পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের ও হাসান সোহেল : দক্ষিণের মানুষগুলো যখন মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে ফেরি অথবা লঞ্চে পদ্মা পার হন তখন পদ্মা সেতুর বিশাল কর্মকা- দেখে তারা স্বপ্নে ভাসেন। নিজের অজান্তেই ‘টাইম মেশিনের’ সাহায্যে চলে যান ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। নিজেকে দেখতে পান দ্বিতল পদ্মা সেতুর নিচের অংশ দিয়ে ছুটে যাওয়া ট্রেনের জানালার পাশে, যে সেতুর উপরের অংশে চলাচল করছে মাল ও যাত্রী বোঝাই যানবাহন। এই মানুষগুলো জানে, তাদের এই স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে ব্যবধান মাত্র দুই বছর তিন মাসের। আর তারা এটাও ভালো করে জানে, এই সেতু শুধু তাদের স্বপ্নের নয়, মর্যাদারও। কারণ, পুরো বিশ্বের অসহযোগিতার পরও এই সেতু বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। নিজস্ব অর্থায়নে বৃহৎ এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, “বাংলাদেশের বয়স আসলে আঠারো, যে বয়স মাথা নোয়াবার নয়”।
প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে এই সেতু নির্মাণ করে কি লাভ হবে বাংলাদেশের? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। পাল্টে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কৃষিতে উন্নত। এই সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের শীর্ষ প্রকৌশলী প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতে, কোনো বিনিয়োগের আদর্শ ‘রেট অব রিটার্ন’ হলো ১২ শতাংশ। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য-সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুইপাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বর্তমান সরকারের। এ বিষয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সে জন্য এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে। এই সেতু ঘিরে কী কী হতে পারে, কোথায় শিল্প-কারখানা হবে, কোথায় কৃষিজমি হবেÑ সেসব এখনই বিবেচনা করা উচিত।
পদ্মার পারে প্রশাসনিক রাজধানী করার প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন প্রফেসর জামিলুর রেজা। তিনি বলেন, এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
“স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ”Ñ বলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান জামিলুর রেজা, যিনি যমুনা সেতু প্রকল্পেরও বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। “সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠবে।”
নিজস্ব অর্থায়নে এমন একটি সেতু নির্মাণ করতে যাওয়ার কাজটি সহজ ছিল না বাংলাদেশের জন্য।
১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালে সেতুটির পূর্ব সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাবত্য যাচাই হয়। ২০০৪ সালে জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়। নতুন নকশায় নিচে চলবে রেল এবং ওপরে মোটরগাড়ি।
দ্বিতল সেতু করার কারণ সম্পর্কে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, আমরা ভবিষ্যতের কথা ভেবেছি। এ পথটি ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেনগুলো।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশ যখন উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা চায় তখন সবার আগে সহায়তার অঙ্গীকার করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। প্রকল্পে মূল অর্থযোগানদাতা হতে চায় বিশ্বব্যাংক। জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও এগিয়ে আসে।
কেন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে চলে গেল? এ প্রসঙ্গে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, মূল সেতুর নির্মাণ কাজের তদারকি কে করবেÑ এ জন্য প্রস্তাব চাওয়া হয়। চীনা একটি প্রতিষ্ঠানকে আমরা অযোগ্য মনে করি। তারা অন্য একটি সেতুর কাজ তাদের বলে চালিয়েছিল। এরপরেই পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই ঘুষের অভিযোগ ওঠে। কয়েকজন জেলে গেলেন। একজন মন্ত্রী পদ হারালেন। বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের অঙ্গীকার থেকে সরে গেল। এ ধরনের কাজের শর্ত অনুযায়ী মূল ঋণদাতা চলে গেলে অন্যরাও চলে যায়। কাজেই একে একে এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও চলে গেল।
“বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য হিসেবে বলতে পারি কোনো অনিয়ম হয়নি”, বলেন জামিলুর রেজা।
উন্নয়ন সহযোগীরা চলে যাওয়ার পরে দক্ষিণের মানুষ যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তা নিভে গেল।
এর পরে বেশ কিছুদিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে বাংলাদেশ। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ‘কঠিন’ সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ঘোষণা দেন, নিজস্ব অর্থায়নেই হবে ‘স্বপ্নের’ পদ্মা সেতু।
এই ঘোষণার পরেই আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে দক্ষিণের মানুষ। না! এবার আর স্বপ্ন নয়। ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যেই চোখের সামনে ধীরে ধীরে রূপ নিতে শুরু করে পদ্মা সেতু। এ বহু অপেক্ষা আর সাধনার সেতু। এ আমাদের মর্যাদার সেতু। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের কাজ ৩৩ ভাগ শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে, তা এখন অনেকটাই নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যেই মূল সেতুর ২২ শতাংশ, নদী শাসনে ১৬ শতাংশ, এ্যাপ্রোচ সড়কের ৬০ শতাংশসহ সব মিলিয়ে গড়ে সেতুটির প্রায় ৩৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, কাজের মান ও অগ্রগতি সন্তোষজনক। সব কিছুই চলছে পরিকল্পনা মাফিক। যেভাবে কাজ এগুচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতু জনগণের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব হবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পদ্মা সেতু আমাদের সম্মানের সেতু। আমাদের চোর অপবাদ দেয়া হয়েছিল। আমরা বীরের জাতি, এটা প্রমাণ করেছি।
“সেতু যখন চালু হবে, শেখ হাসিনা যখন খুলে দেবেন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে, তখন এই এলাকার জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থাই বদলে যাবে। এ এলাকার একটা মানুষও গরীব থাকবে না।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।