করোনায় আরও ৩৩ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১ হাজার ৫৯৬
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট
১৭ মার্চ ২০২১ তারিখে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবসকে সামনে রেখে লেখাটি লিখছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একটি কথা মনে করিয়ে দিতে। ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ (যাকে বাংলায় স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বা মোসাহেবতোষী পুঁজিবাদ বলা যায়) বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের সাথে চরম বিশ^াসঘাতকতা। বঙ্গবন্ধু একটি কথা বারবার বলতেন, ‘পৃথিবীতে দুই দল মানুষ আছে, একদল শোষক, আরেক দল শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে’।
মোসাহেবরা নিকৃষ্ট শোষকগোষ্ঠিরই প্রতিভূ। ক্ষমতাসীন দল বা জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের দাক্ষিণ্যলোভী এই শোষকদেরই সৌভাগ্যের জোয়ার চলেছে বর্তমান বাংলাদেশে। রাষ্ট্রক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতা লাভে সফল এসব ধুরন্ধর ব্যক্তি এদেশে অতি দ্রæত ধনকুবেরে পরিণত হচ্ছে। এর পরিণামে বাংলাদেশ ধনকুবের সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশে^ সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লজ্জাজনক স্থানটি দখল করেছে। অথচ, বাংলাদেশ একটি ‘গণপ্রজাতন্ত্র’, যার চারটি রাষ্ট্রনীতির মধ্যে ২০১০ সাল থেকে আবার সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যাবৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশে^র বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারাবিশে^ এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা ২৫৫ জন। ধনকুবেরের এই দ্রুততম প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের জন্যে একটি লজ্জাজনক অর্জন। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের অব্যাহত দৌরাত্ম্যের কারণেই ধনকুবেরদের এই রমরমা প্রবৃদ্ধি ঘটছে এদেশে। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশ চাননি।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় যখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এগার দফা রচনা করে ছয় দফাভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে শোষিত জনগণের শোষণমুক্তির সংগ্রামে রূপান্তরিত করেছিল তখন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু ঐ নির্বাচনকে ছয় দফা এবং এগার দফার উপর গণভোট হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন (এগার দফার তৃতীয় দফাটি হুবহু ছয় দফা)। তখন থেকেই সমাজতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আর সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দিনের বেতার ভাষণে ঘোষিত বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনটি মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তাঁর ইচ্ছানুসারে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিধৃত রাষ্ট্রনীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাশ করে চতুর্থ রাষ্ট্রনীতি সমাজতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্রে’র জলো বিশেষণের আড়ালে নির্বাসিত করে দেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে আবার সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের প্রায় দশ বছর পর সেজন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে চাই, ২০২১ সালের বাংলাদেশে তো এখনো ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ এবং ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র দোর্দন্ড প্রতাপই চলছে। সমাজতন্ত্র কোথায়? শোষিতের শোষণমুক্তির পথ তো ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ হতে পারে না। শোষিত শ্রমজীবী কৃষক-শ্রমিকের শোষণমুক্তির দর্শন কখনোই মুক্তবাজার অর্থনীতির ছদ্মবেশধারী ‘বাজার মৌলবাদী পুঁজিবাদ’ হতে পারে না।
সমাজতন্ত্র বলতে আমরা নিশ্চয়ই অধুনা-বিলুপ্ত সোভিয়েত স্টাইলের ‘স্টেটিজম’ প্রতিষ্ঠার আবদার করছি না। ঐ প্রত্যাখ্যাত মডেলগুলোকে বিশে^র কোনো দেশে আর ফেরত আনা যাবে না, সেটা না বোঝার মতো আহাম্মক আমরা নই। কিন্তু বিশে^র বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের নানাবিধ সৃজনশীল প্রায়োগিক মডেল- যেগুলোকে একইসাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখায় চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করতে দেখছি, সেগুলো থেকে আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না কেন? গণচীন এবং ভিয়েতনাম কোন পথে এগোচ্ছে দেখতে অসুবিধা কোথায়? বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তিনি বাংলাদেশে সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতান্ত্রিক মডেল প্রয়োগের পদক্ষেপ নেননি। কিন্তু ইতিহাস তো সাক্ষ্য দিচ্ছে, তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন।
উন্নয়ন নীতিতে তিনি প্রথম অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন শিক্ষাখাতকে। ১৯৭২-৭৩ অর্থ-বছরে তাঁর সরকারের প্রথম বাজেটে সরকারি ব্যয়বরাদ্দের ২১.৪ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছিল শিক্ষাখাতের জন্যে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সংকটাপন্ন অর্থনীতির জন্য ওটা ছিল অভাবনীয়। কিন্তু ঐ পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি জাতিকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, একটি জনবহুল দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি ধারণ করছে শিক্ষা। তখনকার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সুশিক্ষিত করতে পারলেই অনুন্নয়ন থেকে মুক্তি মিলবে, ওটাই ছিল ম্যাসেজ। বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষার জন্য এত বেশি অনুপাতের বাজেট বরাদ্দ আর কখনোই পাওয়া যায়নি।
তিনি প্রাইমারি স্কুলগুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন, প্রাইমারি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৭(ক) ধারায় সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র সকল শিশুর জন্য একটি একক মানসম্পন্ন, গণমুখী, সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত চালু করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে’। তাঁর শাসনামলে একটি ক্যাডেট কলেজও প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, বরং তাঁর আমলে প্রণীত কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল, দেশের ক্যাডেট কলেজগুলোকে এবং মাদরাসাগুলোকে পর্যায়ক্রমে শিক্ষার মূলধারার সাথে সমন্বিত করা হবে।
অথচ ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরিক হয়ে গত চার দশকে আমরা শিক্ষার বাজারীকরণ ও পণ্যকরণের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছি, প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা মহাসুখে বাজারের হাতে সোপর্দ করে চলেছি। শিক্ষা আজ এ দেশে বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে, যেখানে ধনাঢ্য মা-বাবার সন্তানদের জন্য প্রাথমিক লেভেল থেকে উচ্চতম শিক্ষার পর্যায়ে মহার্ঘ্য পণ্য হিসেবে উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষা বিক্রয়ের হাজার হাজার মুনাফালোভী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাবৃদ্ধি নাটকীয় গতিতে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুকে এগার ধরনের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার জালে আটকে ফেলার এহেন নৈরাজ্যকর বন্দোবস্তের নজির বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পিতামাতার বিত্তের নিক্তিতে ওজন করে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কে কিন্ডারগার্টেনে যাবে, কে সরকারি বা বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে সুযোগ পাবে, কার এনজিও স্কুলে ঠাঁই হবে, আর কাকে এবতেদায়ী মাদরাসায় পাঠিয়ে বাবা-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে যে ‘লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে’ ভাতটা তো অন্তত জুটলো! এর অপর পিঠে দেশে ইংরেজি মাধ্যম কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যাবৃদ্ধিকেও নাটকীয় বলা চলে। মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পিতামাতারা তাঁদের সন্তানদের জন্য এখন আর বাংলা মাধ্যম প্রাইমারি স্কুলগুলোকে উপযুক্ত মানসম্পন্ন মনে করছেন না, কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোটাই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষায়ও চারটি ধারার সমান্তরাল অবস্থান এখন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। ইংরেজি মাধ্যমের নানান কিসিমের মহার্ঘ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মূলধারার বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুল-কলেজ, বাংলা মাধ্যম বেসরকারি স্কুল-কলেজ এবং কয়েক ধরনের মাদরাসা। উচ্চশিক্ষার স্তরে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। এই বিভাজিত ও বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এক দেশের মধ্যে চারটি পৃথক জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে চলেছি।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে গৃহীত বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে উন্নয়ন কৌশলসমূহ অনুসরণের অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছিল, সেগুলোকে তো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী খোন্দকার মোশতাক এবং ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান পরিত্যাগ করেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐ প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা দলিলের মতো অতো সুচিন্তিত ও সুলিখিত পরিকল্পনা দলিল এরপর আর কি রচিত হয়েছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কি সময় হয়েছে ঐ পরিকল্পনা দলিলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার?
নব্বই দশকের প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ তখনকার ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরিক হয়ে দলের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠাকে বেছে নিয়েছিল। ঐ সময় সারা বিশে^ ওটাই ফ্যাশন ছিল। কিন্তু এখন যখন মুক্তবাজার অর্থনীতির মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ‘বাজার মৌলবাদী পুঁজিবাদের’ জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে তখনো ঐ পুঁজিবাদী পথকে এখনো আঁকড়ে থাকা কতখানি যৌক্তিক? খোন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়া এদেশে যে ধরনের ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ চালু করে গেছেন গত বারো বছরেও সেখান থেকে সরে আসার তেমন জোরালো প্রয়াস নেননি শেখ হাসিনা। কিন্তু কেন? তবে কি তাঁর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে যে, দেশের উপরোল্লেখিত শাসকদের অর্থনৈতিক নীতির কারণে বাংলাদেশ এখন ক্রমাগতভাবে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করে চলেছে? ভুল, মারাত্মক ভুল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যে গতিশীলতা অর্জন করেছে, তার প্রধান ডাইমেনশনগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করলে বোঝা যাবে এই সাফল্য ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ কারণে নয়। প্রধান প্রধান সাফল্যের ক্ষেত্রগুলো দেখুন: ১) কৃষিখাতে চলমান বিপ্লব, ২) এক কোটি কুড়ি লাখ অভিবাসীর প্রেরিত বিপুল রেমিট্যান্স প্রবাহ, ৩) তৈরি পোশাক শিল্পের চমকপ্রদ বিকাশের কারণে ক্রমবর্ধমান রফতানি আয় ও অন্যান্য রফতানি পণ্যের বর্ধিত রফতানি আয়, ৪) ক্ষুদ্রঋণের দ্রæত বিকাশ, ৫) অর্থনীতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দ্রæত প্রসার এবং ৬) অর্থনীতিতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি।
১) বাংলাদেশের চলমান কৃষি বিপ্লব আমাদেরকে কী দিয়েছে দেখুন: জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্তে¡ও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন, ২০১৯ সালে তা সোয়া তিন গুণেরও বেশি বেড়ে তিন কোটি বাষট্টি লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০১৯ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল চার কোটি তের লাখ টন। সত্তর লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এক কোটি পাঁচ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারী উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ চতুর্থ। হাঁস-মুরগী ও ডিম উৎপাদনে আমরা এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমনকি, গরু-ছাগল এবং ফল উৎপাদনেও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছি আমরা। আমাদের কৃষি ব্যবস্থা কি পুঁজিবাদী? এই সাফল্য তো প্রধানত কিষাণ উৎপাদন পদ্ধতি অবলম্বনেই অর্জিত হয়েছে, যেখানে শেখ হাসিনার সরকার কৃষিবান্ধব ও কৃষকবান্ধব নীতিগ্রহণের মাধ্যমে বিপ্লবকে বেগবান করে চলেছে।
২) বাংলাদেশের এক কোটি কুড়ি লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। (গণনা-বহির্ভূত আরো অনেক অভিবাসী বিদেশে কাজ করছেন বলে ধারণা করা হয়)। দেশে কর্মসংস্থানের চরম অভাবের কারণে জীবন-জীবিকার সন্ধানে মরিয়া হয়ে জায়গা-জমি বিক্রয় করে লক্ষ লক্ষ টাকা ‘আদম বেপারীদের’ খাই মিটিয়ে এসব অভিবাসীর ৯০-৯৫ শতাংশ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁদের এই বিদেশগমনের জন্য মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন তাদের সর্বস্ব দিয়ে হয়তো সহায়তা করেছেন। অতএব, নিয়মিতভাবে বিদেশে অর্জিত আয়ের ৫০-৭৫ শতাংশ এই অভিবাসীরা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্যে। সেজন্যই প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদিও কম দক্ষ শ্রমজীবী তবুও গত চার দশক ধরে প্রতি বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েই চলেছে এবং ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি সত্তে¡ও নিয়মানুগ মাধ্যমে বা প্রাতিষ্ঠানিক পথে (ভড়ৎসধষ পযধহহবষং) রেমিট্যান্স প্রবাহ কুড়ি বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। (বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হুন্ডির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেশ বড়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হয়তো এর পরিমাণ দাঁড়াত ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০২০ সালে হুন্ডি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় ঐ বছর রেমিট্যান্স বেড়েছে ২১ শতাংশেরও বেশি)। এই রেমিট্যান্স প্রবাহের জন্যে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ কৃতিত্ব কোথায়?
৩) বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ মুক্তবাজার অর্থনীতির অবদান নয়, ‘মাল্টি ফাইবার এরেঞ্জমেন্ট’ ও জিএসপি নামের কোটা ব্যবস্থার ফায়দা নিয়েই সস্তা শ্রমের কারণে এদেশে এই শিল্পটি বিকশিত হয়েছে। ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা এজন্য প্রধান কৃতিত্ব পাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। তবুও বলব, পুঁজিবাদের শ্রম শোষণের (ংঁঢ়বৎ বীঢ়ষড়রঃধঃরড়হ) ক্লাসিক নজির হলেও দেশের দ্রæত বিকাশমান পোশাক শিল্পে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর এই শ্রমিকদের বৃহদাংশই নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাঁদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতেই হবে, তৈরি পোশাক শিল্পখাত বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে।
৪) ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের জীবন ও জীবিকাকে এই ক্ষুদ্র ঋণ বেশ খানিকটা সহজ করে দিয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শুধু ক্ষুদ্র ঋণকে এদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিস্টেম কর্তৃক লালিত দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার যথার্থ প্রতিষেধক বিবেচনা করা সমীচীন নয়। কিন্তু দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠিগুলোর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার এই সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।
৫) ডিজিটাল বাংলাদেশ শেখ হাসিনার সরকারের আরেকটি চমকপ্রদ সাফল্য। কিন্তু এর জন্য ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ কীভাবে কৃতিত্ব দাবি করবে?
৬) বাংলাদেশের জাতীয় সঞ্চয় হার ৩১ শতাংশে পৌঁছে গেছে, কিন্তু ব্যাংকের আমানতের ৫৮ ভাগ ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের অবদান। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ব্যাংকে আমানতের ঢল অব্যাহত রাখছে। ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা বরং ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’ হিসেবে ব্যাংকঋণ লুটপাট করছে এবং ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।
তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আকুল আবেদন, ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’কে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের রাজনীতি থেকে সরে আসুন। আয়বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্যবৃদ্ধিকারী ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ আঁকড়ে থাকা মোটেই সঙ্গত ও সমীচীন নয়।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।