Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যেভাবে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় এবং এক্ষেত্রে ভাষার ‍গুরুত্ব

মোহাম্মদ আবদুল অদুদ | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১০:০৩ এএম

আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আপনারা জেনে থাকবেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় সাহাবিদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের শুভসূচনা হয়। তাঁরা বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে চীনে যাওয়ার পথে বাংলাদেশে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। তাদের মাধ্যমে এ দেশে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের দাওয়াত।

উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে আসে ইসলাম। আর উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে শুরু হয় যাত্রা। বিভিন্ন গবেষণা ও প্রাপ্ত শিলালিপি এমন দাবিই জোরালো করেছে। এতে আরও দেখা যায়, ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে দেশের প্রথম মসজিদটিও নির্মিত হয় এই জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের ‘মজেদের আড়া’ নামক গ্রামে। এটির নাম সাহাবায়ে কেরাম জামে মসজিদ। ১৯৮৭ সালে পঞ্চগ্রামে জঙ্গল খননের সময় প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এর একটি ইটে কালেমা তাইয়্যেবা ও ৬৯ হিজরি লেখা রয়েছে। এ থেকে অনুমান করা হয়, মসজিদটি হিজরি ৬৯ অর্থাৎ ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে স্থাপন কিংবা সংস্কার করা হয়। রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মামা, মা আমেনার চাচাতো ভাই আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৬২০ থেকে ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন (পৃ. ১২৬)। অনেকে অনুমান করেন, পঞ্চগ্রামের মসজিদটিও তিনি নির্মাণ করেন যা ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কার করা হয়। মতিউর রহমান বসুনিয়া রচিত ‘রংপুরে দ্বীনি দাওয়াত’ গ্রন্থেও এই মসজিদের বিশদ বিবরণ আছে। ‘দেশে ইসলাম প্রচার করেন ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন খিলজী’ এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত থাকলেও এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, এর অনেক আগেই এদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন খিলজীর বাংলা বিজয়ের প্রায় ৬০০ বছর আগেই সাহাবীদের দ্বারা বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব হয়। প্রথম মসজিদও নির্মিত হয় সেই সময়েই।

‘জাতীয় অধ্যাপক’ দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের মতে, হজরত ওমরের (রা.) শাসনামলে মামুন, মুহাইমেন (রা.) নামক সাহাবিদ্বয় বাংলাদেশে আগমন করেন। অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ৬১৭ খৃস্টাব্দে সাহাবী হজরত আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের (রা.) চীনে আগমনই এ কথার পক্ষে জোরালো প্রমাণ বহন করে। সাহাবী হজরত কাসেম ইবনে হুজাইফা (রা.), উরওয়া ইবনে আসাসা (রা.), আবু কায়েস ইবনুল হারিসও (রা.) এ সফরে তার সঙ্গী ছিলেন। চীনে যাবার পথে তারা বাংলাদেশের বন্দর বিশেষত চট্টগ্রাম ও সিলেট নোঙ্গর করেছেন এবং তাদের সান্নিধ্যে এসে এদেশের কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এখান থেকেই বাংলাদেশ ইসলামের যাত্রা। প্রাক ইসলামি যুগেই আরব বণিকরা সমুদ্র পথে আবিসিনিয়া ও চীন পর্যন্ত তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেন। আরব-চীনের মধ্যে তাদের কয়েকটিঘাঁটিও ছিলো। এ পথে তাদের প্রথম ঘাঁটি ছিলো মালাবর। তারা নিয়মিত মালাবরের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কামরূপ হয়ে চীনে আসা যাওয়া করতেন। এভাবেই চট্টগ্রাম ও সিলেট তাদের যাতায়াতের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হত। মূলত এ সূত্র ধরেই নাম নাজানা আরো বহু সাহাবী দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তির্ণ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে ইসলাম প্রচারে কাজ করেছেন। চীনের ক্যন্টনসমুদ্র তীরবর্তী হজরত আবু ওয়াক্কাসের (রা.) মাজার আজও সেই সাক্ষ্য বহন করে আছে। সমুদ্র তীরের কোয়াংটা মসজিদও তিনিই নির্মাণ করেন বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের চাঞ্চল্যকর যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সব রকমের সন্দেহ ও সংশয়ের অবসানতো ঘটেছেই উন্মোচিত হয়েছে ইতিহাসের নতুন দিগন্ত। লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের বড়বাড়িতে রামদাস মৌজার, মসতারপাড় নামক স্থানে ৬৯ হিজরিতে (আনুমানিক ৬৯২ খ্রি.) নির্মিত একটি মসজিদ পাওয়া গেছে। এই মসতারপাড় স্থানটি বহুকাল ধরে কয়েকটি উঁচু মাটির টিলা ও জঙ্গল দ্বারা আবৃত ছিল। যার স্থানীয় নাম ‘মজদের আড়া’। ১৯৮৭ সালে জমির মালিক তা আবাদযোগ্য করার চিন্তা করে জঙ্গল পরিস্কার করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রাচীনকালের তৈরি ইট, যাতে আঁকা ছিল ফুল। আর মাটি ও ইট সরাতে সরাতে আশ্চর্যজনকভাবে পূর্ণ একটি মসজিদের ভিত খুঁজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়, যার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে আরবিতে লেখা আছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি ৬৯ সাল।’ খননের পর মসজিদের মেহরাব এবং মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও খুতবার মিম্বরও আবিষ্কৃত হয়। এলাকার লোকজন এ মসজিদটির নাম দিয়েছেন ‘হারানো মসজিদ’। তাই নিশ্চিত বলা যায়, আরব থেকে আগত মুসলমান বা স্থানীয় মুসলমান- যারা ৬৯ হিজরিতে এ এলাকায় বসবাস করেছিলেন তারাই নিজেদের ধর্মীয় প্রয়োজনে মসজিদও তৈরি করেছিলেন। সেই থেকে বা তার আরো আগে থেকেই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের কাজ আরম্ভ হয়।

রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধবিহার খননকালে দুটি আরবীমুদ্রা পাওয়াযায়। এই মুদ্রা দুটি তৈরী হয়েছিল ৭৮৮ খৃস্টাব্দে অর্থাৎ আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশীদের আমলে। ইতিহাসবিদ ড. এনামুল হকের মতে, কোন ইসলাম প্রচারক এই মুদ্রাগুলো বহন করেছিলেন। পাহাড়পুরে আসার পর বৌদ্ধদের হাতে তিনি শহীদ হন। কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে খননকালে আব্বাসীয় যুগের আরও দু’টি স্বর্ণমুদ্র পাওয়া যায়। এসব মুদ্রা এ কথাই প্রমাণ করে, খৃস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে এদেশে আরব মুসলমানদের মাধ্যমে ইসলামের চর্চা ও প্রচারের কাজ চালু ছিল।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে তারা বাংলাভাষাকে ব্যবহার করেছিলেন। নইলে এ অঞ্চলের মানুষ বুঝতো না। মানুষকে আল্লাহ স্বয়ং ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর আল্লাহ তাঁকে সৃষ্টির সবকিছুর নাম শিক্ষা দেন। এ শিক্ষা প্রাপ্তির মাধ্যমে হজরত আদম (আ.) ভাষা সম্পর্কে অবহিত হন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি রসুলদের তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি, যাতে স্পষ্টভাবে তাদের বোঝাতে পারে।’ সুরা ইবরাহিম আয়াত ৪ । ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর কুদরত। আল্লাহ তায়ালাকে যে কোনো ভাষায় ডাকা যায়। যে কোনো ভাষায় তাঁর রহমত কামনা করা যায়। বুখারি শরীফের হাদিসে রয়েছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ সব ভাষা জানেন।’ আল্লাহর এ কুদরতের কথা আল কোরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘তাঁর আরও একটি নিদর্শন হলো আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাব প্রকাশের ভাষা ও বর্ণের সৌন্দর্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ সুরা রুম আয়াত ২২।

ভাষা প্রতিটি জাতির নিজস্ব সম্পদ। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিটি জাতির জন্য উপহারবিশেষ। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাঁর ওপর কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছিল। তাঁর মাতৃভাষার প্রতি এটি ছিল মহান আল্লাহর সম্মান। আল্লাহর রসুল নিজেই বলেছেন, তিনি তিনটি কারণে আরবি ভাষাকে ভালোবাসতেন। প্রথমত কোরআনের ভাষা আরবি, দ্বিতীয়ত জান্নাতের ভাষা আরবি, তৃতীয়ত তাঁর মাতৃভাষা আরবি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ সব নবী-রসুল যেহেতু তাঁদের মাতৃভাষাকে ভালোবাসতেন সেহেতু মাতৃভাষাকে ভালোবাসা নবী-রসুলদের সুন্নত। মুসলমান হিসেবে আমাদেরও উচিত মাতৃভাষাকে ভালোবাসা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। অন্যসব ভাষার মতো এ ভাষাও আল্লাহর দান। আল্লাহর বিশেষ রহমত।



 

Show all comments
  • এস, এম জালাল উদ্দিন ৯ আগস্ট, ২০২২, ৭:৫৪ পিএম says : 0
    আমি তথ্যগুলি জেনে মুগ্ধ।আলহামদুলিল্লাহ
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ দুলাল মিয়া ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ২:৩২ পিএম says : 0
    আল্লাহুআকবর।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ কবির খান ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১১:৪১ পিএম says : 0
    চমৎকার তথ্য, ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ আশরাফুল ইসলাম ২২ ডিসেম্বর, ২০২২, ১১:১৪ পিএম says : 0
    সত্যি ইসলামের ইতিহাস পড়তে কতইনা ভালো লাগে,
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ আশরাফুল ইসলাম ২২ ডিসেম্বর, ২০২২, ১১:১৪ পিএম says : 0
    সত্যি ইসলামের ইতিহাস পড়তে কতইনা ভালো লাগে,
    Total Reply(0) Reply
  • মো জসিম উদ্দিন ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১:৪৩ পিএম says : 0
    আলহামদুল্লিল্লাহ অনেক পুরানো ইতিহাস পড়ে ভালো লাগলো ????????
    Total Reply(0) Reply
  • মো জসিম উদ্দিন ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১:৪৩ পিএম says : 0
    আলহামদুল্লিল্লাহ অনেক পুরানো ইতিহাস পড়ে ভালো লাগলো ????????
    Total Reply(0) Reply
  • মো জসিম উদ্দিন ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১:৪৩ পিএম says : 0
    আলহামদুল্লিল্লাহ অনেক পুরানো ইতিহাস পড়ে ভালো লাগলো ????????
    Total Reply(0) Reply
  • মো জসিম উদ্দিন ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১:৪৩ পিএম says : 0
    আলহামদুল্লিল্লাহ অনেক পুরানো ইতিহাস পড়ে ভালো লাগলো ????????
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ