ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মুজিবুর রহমান মুজিব
বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি এবং সফল অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী, ভাষাসৈনিক এম সাইফুর রহমানের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গতকাল। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নিজ বাড়ি বাহার মর্দান থেকে সড়ক পথে ঢাকা যাবার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা এলাকায় এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। টিভি ব্রেকিং নিউজে তার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হলে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। ঢাকা-টিটাগাং-সিলেট-মৌলভীবাজার-বাহার মর্দানে তার স্বজন-শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে কান্নার রোল উঠে। সত্তরোর্ধ্ব কর্মবীর এম সাইফুর রহমান ছিলেন কর্মচঞ্চল-প্রাণবন্ত। বার্ধক্যজনিত ব্যাধি এবং বয়স তাকে কাবু করতে পারেনি। কর্মই জীবন, এই জীবন ঘনিষ্ঠ শ্লোগানে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কি সরকারে, কি বিরোধী দলে কাজের মাঝেই ব্যস্ত থাকতেন কথার জাদুকর এম সাইফুর রহমান।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী বাহার মর্দানে বৃটিশ শাসনের শেষ ভাগে শিক্ষানুরাগী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এম সাইফুর রহমানের জন্ম। সেকালে মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন কম থাকলেও তার শিক্ষাবিদ পিতা আব্দুল বাসির একজন প্রকৃত শিক্ষানুরাগী ছিলেন। বাল্যকৈশোরেই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন এম সাইফুর রহমান। শৈশবেই পিতৃ বিয়োগের পর শিক্ষানুরাগী চাচা আলহাজ মোঃ সফির ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে তার লেখাপড়া চলতে থাকে। বায়ান্ন সালে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও কারাবরণ করেন তিনি। গ্রেপ্তারকৃতদের মুচলেকার মাধ্যমে মুক্তি দেয়া হলে নীতিবান ও জেদি এম সাইফুর রহমান অন্যায়ভাবে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি চাননি। ছাত্র জীবনে ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্রনেতা না হলেও রাজনীতি সচেতন ছিলেন তিনি। গ্রেপ্তার ও কারা যাতনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি মেধাবী ছাত্র হিসাবে সেকেলে রেওয়াজ মোতাবেক সিএসপি হয়ে বড় আমলা হতে চাননি। ভিন্ন ধারায় চিন্তা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষে বাণিজ্য বিভাগে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃটেন গমন করে ১৯৫৩-৫৮ সালে সিএ পড়া শেষে ১৯৫৯ সালে ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টেন্টস ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এর ফেলোশিপ অর্জন করে সফল শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। এম সাইফুর রহমান মুদ্রানীতি ও উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন যা তার বাস্তব জীবনে ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে প্রতিফলিত হয়েছে।
কর্মজীবনে এম সাইফুর রহমান পাকিস্তান অক্সিজেন কোম্পানীতে যোগদান করে দুই বছর কৃতিত্বের সাথে কাজ করার পর নিজেই রহমান এন্ড হক কোম্পানী নামে একটি সিএ ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীকালে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাত্র ক’বছরের মাথায় বিপথগামী কতিপয় সেনা কর্মকর্তার হাতে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। জেনারেল জিয়া দেশের জ্ঞানী-গুণী-প-িত-বিদ্বান-বিজ্ঞজনদের নিয়ে একটি-ট্যালেন্টড কেবিনেট গঠন করেন। এম সাইফুর রহমান জেনারেল জিয়ার আহ্বানে ১৯ দফা কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে ১৯৭৬ সালে বাণিজ্য উপদেষ্টার দায়িত্বভার নিয়ে উৎপাদন ও উন্নয়নের রাজনীতিতে শামিল হন। বাণিজ্য উপদেষ্টা থেকে পরে অর্থমন্ত্রী হন তিনি। এম সাইফুর রহমান প্রেসিডেন্ট জিয়া, জাস্টিস সাত্তার এবং বেগম খালেদা জিয়া সরকার আমলে সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে মোট ১২ বার বাজেট পেশ করে উপমহাদেশীয় ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। বিএনপির সকল সরকারের আমলে নেতানেত্রীদের ক্ষমতা-পদ-পদবী পরিবর্তন হলেও তার বেলায় ছিল ব্যতিক্রম। বরং তিনি ছিলেন পার্মানেন্ট ফাইন্যান্স মিনিস্টার। ২০০১ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশের বিশাল বিজয় নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার গঠিত হলে এম সাইফুর রহমান অর্থের সঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বভার প্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন একাই একশ। তাঁর কোন বিকল্প ছিল না ।তার তুলনা ছিলেন তিনিই।
এম সাইফুর রহমান প্রেসিডেন্ট জিয়ার অর্থমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন তিনি। তার বাজেট প্রণয়ন ও অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঐতিহাসিক উনিশ দফা কর্মসূচী। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতাবস্থা আনাই ছিল তার লক্ষ্য। বারো বার বাজেট পেশকারী অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সেই লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল তার নখদর্পণে। দেশীয় অর্থনীতির নাড়ি-নক্ষত্র ছিল তার জানা। তিনি শেয়ারবাজারকে আলুর বাজার বলেন নাই। মন্ত্রণালয়ে তার শক্ত কমান্ড ছিল। ক্লিনার থেকে সচিব পর্যন্ত সকলের কার্যক্রম ছিল তার তীক্ষ্ম নজরে। ড. ফখর উদ্দীন আহমদ, ড. সালেহ উদ্দিন আহমদের মত খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদগণ তার অধীনে, তার নেতৃত্বে কাজ করেছেন। তাঁর ক্যারিসমাটিক ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা ও পা-িত্য, মেধা ও মনন, সিনিওরিটি ও ম্যাচিওরিটির কারণে মন্ত্রণালয়ের কোন কাজে কোন কর্তাব্যক্তির ফাঁক ও ফাঁকির সুযোগ ছিল না। জ্যেষ্ঠতা ও অভিজ্ঞতার কারণে তিনি বড় কর্তাদের নাম ধরে ডাকতেন, তুমি বলে সম্বোধন করতেন, শিক্ষকের মত ভুলত্রুটি শুধরিয়ে দিতেন। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের আমলেও অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান মুন্সিয়ানা ও পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৯৪ সালের দিকে তিনি বিশ্বব্যাংকের সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের বোর্ড অব গভর্নসের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ও ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করেন। ঐ সালে আইএমএফের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মাদ্রিদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করে তিনি দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেন। তার সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি শৃঙ্খলা ছিল, উৎপাদন ও বিনিয়োগ ছিল, মুদ্রাস্ফীতি ছিল না, মুদ্রানীতি ছিল নিয়ন্ত্রণে।
একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য। বৃহত্তর সিলেটে তার বলিষ্ঠ ও গতিশীল নেতৃত্বেই দল গড়ে উঠে। তিনি ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের প্রাণপুরুষ, সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহান অভিভাবক। ব্যক্তির চাইতে দল বড়, দলের চাইতে দেশ বড়- এই নীতির কট্টর সমর্থক ছিলেন এম সাইফুর রহমান। দল ও দেশ প্রসঙ্গে একবার একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ‘ঝড়সব নড়ফু রং ভড়ৎ অধিসরষবধমঁব, ংড়সব নড়ফু রং ভড়ৎ ই.ঘ.চ. ঘড় নড়ফু রং ভড়ৎ ইধহমষধফবংয.’ কেউ আওয়ামী লীগের জন্য, কেউ বিএনপির জন্য, বাংলাদেশের জন্য কেউ নেই, এমন বোমাফাটা বক্তব্য দিয়ে তিনি দেশীয় রাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছিলেন। তিনি নিজে বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা হয়ে নিজ দলকেও দেশের উপরে স্থান দেননি। দেশকে দলের উপরে স্থান দিয়েছিলেন বলেই এমন কঠিন-কঠোর মন্তব্য করার দুঃসাহস তিনি দেখাতে পেরেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সাইফুর রহমান ছিলেন একজন সফল-সুখী ব্যক্তি। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের এক অভিজাত -খান্দানী পরিবারের কৃতী কন্যা বেগম দুররে সামাদের সঙ্গে তার শুভ বিবাহ হয়। বেগম রহমান ছিলেন একজন গুণবতী মহিলা। এই দম্পতির সুখময় দাম্পত্য জীবনের ফল ও ফসল তিন পুত্র ও এক কন্যা। পুত্রত্রয় উচ্চশিক্ষিত-কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার প্রথম পুত্র এম নাসের রহমান কীর্তিমান পিতার পদাংক অনুসরণ করে জিয়ার আদর্শের সৈনিক হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে পিতার ছেড়ে দেয়া আসন মৌলভীবাজার-৩ এ চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে উন্নয়ন কর্মকা-ে অভিষেক ঘটান, খ্যাতি ও স্বীকৃতি অর্জন করেন। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান এম নাসের রহমান বর্তমানে জেলা বিএনপির সভাপতির গুরু দায়িত্ব কৃতিত্বের সাথে পালন করছেন। অপর পুত্রদ্বয় কাওসার রহমান ও শফিউর রহমান উচ্চশিক্ষিত ও কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। সাইফুর রহমানের একমাত্র কন্যা সাইফা রহমান চট্টগ্রামের আরেক অভিজাত পরিবারে পাত্রস্থ।
এম সাইফুর রহমানের মত উঁচুদরের, বড়মাপের মানুষের যথার্থ মূল্যায়ন ও স্মৃতি কথা লেখা খুবই কঠিন ও জটিল কাজ। তার দলের একজন কর্মী হিসেবে তাকে কাছে থেকে দেখেছি, জেনেছি। এ আমার সামান্য কর্মজীবনের এক গৌরবজনক অধ্যায়। তিনি আমাদের প্রজন্মের কাছে ভাই মার্কা শুধু নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক শিক্ষক,পিতৃতুল্য অভিভাবক। তার একজন কর্মী হিসেবে, অনুগামী হিসেবে সিলেটে-ঢাকায় তার পিছু পিছু ছুটেছি, হৃদয় দিয়ে পিতৃ¯েœহ অনুভব করেছি। তিনি আমাকে পুত্রবৎ ¯েœহ করতেন। আমি তাকে নেতা নয়,পিতার মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করতাম, করিও।
আমি তার সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার উজ্জ্বল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তাকে বেহেশত নসীব করুন, এই মোনাজাত করছি।
লেখক : একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক এর সাবেক পরিচালক ও চেয়ারম্যান নির্বাহী কমিটি। সিনিয়র এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।