Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মন্ত্রিত্ব বহাল অবৈধ ও অসাংবিধানিক -শহীদুল্লাহ ফরায়েজী

প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ফ ম মোজাম্মেল হক আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে আদালত অবমাননার রায়ে আপিল বিভাগ অভিমত দিয়েছেন।
সংবিধানের ১৪৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘তৃতীয় তফসিলে উল্লিখিত যে কোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যভার গ্রহণের পূর্বে উক্ত তফসিল অনুযায়ী শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা (এই অনুচ্ছেদে ‘শপথ’ বলিয়া অভিহিত) করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিবেন।’
সংবিধানের ১৪৮ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘এই সংবিধানের অধীনে যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ আবশ্যক, সেক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’
সংবিধানের এই নির্দেশনা অনুযায়ী, দুই মন্ত্রী কার্যভার গ্রহণের পূর্বে যে শপথ নিয়েছেন, শপথ ভঙ্গের কারণে তার অবসান হয়েছে। আর শপথ অবসানের কারণে তাদের কার্যভারও অপসারিত হয়েছে।
শপথের অবসান হওয়ার পর মন্ত্রী পদে বহাল থেকে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করা, মন্ত্রণালয়ের ফাইলে স্বাক্ষর করা, পতাকাবাহী গাড়ী ব্যবহার করা, এমনকি মন্ত্রিপরিষদ সভায় উপস্থিত হওয়া হবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক। অতএব, এখন সরকারের দায়িত্ব আদালতের রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রীদ্বয়ের শূন্য পদের প্রজ্ঞাপন জারি করার লক্ষ্যে দ্রুত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানীকে আদালত অবমাননার দায়ে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট ৩০ সেকেন্ড সাজা দিয়েছিলেন। এই সাজার ফলে আদালত থেকে বের হয়ে গিলানী সরকার পদত্যাগ করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশে গত ২৭ মার্চ আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে দুই মন্ত্রীকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে অর্থদ- অনাদায়ে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদ- দেয় সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ।
ঙধঃযং ড়ভ ঙভভরপব এর বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের অনেক দেশেই প্রায় একই রকম আইন-বিধান বা রীতি অনুসরণ করা হয়। যারা শপথ গ্রহণকারী তারা যদি শপথ ভঙ্গ করেন তাহলে দুই ধরনের সাজা প্রদান করা হয়। যথা ১) পদ থেকে অপসারণ (Removal from Office) ২) কারাগার বা জরিমানা Confinment or Fine)| । Oaths of Office নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তর্নিহিত নির্দেশনাও এরকম। আমাদের মন্ত্রীদ্বয় দোষ স্বীকার করে জরিমানা দিয়েছেন এখন রাষ্ট্রের দায় হচ্ছে তাদের অপসারণ করা। রাষ্ট্রের এই দায় বহন করতে সরকার বাধ্য।
সংবিধানের শপথ ভঙ্গ করলে পরিণতি কী হবে আদালত অবমাননার অভিযোগের বিষয়ে শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সে প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রধান বিচারপতি আরো বলেছিলেন, বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপÑ এগুলি ফৌজদারী আদালত অবমাননা। ডাকাতি মামলার আসামীর যেমন, তেমনি ফৌজদারি আদালত অবমাননার অপরাধ একই। শপথ ভঙ্গ যে গুরুতর আইনগত ও নৈতিক অপরাধ প্রধান বিচারপতি তাই নিশ্চিত করেছেন। আর এখন যদি সংবিধানের শপথ ভঙ্গ করার জন্য দুই মন্ত্রীকে কোন পরিণতিই বহন করতে না হয়, তাহলে শপথ গ্রহণের আবশ্যকতারই কোন প্রয়োজন পড়বে না এবং বঙ্গভবনে আর অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শপথও নিতে হবেনা। সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায় সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অকার্যকর হয়ে পড়বে।
সংবিধানের শপথের রয়েছে গভীর তাৎপর্য। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আইন বহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষতিকর পরিণতি থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার যে নৈতিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয় তাই হচ্ছে শপথ। রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে “শপথ” হচ্ছে অন্তর্নিহিত প্রেরণা। আর এই জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোয় সর্বোচ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে শপথ গ্রহণ সংবিধানের ১৪৮ (৩) এ আবশ্যক করা হয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শপথ যারা গ্রহণ করবেন তারা অবশ্যই জ্ঞান ও উচ্চতম আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। যারা পরার্থপর লোকহিতকর, স্বার্থপরতা শূন্য, ন্যায়পরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠÑ তারাই উচ্চ পদের দায়িত্ব শপথ নিয়ে পালন করবেন এটাই সংবিধানের শপথের মর্মবাণী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্র হবে বিবেক-বিচার, নীতি-নৈতিকতার নৈতিক প্রতিষ্ঠান।
সংবিধান সংসদ প্রণীত আইন। সংসদ কর্তৃক সংবিধানের ৫ম, ৮ম, ১৩তম সংশোধনীকে সংবিধানের এখতিয়ার বহির্ভূত ও অবৈধ বলে রায় দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। আর সর্বোচ্চ আদালতের এ রায় কার্যকর করেছে সরকার।
আর আমাদের সংবিধানের আপীল বিভাগকে ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রীম কোর্টের উপদেশমূলক এখতিয়ার দিয়েছে।
কোর্ট রায় দেয়ার পর সংবিধানের সংশোধনী যেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায় সেখানে শপথ লংঘনের মত একটি স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ রায়ের পর মন্ত্রী পদে বহাল রাখার প্রশ্নটি শুধু সংবিধান লংঘনের শামিল নয়Ñ আদালত অবমাননারও শামিল। সরকার যদি মন্ত্রীদ্বয়কে অপসারণ না করেন, তাহলে বড় ধরনের শাসনতান্ত্রিক সংকটে পড়বেন। যা শাসনতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য শুভ নয়।
লেখক: গীতিকবি
ই-মেইল: [email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মন্ত্রিত্ব বহাল অবৈধ ও অসাংবিধানিক -শহীদুল্লাহ ফরায়েজী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ