Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুই সিটির বাজেট বেড়েছে বাড়েনি নাগরিক সেবা

প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সায়ীদ আবদুল মালিক : নগর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রতি বছর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বাজেট বরাদ্দ বাড়ালেও নাগরিক সেবার মান বাড়েনি। এক সিটি দুই সিটিতে রূপান্তর হওয়ার দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এলেও সেবার মানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা, বহুদিন ধরে মশা নিধন কার্যক্রমে স্থবিরতা, মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী, নগর ভবনের হেলপ ডেস্ক ও ট্রেড লাইসেন্স বিভাগসহ প্রায় সব বিভাগেই ঘুষ ছাড়া কাজ না হওয়ার অভিযোগ, সময়মতো জ্বলে না স্ট্রিট লাইট, প্রায় এক বছর ধরে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা, রাজস্ব বিভাগ থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স সমতাকরণের নামে নাগরবাসীকে হয়রানির অভিযোগসহ নানা অভিযোগ উঠেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে। অথচ প্রতি বছর আনুপাতিক হারে দুই সিটির বাজেট বেড়েই চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-১-এর আওতাধীন উত্তরার ৬নং সেক্টরের এক বাসিন্দা বলেন, কোনো কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ একদিন সিটি কর্পোরেশনের লোকজন এসে আমার বাসায় মাপজোখ করা শুরু করেদিল। এই মাপঝোখ কিসের জানতে চাইলে তারা বলেন, আপনাদের হোল্ডিং ট্যাক্স বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক কম। এটাকে সময় উপযোগী করতে মাপঝোখ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন থেকে পূর্বে কোনো প্রকার নোটিশ ছাড়া হঠাৎ একজনের বাসায় এসে মাপঝোখ করাটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত জানতে চাইলে তারা বলেন, রাজস্ব বিভাগ থেকে আমাদের পাঠানো হয়েছে তাই এ কাজ করতে হচ্ছে। এর বাইরে আর কিছু বলার নেই আমাদের।
তিনি বলেন, আমরা প্রতি বছর সিটি কর্পোরেশনকে নিয়মিত ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছি নাগরিক সেবা পাওয়ার আশায়। অথচ সে হারে সিটি কর্পোরেশন আমাদের নাগরিক সেবা দিতে পারছে না। ঘরে থাকলে মশার যন্ত্রণা, ঘর থেকে বের হলেই ময়লা আবর্জনা, রাস্তায় নামলে যানজটের কবলে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিনের সাথে বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে উত্তর সিটির অঞ্চল-১-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়া উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় হোল্ডিং ট্যাক্স সমতাকরণের কার্যক্রম চলছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৫ বছর পরপর হল্ডিং ট্যাক্স সমতাকরণের নিয়ম থাকলেও গত ২৫ বছর ধরে এ কাজটি হয়নি। রাজস্ব বিভাগ থেকে আমাদের খুবই অল্প সময়ের মধ্যে এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।
কোনো প্রকার নোটিশ বা সর্তকীকরণ ছাড়া কোনো বাসায় অতর্কিতভাবে গিয়ে মাপঝোখ করাটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত জানতে চাই তিনি বলেন, দেখুন আমার এলাকায় প্রায় ২৮ হাজার হোল্ডিং রয়েছে। এ ২৮ হাজার হোল্ডিংয়ের সমতাকরণ কাজ সম্পন্ন করতে আমাকে মাত্র তিন মাস সময় দিয়েছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে পুরা কাজ করতে হবে। তাই নোটিশ দিয়ে এ কাজ করা সম্ভব নয়।
দুই সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে দিন দিন অভিযোগের পাল্লা ভারী হচ্ছে। দুই সিটির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন দলমত ভুলে গিয়ে একযোগে অনিয়ম-দুর্নীতি করে যাচ্ছে। আর তাদের অব্যাহত লুটপাট, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সংস্থা দুটি।
২০১১ সালের পহেলা ডিসেম্বর ডিসিসি বিভক্ত হওয়ার পর দুর্নীতির দুর্গ হিসেবে খ্যাত নগর ভবনের কুশীলবদের জোট ভেঙে যায় তখন। সে সময় তারা মামলা ও বদলি আতঙ্কে উচ্চপর্যায়ে তদবির নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম শুরু হলে পর্যায়ক্রমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি প্রক্রিয়াও শেষ হয়ে যায়। আর সিটি কর্পোরেশন পরিচালনায় প্রশাসকনির্ভর হয়ে পড়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা দল ও মতের দ্বন্দ্ব ভুলে এক হয়ে যায়।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনে দুই সিটিতে নির্বাচিত মেয়র কাউন্সিলর আসার পর দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আবারও বেকায়দায় পড়ে। আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দুই নগর ভবনের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই নেয়া হয় বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ। এর মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির আনুমানিক ধরন ও ওজন চিন্তা করে কাউকে স্ট্যান্ড রিলিজ, কাউকে ওএসডি, কাউকে বড় পদ থেকে ছোট পদে পদায়ন, কাউকে একই মানের অন্য পদে বদলি, কাউকে নগরভবনের বাইরে অথবা আঞ্চলিক অফিসে বদলি এবং কাউকে চাকরিচ্যুত করে একটা আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন।
এদিকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) দুর্নীতির প্রভাবে নগরজীবনে নানা রকম ভোগান্তির চিত্র প্রকট হয়ে উঠছে। এ দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠান দুটির দায়িত্বশীলদেরও তেমন কোনো ভূমিকা নেই। তাদের অনেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
অবিভক্ত ডিসিসির সর্বশেষ অর্থবছরে (২০১১-১২) বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল দুই হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। আর বিভক্ত দুই ডিসিসির প্রথম অর্থবছরে (২০১২-১৩) বাজেট বরাদ্দ রাখা হয় ৩ হাজার ৪৮৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর পরের অর্থবছরে (২০১৩-১৪) বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৮৬০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১ হাজার ৯৮৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১ হাজার ৮৭৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেট ছিল ১ হাজার ৫৬৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর উত্তর সিটি করপোরেশন বাজেট ছিল দুই হাজার ৪১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেট ছিল ২ হাজার ৮৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আর উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বাজেট ছিল ১ হাজার ৬০১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
বর্তমান ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেট ৩ হাজার ১৮৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। আজ উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বাজেট ২ হাজার ৮৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
প্রতি অর্থবছরেই বরাদ্দের অঙ্ক বেড়ে চললেও সেবার ক্ষেত্রে তার কোনো প্রভাব নেই। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একত্রিত হয়ে উভয় ডিসিসিতে দেদার লুটপাট চালাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটে সম্পত্তি, সড়ক, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা, বস্তি উন্নয়ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। নতুন বাজেট ঘিরে তারা বিভিন্ন সময় কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন বৈঠক করছেন নতুন বরাদ্দের কাজকর্ম ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে।
এদিকে শুধু বাজেট বরাদ্দ থেকেই নয়, লুটপাট হচ্ছে রাজস্ব আদায়সহ অন্যান্য খাত থেকেও। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন সেল, বিউটিফিকেশন, পরিবহনের তেল, ভাগাড়ের মালামাল বিক্রি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ক্লিনারদের চাকরিতে নিয়োগ বাণিজ্য। এছাড়া গুলশান, বনানী ও উত্তরায় নগদ টাকায় পরিচ্ছন্ন কাজ করানো হয়। মশার ওষুধ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাতে ভয়াবহ দুর্নীতি চলেছে। এ খাতে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই আছে বিস্তর অভিযোগ।
ডিসিসির দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি বিশেষ টিম গঠন করেছে বেশ কিছু দিন আগেই। ওই টিমের একজন প্রধান উপ-পরিচালক জানান, অতীতে দুর্নীতির অভিযোগের নমুনা ধরেই অনুসন্ধান কাজ চলছে। কমিটি ইতোমধ্যে ভবন নির্মাণ, মার্কেটের দোকান বরাদ্দ, বিলবোর্ড স্থাপন, টেন্ডার প্রক্রিয়া, সংস্কার কাজ, বস্তি উন্নয়ন প্রকল্প, বাস টার্মিনাল নির্মাণ, টোল আদায় ও পরিবহন জ্বালানি তেল কেনায় দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় কয়েকটি মামলাও হয়েছে। আর বেশকিছু অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে মামলা করা হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • Nasir Hussain ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:৫২ এএম says : 0
    ১০০% কারেক্ট
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুই সিটির বাজেট বেড়েছে বাড়েনি নাগরিক সেবা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ