Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুগম করবে মর্যাদা-বাণিজ্য

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে : আহসান এইচ মনসুর বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে ভুল হবে : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিনিয়োগ-বাণিজ্যে মিলবে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

সকল শর্ত পূরণ করে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ। গত ৫০ বছরে একমাত্র দেশ হিসেবে জাতিসংঘের তিন শর্তই পূরণ করায় বাংলাদেশ পাচ্ছে এ মর্যাদার স্বীকৃতি। গত শুক্রবার রাতে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা ইউএন-সিডিপি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, কোন দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদন্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ দ্বিতীয় বারের মতো মানদন্ডগুলো অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এখন থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে মর্যাদা নিয়ে চলবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় জাতির এমন অর্জনে উচ্ছ্বসিত সব মহল। এ স্বীকৃতিকে দেশের সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী কিংবা অর্থনীতিবিদ, সবাই বিশেষ অর্জন বা মাইলফলক হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা একধাপ বাড়লো, যা বৈদেশিক বিনিয়োগ পাওয়ার পথকে আরও সুগম করবে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, বিভিন্ন পণ্যে আমদানি শুল্ক আরোপসহ আরও কিছু সুযোগ ধীরে ধীরে ছেড়ে দিতে হবে। এছাড়া এই উত্তরণের ফলে বেশ কিছু সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রহিত হয়ে যাবে; অন্যদিকে এর সুবিধাগুলো কাজের মাধ্যমে অর্জন করে নিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে জোর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, বাণিজ্য ও রাজনীতিতে আসবে পরিবর্তন, বাড়বে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও।

যদিও, প্রস্তুতির জন্য হাতে থাকা পাঁচটি বছর কাজে লাগাতে সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার বলেও মনে করেন তারা। একই সঙ্গে অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়াতে সরকারকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মূলত, ২০১৮ সালে জাতিসংঘের নীতিমালা অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আগামী ৫ বছর অগ্রগতি ধরে রাখতে পারলে ২০২৬ সালেই স্থায়ীভাবে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি মিলবে।

সূত্র মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট ৭৫ দশমিক ৩ কিন্তু উন্নয়নশীল হতে প্রয়োজন ছিল আরো কম- ৬৬। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের বাংলাদেশের অর্জন ২৫ দশমিক ২ পয়েন্ট। বলা যায় সব মানদন্ডে গতিশীল বাংলাদেশ। আর এসব পর্যালোচনা শেষে ইউএন-সিডিপির সভায় বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণের চ‚ড়ান্ত সুপারিশ আসে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবের বিষয়। এটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার সফল বাস্তবায়ন। একই সঙ্গে এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ যে অভ‚তপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে তারই স্বীকৃতি।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এখন দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। তখন আমদানি শুল্ক কমানোসহ উচ্চমাত্রার সংরক্ষণমূলক নীতি পাল্টাতে হবে সরকারকে। তেমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে ব্যবসায়ীদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে।

নীতিগত ক্ষেত্রে পরিবর্তনের বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বলেন, যতটা সম্ভব কম্পিটিটিভনেস বাড়াতে হবে। আমাদের এক্সেঞ্জ রেট ইস্যু আছে, পোর্ট ইস্যু আছে, পরিবহন ইস্যু আছে- এগুলোকে এড্রেস করতে হবে। রফতানি বাড়াতে হলে সেই পরিবেশ, মার্কেট এক্সেস সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের।

এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেছেন, বাংলাদেশের অনন্য গর্বের প্রাপ্তি স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ। এর মাধ্যমে মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে নতুন সুবিধা মিলবে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ার পাশাপাশি দেশে নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, এ অর্জন দেশ হিসেবে আমাদের মর্যাদা বাড়িয়েছে এবং বিশ্বের কাছে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে যা বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, এখনই চিন্তা করতে হবে আঞ্চলিক বাণিজ্য কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়। বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সক্ষমতা বা বাজার কিভাবে ধরে রাখা যায়।

পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, আমরা দু’বছর সময় পেয়েছি, পারতোপক্ষে ৩ বছরের মধ্যে হয়ে যেত। এখন আমাদের যেটা করতে হবে, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো, শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো, টেকনোলজি বাড়ানো।

তিনি বলেন, আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা সেটার একটা আন্তর্জাতিক মানদন্ডে একটা স্বীকৃতি হলো। গত ৫০ বছরে এলডিসি থেকে স্থায়ীভাবে বের হতে পেরেছে মালদ্বীপসহ মাত্র পাঁচটি দেশ। এবার যেখানে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ আনন্দঘন মুহুর্তে এমন সুখবর সম্মানজনক। তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশকেই বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০২৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপসহ বেশ কিছু দেশে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাবে, তবে এলডিসি হতে উত্তরণের পর বাংলাদেশকে আইপিআর এবং ট্রিপস চুক্তির আওতায় শর্তাবলী ও শিল্পের কমপ্লায়েন্সের মেনে চলার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। একই সঙ্গে মধ্যম আয়ের দেশে হিসেবে রফতানি বাজারে অন্যান্য মধ্যম আয়ের দেশের সাথে প্রতিযোগীতার মুখোমুখি হতে হবে। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলো থেকে প্রাপ্ত অগ্রাধিকার ও বিশেষ সুবিধা কমে আসবে, রফতানির বাজারে সম প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি হ্রাস পাবে এবং ছোট ছোট স্থানীয় শিল্পে সহায়তা কমে আসতে পারে।

রিজওয়ান রাহমান বলেন, রফতানিমুখী উৎপাদন খাতের এসব চ্যালেঞ্জ থাকা স্বত্বেও এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ আমাদের উৎপাদন খাতেও নতুন সম্ভাবনার তৈরি হবে। স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা মিলবে, ক্রেডিট রেটিং-এ উন্নতি হবে, বেসরকারি খাত আরো প্রতিযোগী হতে পারবে, উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং কমপ্লায়েস ইস্যুতে বাংলাদেশের দক্ষতা আরও বাড়ানোর সুযোগ হবে।

ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, এ অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য সংলাপে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে পারবে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষনে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ও আগ্রহ বাড়াতে সক্ষম হবো।

তবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশের রফতানি আয় ১০ শতাংশ কমতে পারে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আর এতে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রফতানি আয় কমবে। বর্তমান বাজার দরে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও যদি বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে ভুল হবে। বিশেষ সুবিধাকে বাড়তি পাওনা হিসেবে দেখতে হবে। তবে দেশের অভ্যন্তরে সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। এ জন্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তিনটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এগুলো হলো, ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে পরিবেশ সৃষ্টি করা, কর আহরণ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এ ছাড়া এলডিসি থেকে মসৃণ উত্তরণের জন্য একটি উত্তরণকালীন কৌশলপত্র তৈরির সুপারিশও করেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।#



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুগম করবে মর্যাদা-বাণিজ্য
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ