হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে একটা ট্রেন চারিয়ে নিচ্ছে একজন চালক ও সহকারী চালক। রাত-দিন যাদের কাছে সমান। কিন্তু রাত জেগে ট্রেন চালিয়ে আসার পর গন্তব্যস্থানে ওই দুই চালক যাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে সেই ব্যবস্থাও নেই কোনো কোনো জায়গায়। আবার কোথাও কোথাও খাওয়ারও ব্যবস্তা নেই। খুলনা রুটের এক চালক বলেন, আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে চলন্ত অবস্থায় বাইরের কিছু খাওয়া যাবে না। কিন্তু থামার পরে আমরা কী খাবো, কোথায় খাবো তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। হোটেলের খাবার খেয়ে সহসাই পেট খারাপ হয়। খারাপ পেট নিয়ে ডিউটি করা যায় না। চট্টগ্রাম রুটের এক চালক বলেন, ঢাকায় চালকদের যে রানিং রুম আছে তা বসবাসযোগ্য নয়। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের চালকদের জন্য যে রানিং রুম আছে সেখানে চালকদের শিফটিং করে ঘুমাতে হয়। অর্থাৎ একজন একটি বিছানা ছাড়লে তবেই আরেকজন ওই বিছানায় ঘুমাতে পারে। হাইওয়ের পাশে হওয়ায় রাতে যানবাহনের শব্দে সেখানে ঘুমানো যায় না। আর মশার উৎপাত তো আছেই। এসব যন্ত্রণার মধ্যে কোনোমতে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ওই চালক যখন সকালে আবার ইঞ্জিনে বসেন তখন তার হাতে যাত্রীরা কতটুকু নিরাপদ তা সহজেই অনুমেয়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রেন চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ