Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তদন্তে দায়ী ২ কর্মকর্তার শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশ

প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চরম অব্যবস্থাপনায় সার কারখানার ট্যাঙ্কে বিস্ফোরণ
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চরম অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়ের অভাব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফেলতিতেই কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরের আনোয়ারায় ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি-১) সার কারখানার ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এজন্য কারখানাটির দুই কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। গতকাল (বুধবার) জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন সাংবাদিকদের তদন্ত কমিটির ওই প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তদন্ত প্রতিবেদনে কারখানার উপ-প্রধান প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) দিলীপ কুমার বড়ুয়া এবং জিএম (ম্যানটেনেন্স) নকিবুল ইসলাম তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেনি বলে উঠে এসেছে। তদন্ত কমিটি এ দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে বিভাগীয় শাস্তিরও সুপারিশ করেছে। একই সাথে তাদের পারিতোষিক থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
৫০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ট্যাংকটিতে ৩৪০ মেট্রিক টন গ্যাস ছিল বলে উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যামোনিয়া ট্যাংকটি নিরাপত্তার জন্য পাঁচ ধরনের সুরক্ষা যন্ত্র ছিল। যার সবগুলোই ছিল অকেজো। প্রতিবেদনে ড্যাপের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও আন্ত:বিভাগীয় সমন্বয় সাধন, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাসহ পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
গত ২২ আগস্ট রাতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী আনোয়ারা উপজেলার কর্ণফুলী থানার ড্যাপ সার কারখানায় ৫০০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া ধারণক্ষমতার একটি ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয়ে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাসের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন আনোয়ারা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কয়েকশ’ মানুষ। আশপাশের ঘেরের মাছ মরার পাশাপাশি গাছের পাতাও বিবর্ণ হয়ে যায়। অ্যামোনিয়া মিশে জলাশয়ের পানির রংও পাল্টে যায়। এলাকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়।
গ্যাস ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণের ঘটনার দিন রাতে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশিদকে প্রধান ধরে কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন আনোয়ারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা গৌতম বাড়ৈ, কর্ণফুলী থানার ওসি রফিকুল ইসলাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্ক ( জ-৯০৩ ) বিস্ফোরিত হয় এবং রক্ষিত অ্যামোনিয়া বাতাস, মাটি এবং পানিতে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
দুর্ঘটনার বর্ণনা
পিডিবি কর্তৃক বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় ২০ আগস্ট থেকে ড্যাপ-১ কারখানাটি বন্ধ ছিল। কারখানা বন্ধ থাকা অবস্থায় ২২ আগস্ট রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় ৫০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন প্লান্টসংলগ্ন অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্কটি নিচের দিক থেকে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে ট্যাঙ্কের নিচের দিক থেকে বেরিয়ে আসা অ্যামোনিয়ার চাপে ট্যাঙ্কটি পাইপ র‌্যাকের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আনুমানিক ২০ ফুট দূরে ভূপাতিত হয়। ভূপাতিত ট্যাঙ্কটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই বিস্ফোরণে ট্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত পাইপলাইনসমূহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণকালীন ট্যাংকে রক্ষিত ৩৪০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া ট্যাংকের বেস-ডাইকে পতিত হয়। ফলে ব্যাপক পরিমাণে অ্যামোনিয়া বাতাসে মিশ্রিত হওয়ার আগেই বেস-ডাইকে পড়ে থাকার ফলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীগণ পানি ছিটিয়ে উক্ত অ্যামোনিয়া দ্রবীভূত করে ফেলে। ফলে উক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস বাতাসে মিশ্রিত হতে না পারায় ব্যাপক জান-মালের ক্ষতি হতে রক্ষা পায়।
দুর্ঘটনাকালীন বায়ুপ্রবাহ কর্ণফুলী নদী অভিমুখে হওয়ায় বাতাসে মিশ্রিত গ্যাস পতেঙ্গা, বিমানবন্দর ও হালিশহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং জনমনে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। গ্যাস বিস্ফোরণের পরপরই ফ্যাক্টরিতে অবস্থানরত প্রায় ৪৭ জন লোক অসুস্থ হয় যার অধিকাংশই আনসার সদস্য। ঘটনার সময় কারখানার অধিকাংশ কর্মী অনুপস্থিত থাকায় আহতদের মাঝে তাদের সংখ্যা কম। ফায়ার ফাইটিং ইউনিটসমূহের ব্যাপক তৎপরতার ফলে দুর্ঘটনার পর কমসংখ্যক মানুষ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।
দুর্ঘটনার কারণ
অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্কটির নিরাপত্তার জন্য ০৫ ধরনের সুরক্ষা যন্ত্র রয়েছে। দুর্ঘটনার সময় তার সবগুলোই অকেজো ছিল। ট্যাঙ্কের তাপমাত্রা কমানোর জন্য ট্যাংকের কুলিং/রেফ্রিজারেশন কম্প্রেসার সিস্টেম ৩ বছরের অধিক সময় ধরে নষ্ট ছিল। ট্যাঙ্কে রক্ষিত গ্যাসের চাপ মাপার জন্য দুটি প্রেসার গজ রয়েছে যা দীর্ঘদিন যাবৎ নষ্ট ছিল। ট্যাঙ্কের তাপ ও চাপ মাপার জন্য স্বয়ংক্রিয় ডি সি এস সিস্টেম রয়েছে। এই সিস্টেমে ২টি প্রেসার ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ট্যাংকের গ্যাসের চাপ ২টি কম্পিউটারে প্রদর্শিত হয়। যার একটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট ছিল এবং অপরটি দুর্ঘটনার পূর্বদিন নষ্ট হয়ে যায়। ট্যাঙ্কে রক্ষিত অতিরিক্ত গ্যাসের চাপ বের করে দেয়ার জন্য ২টি প্রেসার ভেন্ট রয়েছে। দুর্ঘটনার সময় সে দুটি বন্ধ ছিল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ট্যাংকে এশটি ফ্লেয়ার সিস্টেম রয়েছে। দুর্ঘটনার সময় সেটিও অকেজো ছিল।
অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্কে বর্ণিত সকল নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি নষ্ট ও বন্ধ থাকায় ৫০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ট্যাঙ্কটিতে ৩৪০ মেট্রিক টন তরল অ্যামোনিয়া থাকার পরও মাত্রাতিরিক্ত গাসের চাপে ট্যাঙ্কটির নিচের অংশে বেজপ্লেট বরাবর বিস্ফোরণ ঘটে এবং নির্গত গ্যাসের চাপে ট্যাংকটি উড়ে গিয়ে প্রায় বিশ ফুট দূরে ভূপাতিত হয় এবং সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার পর প্লান্ট পরিচালনার সাথে ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দিতে দেখা যায়, বাস্তবে যারা কারখানা পরিচালনা করতেন এবং ট্যাঙ্কটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন তারা প্রায় সকলেই অপারেটর এবং তাদের এই কারখানা পরিচালনায় এবং নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই।
তদন্ত কমিটি মনে করে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ কোম্পানিতে অবস্থিত অপারেশন, মেইন্টেনেন্স, অ্যাডমিন, সিভিল, একাউন্টস ও কমার্শিয়াল সেকশনগুলোর মাঝে সমন্বয়ের অভাব। দুর্ঘটনার পূর্বে অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্কের সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেলে মেইন্টেনেন্স বিভাগকে তা জানানো হলেও তারা কার্যকরী কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এমনকি এই বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জিএম নকিবুল ইসলাম ও উপ-প্রধান প্রকৌশলী দিলীপ কুমার বড়ুয়া প্লান্টটি পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।
এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সহ: প্রকৌশলী সাইদ হাসান, দুলাল কান্তি দেবনাথ (এসএমএ) ও মো: ইকবাল হোসেন (এমও) তাদের জবানবন্দিতে জানান, তারা এই প্লান্টে পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও এই প্লান্ট বিষয়ে তাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তদন্ত কমিটিকে দেয়া জবানবন্দি অনুযায়ী এটি প্রতীয়মান হয়েছে যে, এই অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্কটি যে বিস্ফোরিত হতে পারে এমন ধারণাও তাদের নেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ব্যতিরেকে ড্যাপ- কর্তৃপক্ষ এরূপ জনবল দিয়ে প্লান্ট পরিচালনা করায় তদন্ত কমিটি বিস্ময় প্রকাশ করে। কাজী মাসুদুর রহমান (নি:প্র:বিদ্যুৎ) নিজেদের কাজে গাফিলতি ঢাকতে প্লান্টের নির্মাণ দুর্বল ছিল বলে উল্লেখ করেন। ট্যাঙ্কের সকল নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি নষ্ট রেখে নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য ট্যাঙ্কের নির্মাণ ত্রুটির কথাই তারা উল্লেখ করছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনার ২দিন আগে থেকে প্লান্টটি বন্ধ ছিল। দুর্ঘটনার দিনে ৫০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ট্যাঙ্কে গাস মজুদ ছিল ৩৪০ মেট্রিক টন। এই অবস্থায় ট্যাঙ্কটি বিস্ফোরিত হওয়ার কথা নয়। দুর্ঘটনার সময় ট্যাঙ্কের ৫টি নিরাপত্তা সিস্টেমের সবক’টি অকেজো ছিল। বিষয়টি মেইনটেনেন্স বিভাগকে জানানোর পরও তারা যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিশেষত: দিলীপ কুমার বড়ুয়া, উপ-প্রধান প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) এবং জি এম নকিবুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে যে জবানবন্দি দিয়েছেন তা রীতিমত তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব অস্বীকার করার সামিল। এই দুই কর্মকর্তা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে এই দুর্ঘটনা থেকে প্লান্টটি রক্ষা করা সম্ভব হতো। সাক্ষ্য, প্রমাণ, লিখিত জবানবন্দি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যালোচনায় তদন্ত কমিটি মনে করে এই দুই কর্মকর্তা এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের মনোভাব দৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, এই দুই কর্মকর্তা স্বপদে বহাল থাকলে এই প্লান্টটি কারো জন্য নিরাপদ নয়। তদন্ত কমিটি তাদের প্রত্যাহারপূর্বক বিভাগীয় শাস্তি ও তাদের আনুতোষিক হতে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশ করেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তদন্তে দায়ী ২ কর্মকর্তার শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ