Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

এক বৈশ্বিক চীনা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানার পিছনে রহস্য নিয়ে প্রশ্ন-২

প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : (গত সংখ্যার পর)
এ কোম্পানি আগামী বছর হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে তার জীবন বীমার ব্যবসায়ের শেয়ার বিক্রির জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে অবস্থায় ব্যাপক পরীক্ষার আওতায় আসতে পারে। ইতোমধ্যে নিউইয়র্কভিত্তিক কমপক্ষে একটি বিনিয়োগ ব্যাংক আনবাংয়ের বৈদেশিক লেনদেনে সাহায্য করবে কি না তা মূল্যায়নের জন্য তার শেয়ার হোল্ডিং কাঠামো পরীক্ষা করার পর এর মালিকানা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলে এ বিষয়ের সাথে জড়িত দু’ব্যক্তি তাদের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কারণ প্রক্রিয়াটি বেসরকারি। ব্যাংক আনবাংয়ের কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করেনি।
আলাদাভাবে চীনা সাময়িকী কেইজিন মে মাসে খবর প্রকাশ করে যে চীনা নিয়ন্ত্রণকারীরা আনবাংয়ের ঝুঁকিমূলক সামগ্রী পরীক্ষা করছেন। এ তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে এবং আনবাংয়ের মালিকানা কাঠামো তদন্ত করা হচ্ছে কিনা তা পরিষ্কার নয়। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঘুষের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন। সাদা দস্তানাদের ব্যবহার করার বিষয়ও সম্প্রতি তদন্তের আওতায় এসেছে। গত বছর কম্যুনিস্ট পার্টির শৃঙ্খলা নজরদারি শাখা এক রিপোর্টে বলে, সাদা দস্তানাধারীরা ক্ষমতার কালো হাতের সঙ্গী।
চীনা কোম্পানিগুলো যখন বিশ্বব্যাপী কারবার করছে, কখনো কখনো চীনের ক্ষমতাশালীদের দেশের বাইরে টাকা পাচারের উদ্যোগের প্রতিনিধিত্ব করেছে যখন অর্থনীতি মন্থরগতি হয়েছে ও পার্টি দৈনন্দিন জীবনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে।
চীন তার বিনিয়োগ নৈপুণ্যের উন্নয়নে ও নিজ প্রভাবের বিস্তার ঘটাতে কিছু পুঁজি বাইরে পাচারে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু অভিজাতদের দেশের বাইরে টাকা পাঠানো রাজনৈতিক ভাবে স্পর্শকাতর , তা তাদের সম্পদের উৎস সম্পর্কে ও চীনা অর্থনীতিতে তাদের আস্থা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
চীনা সামরিক বাহিনীর এক সাবেক চিফ অব স্টাফের পুত্র লুয়ো ইউ বলেন, চীনের সবচেয়ে রাজনৈতিক শক্তিশালী পরিবারগুলো কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে টাকা স্থানান্তর করছে। চীনা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল লুয়ো বলেন, তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকবে বলে বিশ্বাস করে না, তারা মনে করে শিগগিরই হোক আর বিলম্বে হোক তাদের পতন হবেই। তাই তারা তাদের টাকা সরিয়ে ফেলে। তার ছোটভাই আনবাংয়ের অন্যতম এক প্রতিষ্ঠাতার ব্যবসায়িক অংশীদার।
২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর আনবাংয়ের পরিচালকদের তালিকায় আকর্ষণীয় রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন। রেকর্ডে দেখা যায় যে আনবাংয়ের পরিচালকদের মধ্যে এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র লেভিন ঝু এবং চীনে কম্যুনিস্ট শাসন আনায় সাহায্যকারী এক সেনাবাহিনী মার্শালের পুত্র চেন জিয়াওলু রয়েছেন।
তারপর আসে উ-র কথা। তার জন্মনাম হচ্ছে উ গুয়াংহুই, কিন্তু তরুণ বয়স থেকে তিনি উ জিয়াওহুই নামে পরিচিত। আত্মীয়রা জানান, তিনি একটি ক্যাথলিক পরিবারে বড় হন। উ চীনা নেতা দেং জিয়াও পেং-এর নাতনি ঝুয়ো রানকে বিবাহ করেন। কোম্পানি নথি থেকে দেখা যায়, উ, ঝুয়ো ও চেন এবং তাদের আত্মীয়রা সে সব কোম্পানির মালিক বা পরিচালক যেগুলো আনবাং নিয়ন্ত্রণ করে। গত বছর ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া ক্রয় ও স্টারউড চেইন কেনার ব্যর্থ চেষ্টার মাধ্যমে আনবাং বিশ্বমঞ্চে নিজেকে স্থাপন করে। এ বছর নাগাদ আনবাংয়ের সম্পদ ২৯৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
বৈদেশিক সম্পদে কী কারণে আনবাংয়ের হঠাৎ আগ্রহ সৃষ্টি হল তা স্পষ্ট নয়। তবে তার মালিকানা কাঠামোতে পুনর্বিন্যাস ঘটার পরই এ উদ্যোগ দেখা যায়, যার ফলে কোম্পানিতে সাড়ে ৭শ’ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ ঘটে।
চীনা সংস্থাগুলোর কাছে দাখিল করা কাগজপত্রে দেখা যায়, আনবারের শেয়ার ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০১৪ সালে ৬ মাসের মধ্যে ৮ থেকে একলাফে ৩৯-এ পৌঁছে। এ সব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবাই বিপুল পরিমাণ তহবিল পেয়েছে। একই সময়ে আনবাংয়ের পুঁজি ৫ গুণ বেড়েছে।
এ বছরের শেষ নাগাদ মালিকানা রেকর্ড থেকে ঝু’র নাম অদৃশ্য হয়। উ-র আত্মীয়রা যথারীতি রয়ে যান। তার আগে রেকর্ড থেকে উ ও চেন-এর নাম মুছে যায়।
ঝু, যার নামে কোনো শেয়ার নেই বলে মনে হয়, ২০০৯ সাল নাগাদ আনবার-এর পরিচালকদের রোস্টার থেকে তার নাম অদৃশ্য হয় যদিও ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ অনলাইন সরকারি নথিপত্রে তিনি পরিচালক হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন।
উ, চেন ও ঝ কে মন্তব্য করতে অনুরোধ জানালে তারা সাড়া দেননি। ঝুয়োর সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। মার্চে ঝু জানান যে তিনি আনবারের পরিচালক নন।
আনবাংয়ের বর্তমান শেয়ারহোল্ডিং প্রতিষ্ঠানগুলো চীনে পরিচিত নয়। এর মধ্যে কয়েকটির যেন শুধু আনবাংয়ের শেয়ার কেনার জন্যই জন্ম হয়েছে। একটি তালিকায় এর ঠিকানা হিসেবে বেইজিংয়ের একটি ধুলোময় অফিস ভবনের ২৭তম তলা বলা হয়েছে। দুটি তালিকায় ডাক-ঠিকানা রয়েছে বেইজিংয়ের একটি ডাকঘরের উপরতলা।
কর্পোরেট ফাইল ব্যবহার করে দি টাইমস প্রায় ১শ’ লোকের ঠিকানা সংকলন করেছে যাদের এসব প্রতিষ্ঠানে শেয়ার রয়েছে এবং তাদের এক ডজনের ঠিকানা পিংইয়াং কাউন্টি বা তার কাছাকাছি। সাংবাদিকরা চীনের পূর্বঞ্চলীয় ঝেজিয়াং প্রদেশের সে এলাকায় যান ও তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের কয়েকজনসহ কয়েক ডজন বাসিন্দার সাক্ষাৎকার নেন। তারা উ-র এক চাচা, এক চাচি ও ভ্রাতুষ্পুত্রেরও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
এলাকার অন্যরাসহ পরের দু’জন বলেন, একটি নাম তার বোন উ জিয়াওজিয়ার সাথে মিলে। পরিবারের সদস্যরা বলেন, আরো কয়েকটি নাম উ-র দুই জ্ঞাতি ভ্রাতা, অন্য ক’জন তার মাতুল কুলের দিকেরসহ বর্ধিত আত্মীয়দের সাথে মিলে যায়। আনবাং শেয়ার হোল্ডিং কোম্পানিতে শেয়ারের পরিমাণে ভিন্নতা থাকলেও এসব লোক যে পরিমাণ শেয়ারের মালিক তার সম্পদের পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
অন্যানের মধ্যে রয়েছেন এক স্থানীয় ব্যবসায়ী হুয়াং মোশেংসহ উ-র স্থানীয় পরিচিত ব্যক্তিগণ। মোশেং এক সংক্ষিপ্ত টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বলেন, উ-র সাথে তার ব্যবসার সম্পর্ক আছে, তবে তিনি বিশদ জানাতে অস্বীকার করেন।
গ্রামের এক মোড়ল ও প্রতিবেশীরা হুয়াংয়ের চার আত্মীয়ের নাম সনাক্ত করেন যাদের কয়েকজনকে তারা সাধারণ শ্রমিক বলে বর্ণনা করেন যারা ঐ তালিকাভুক্ত। আনবাং হোল্ডিংয়ে তাদের শেয়ারের সম্পদের পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার।
আরেক অধিবাসী মেই জিয়াওজিং বলেন, তালিকার দু’জনের নাম তার আত্মীয়দের নামের সাথে মিলে। উ-কে চেনেন কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, হ্যাঁ। তারপর তিনি ফোন বন্ধ করে দেন। তাকে ফোনে আর পাওয়া যায়নি। বহু হোল্ডিং কোম্পানির মধ্যে তাদের আনবাং সম্পদের পরিমাণ ১৯ বিলিয়ন ডলার।
আনবাং যত উন্নতি করেছে, উ-র খ্যাতি তত বেড়েছে। ২০১৩ সালে উ এশিয়া সেন্টার অব হার্ভার্ড-এ বছরব্যাপী ভিজিটিং ফেলোর অবস্থান নিশ্চিত করেন। হার্ভার্ডের যোগসূত্রে তিনি রাজনৈতিক ভাবে সংযুক্ত চীনা ধনকুবেরদের ক্রমবর্ধমান তালিকায় যুক্ত হন।
দেং জিয়াও পিং-এর জীবনী লেখক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরিটাস এজরা এফ ভোগেল বলেন, তিনি কয়েকবার উ-র সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি বলেন, তার রয়েছে চৌকস কিছু কর্মচারী যারা তার জন্য কাজ করে। মনে হয়, তারা বিশদ কাজ করছে, তার তিনি হচ্ছেন বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ যিনি যোগসূত্র সরবরাহ করেন। সূত্র দি নিউইয়র্ক টাইমস। (সমাপ্ত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এক বৈশ্বিক চীনা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানার পিছনে রহস্য নিয়ে প্রশ্ন-২
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ