Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৭ জুন ২০২৪, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

রেকর্ড পরিমাণ জমিতে গমের আবাদ

প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য ফসল গম আবাদে এবার রেকর্ড গড়েছেন কৃষি যোদ্ধাগণ। তবে এবার শীতে তাপমাত্রার পারদ নিচে নামলেও তা স্থায়ী না হওয়ায় এখনো গম উৎপাদন নিয়ে কিছুটা সংশয় থাকলেও কৃষি সম্প্রসারন অধিদফতরের দায়িত্বশীল মহল লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় মত প্রকাশ করেছেন। মূলত শীত প্রধান দেশের খাদ্য ফসল গম আমাদের দেশে আবাদের ইতিহাস খুব বেশী দিন আগের নয়। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বারি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ গম গবেষণা কেন্দ্র দেশে গম আবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও আমাদের কৃষকদের অবদানও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন কৃষিবিদগণ। ইতোমধ্যে গম আবাদে বাংলাদেশ বিশ্বে ৮ম-১০ম পর্যায়ে পৌঁছার পাশাপাশি দেশের দ্বিতীয় খাদ্য ফসল হিসেবেও তা স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
চলতি রবি মওসুমে দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশের সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৪ লাখ টন গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে ইতোমধ্যে সে লক্ষ অতিক্রম করে ৪লাখ ৮০ হাজার হেক্টরেরও বেশী জমিতে এবার গমের আবাদ হয়েছে। ফলে চলতি মওসুমে দেশে গম উৎপাদনের পরিমাণ ১৫ লাখ টনে পৌঁছতে পারে বলে আশাবাদী মাঠ পার্যায়ের কৃষিবিদগন। দেশে বার্ষিক গমের চাহিদা বর্তমানে ৫০ লাখ টনের ওপরে। এর মধ্যে বরিশাল ও ফরিদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি জেলার ৭৩ হাজার ৬৭৯ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্য নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবে ইতোমধ্যে ৭৮ হাজার ৫১ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে এবার সোয়া ২ লাখ টন গম উৎপাদনের যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, তা আড়াই লাখ টনে পৌছবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কৃষি সম্প্রসারন অধিদফতর-ডিএই’র দক্ষিণাঞ্চলের দায়িত্বশীল মহল।
তবে শীত প্রধান দেশের এ খাদ্য ফসল আবাদে ডিএই এবং বারিসহ গম গবেষনা কেন্দ্রের নিবিড় সমন্বয়ের মাধ্যমে কম শীতে উচ্চ ফলনশীল ও নোনা পানি সহিষ্ণু জাতের গম বীজ এবং এর আবাদ প্রযুক্তি কৃষকদের কাছে পৌছে দেয়া জরুরী। কম সেচে অধিক ফসল উৎপাদনসহ রোগ-বালাইয়ের আক্রমন কম হওয়ায় গম আবাদ ও উৎপাদন ব্যয় কম। পাশাপাশি ধানের সাথে তুলনামূলকভাবে গমের দামও ভাল। ফলে কৃষকগন কম বিনিয়োগ ও ঝুঁকিতে অধিক আয়ের লক্ষে গম আবাদে ঝুঁকছেন বলে ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল মনে করছেন। এমনকি বোরো ধানের চেয়ে গম আবাদ ও উৎপাদনে রাসয়নিক সারের ব্যবহারও কম। ফলে কৃষকের বিনিয়োগ কম, আয় বেশী। উপরন্তু দেশে এখন প্রতি মণ ইরি-বেরো ধান উৎপাদন ব্যয় যেখানে প্রায় ৬শ’ টাকার কাছাকাছি, সেখানে গমের ক্ষেত্রে তা ৫শ’ টাকারও কম। অপরদিকে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকার মধ্যে। কিন্তু গম বিক্রি হয় ৮শ’ টাকার ওপরে।
মূলত গম আবাদে সেচ ব্যয়ও খুবই কম। যেখানে আমাদের দেশে বোরো আবাদ ও উৎপাদন ব্যায়ের প্রায় ৩৩%-এরও বেশী সেচ ব্যায়, সেখানে গমের ক্ষেত্রে তা ১০%-এরও কম। পাশাপাশি আমাদের প্রকৃতিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থার জন্যও গম যথেষ্ট উপযোগী। যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বোরো ধানের চেয়ে গম অনেক বেশী প্রতিরোধক্ষম ও টেকসই। আর এসব কারণেই সারা দেশের মত দক্ষিনাঞ্চলেও গম আবাদ গত কয়েকটি বছর যাবৎ বেড়ে চলতি মওসুমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। চলতি রবি মওসুমে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় ৫ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৪ হাজর ৫১ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে ইতোমধ্যে। যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় তিনগুণ। এর মধ্যে শুধু দ্বীপজেলা ভোলাতেই ৩ হাজার ৪৮৩ হেক্টরে আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রায় ১০ হাজার হেক্টরে গম আবাদ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে।
আমাদের দেশে গম আবাদের ইতিহাস খুব বেশী দিন আগের নয়। বিশেষ করে দক্ষিনাঞ্চলের জেলাগুলোতে তা মাত্র একযুগ আগে শুরু হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে অপ্রচলিত এ খাদ্য ফসল আবাদে কৃষকদের আগ্রহ লক্ষণীয়ভাবে বাড়তে শুরু করেছে। সত্তরের দশকে দেশে সামান্য কিছু জমিতে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত ‘খেরী, আইপি-৫২ ও আইপি-১২৫’ জাতের গম-এর আবাদ শুরু করেন কৃষকগন। পরিবর্তীতে কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি আবহাওয়া পরিস্থিতি ও উৎপাদন অনুকূল পরিবেশের কথা চিন্তা করে এবং কৃষকের বিষয়টিও বিবচনায় নিয়ে বিদেশ থেকে ‘কল্যাণ সোনা’ ও ‘সোনালিকা’ জাতের মধ্যম মানের ফলনশীল গমবীজ আমদানী করে। আমদানীকৃত ঐসব বীজ দিয়ে আবাদ সম্প্রসারন কার্যক্রম শুরু করে কৃষি সম্প্রসারন অধিদফতর। স্থানীয় জাতের তুলনায় এসব গমের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বেশী হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে আগ্রহও বৃদ্ধি পায়।
তবে পরবর্তীতে ‘বারি’ পর্যায়ক্রমে ‘শতাব্দী, প্রদিপ, সৌরভ, গৌরব, সুফী এবং বিজয়’ নামের উচ্চ ফলনশীল গমের জাতসমূহ উদ্ভাবন করেছে। এসব জাতের মধ্যে দক্ষিনাঞ্চলের মত কম শীত প্রধান এলাকার জন্য উচ্চ তাপ সহনশীল ‘শতাব্দী’ জাতটি ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এছাড়াও ‘বারি গম-২৫’ ও ‘বারি গমÑ২৬’ নামের আরো দুটি উচ্চ ফলনশীল এবং লবণাক্ততা ও উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল দুটি জাতও উদ্ভাবন করেছেন আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীগন। অপরদিকে দেশী আগাছা ও গমের জাত থেকে শংকরায়ন করে ‘ট্রিটিক্যালী-১’ ও ‘ট্রিটিক্যালী-২’ নামের আরো দুটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীগন।
কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আমাদের এসব উচ্চফলনশীল গমের জাতসমূহ আবাদ ১০ লাখ হেক্টরে উন্নীত করতে পারলে আগামীতে দেশ গম উৎপাদনে যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করবে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। তবে সেলক্ষে গম আবাদ সম্প্রসারন কার্যক্রম গ্রহণসহ এর আবাদ প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন মহলটি। আর এ লক্ষ্যে বারি, ডিএই ও গম গবেষনা কেন্দ্রের নিবিড় কার্যক্রম গ্রহণসহ তা মাঠ পর্যায়ে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়ার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন মাঠ পার্যায়ের কৃষিবিদগন। দেশে বর্তমানে প্রায় ৪৭ লাখ হেক্টরে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। গম আবাদ ২০ লাখ হেক্টরে উন্নীত করতে পারলে এ খাদ্য ফসলের ক্ষেত্রে বিদেশী নির্ভরতা প্রায় হ্রাস করা সম্ভব হবে বলেও মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রেকর্ড পরিমাণ জমিতে গমের আবাদ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ