Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চুলা জ্বলে না, রাজধানীজুড়েই গ্যাসের আকাল

প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৯ পিএম, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : গ্যাস নেই, চুলা জ্বলে না। রাজধানীজুড়েই চলছে গ্যাসের আকাল। এ নিয়ে লালবাগের বাসিন্দা মুতাহার হোসেনের ক্ষোভÑ বিলতো পুরোটাই পরিশোধ করি; অথচ গ্যাস থাকে না দিনের অর্ধেক সময়জুড়ে। বিলের ক্ষেত্রে কেন এমন হয় না যে, যতটুকু গ্যাস; সেই পরিমাণ বিল।
মিরপুর পল্লবীর এক গৃহিণীর ক্ষোভ হচ্ছেÑ আগে শীত মৌসুমে গ্যাস থাকত না। এখন সময়-অসময় বলে কিছু নেই। গ্যাস না থাকাটাই রেওয়াজেই পরিণত হয়েছে। এর পেছনে তিতাসের অন্য কোন কারণ রয়েছে কীনা তাই বা কে জানে?
গ্যাস নিয়ে এই হাহাকার শুধু রাজধানীবাসীরই নয়; দেশজুড়েই গ্যাসের এই সঙ্কট। ঢাকা ও এর আশপাশে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, ধামরাই, কালিয়াকৈরে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের অনেকেই হোটেল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। গ্যাসের এই দূরাবস্থা এসব এলাকার শিল্পাঞ্চলেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট আরও বেশি। গ্যাস সঙ্কটকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাঝে মধ্যেই মিছিল হয়। ঢাকায় এলাকাভেদে সকাল থেকে দুপুর এমনকি বিকাল পর্যন্ত গ্যাসের দেখা মেলে না। সন্ধ্যার পর গ্যাস আসে এবং রাত গভীর হলে গ্যাসের প্রেসার বাড়ে।
গ্যাস সঙ্কটের কারণে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় অকস্মাৎ বেড়ে গেছে। এসব পরিবারকে প্রতিদিন অন্তত এক বেলার খাবার হোটেল থেকে কিনে আনতে হচ্ছে চড়া দামে। এতে করে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে গৃহিণীরা। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানায়, গ্যাসের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম হওয়ায় এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তবে গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেকেই কেরোসিন, কাঠের চুলা, রাইস কুকার ও ইনডাকশন ওভেনে রান্না করছেন। পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকাই এখন গ্যাস সঙ্কটের কবলে। এসব এলাকায় গ্যাস সঙ্কট চলছে বেশ কিছু দিন যাবত।
শীতকালে গ্যাসের সঙ্কট দেখা দিলেও এই সময়ে কেন এমন দূরাবস্থা- এ ব্যাপারে জ্বালানি বিভাগ জানায়, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের উৎপাদন কম। গৃহস্থালী, সার-কারখানা এবং সিএনজি থেকে শুরু করে বেশ কিছু শিল্প-কারখানার গ্যাস কমিয়ে বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এতে করে এসব খাতে সঙ্কট চলছে। তবে পেট্রোবাংলা জানায়, গ্যাস সঙ্কটের বড় একটি কারণ অবৈধ সংযোগ।
আবাসিক খাতে গ্যাসের সঙ্কট দেখা দেয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ গৃহিণীরা। রান্নার গ্যাস না পাওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইব্রাহিমপুরের বাসিন্দা ঝরনা বেগম। তার বাসায় সকাল থেকে বিকাল ২টা এবং সন্ধ্যা রাত ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এতে করে তার পরিবারের সদস্যদের দুই বেলার খাবার হোটেল থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। এমন দুর্ভোগের কারণে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান।
পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা আকলিমা হোসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সকাল ৭টার মধ্যে তাকে বের হতে হয় কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে তার পরিবারের সদস্যরা সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার বৈদ্যুতিক চুল্লিতে রান্না করছে। রাতে গ্যাস আসে ৯টার পর। তখন রাতের খাবার গ্যাসের চুলায় রান্না হয়।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শিখা রানী বলেন, আমাদের এলাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্যাসের চুলা জ্বলে না। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, গভীর রাতে পরদিনের রান্না করে রাখতে হয়। এটা অসহনীয়। দুর্ভোগ কমাতে তিনি কখনো বৈদ্যুতিক চুলায় আবার কখনো কেরোসিনের চুলা ব্যবহার করছেন।
গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- রামপুরা, বনশ্রী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী ও পুরানো ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় গ্যাস সংকট ছিল সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকার অনেক স্থানে সকালেই গ্যাস উধাও। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। এছাড়া পশ্চিম ও পূর্ব দোলাইরপাড় মতিঝিলের কিছু অংশসহ পূর্বাঞ্চলীয় অনেক এলাকায় চলছে গ্যাসের টানা সংকট। এতে করে কয়েক হাজার পরিবার দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিশেষ করে সকাল ৭টার পর গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। বিকালেও অনেক এলাকায় চুলা জ্বলে না। এসব এলাকার সমস্যার জন্য অবৈধ গ্যাস সংযোগকে দায়ী করেছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির পরিচালক (উৎপাদন) মশিউর রহমান সমস্যার বিষয় স্বীকার করে বলেন, ১৮শ’ থেকে প্রায় ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে সার্বোচ্চ ১৪শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। এই ঘাটতির কারণে আবাসিকখাতে গ্যাসের সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার মতে, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশনগুলো যখন বন্ধ থাকে, তখন স্থানীয় আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের সমস্যা হয় না। কিন্তু সিএনজি স্টেশন চালু হলেই আবাসিক খাতে গ্যাসের প্রেসার কমে যায়। তখন এই সমস্যা দেখা দেয়। তিনি গ্যাস সঙ্কটের জন্য অবৈধ গ্যাস সংযোগকে দায়ী করে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ পাইপলাইন বসানোর সময় এলাকার একটি হিসাব অনুযায়ী পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু যত্রতত্র অবৈধ সংযোগের কারণে সরবরাহ লাইন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়েই গ্যাসের এই সঙ্কট।
গ্যাসের অবৈধ সঙ্কট প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলা জানায়, বর্তমানে অবৈধ গ্রাহকের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই এসব গ্রাহকরা অবৈধভাবে শিল্প ও আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ নিয়েছে এবং ব্যবহারও করছে।
অ্যাক্ট আছে, প্রয়োগ নেই
অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা বিষয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর অভিমত হচ্ছে, গ্যাস অ্যাক্ট থাকলেও তা কাজে আসছে না। স্থায়ীভাবে তাদের সংস্থায় কোনো ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় এ সংক্রান্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের কাছে বার বার চিঠি লেখার পরেও সাড়া মিলছে না। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অনেক সময় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে পাওয়া যায় না। হুমকির মুখে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করেই কোনো কোনো সময় টাস্কফোর্সকে অভিযান গুটিয়ে ফিরে আসতে হয়।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাসিক সংযোগ রয়েছে- তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির। সেখানে মোট বৈধ আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এরপর কর্ণফুলী এবং বাখরাবাদ কোম্পানির অবস্থান। স্বাভাবিকভাবে তিতাস, কর্ণফুলী ও বাখরাবাদেই অবৈধ সংযোগের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে কোন কোন এলাকায় কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ সেটা চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, আবাসিকখাতে গ্যাস সংযোগ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার কথা ভাবছে সরকার। তিনি বলেন, আমাদের গ্যাসের আধার ফুরিয়ে আসছে। চাহিদার তুলনায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে কম। এ অবস্থায় তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস-এলপিজি ব্যবহার বাড়াতে হবে। এলপিজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলপিজি ব্যবহার শুরু হলে চাহিদা মোতাবেক অবশ্যই সরবরাহ করা যাবে।
অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে? জানতে চাইলে নসরুল হামিদ বলেন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সঙ্কট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণেই এমনটি হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চুলা জ্বলে না
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ