Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মার্কিন ড্রোন হামলায় ঊর্ধ্বতন নেতা আদনানি নিহত

প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আইএসের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা
ইনকিলাব ডেস্ক : ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ঊর্ধ্বতন নেতা আবু মুহাম্মদ আল আদনানি নিহত হয়েছেন। উত্তর সিরিয়ায় তিনি নিহত হন বলে মঙ্গলবার আইএস জানায়।
এক অনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে আইএস বলে, আদনানি আলেপ্পো প্রদেশে গ্রুপের সামরিক অভিযান পরিদর্শনে গেলে নিহত হন। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রদেশের উত্তরাংশে তুর্কি সীমান্তের কাছে আইএস সাম্প্রতিককালে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। আমরা তুরস্ক, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার শিকার। স্থলেও কয়েক দিক থেকে হামলার সম্মুখীন। যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কসমর্থিত সিরীয় বিদ্রোহী এবং যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত কুর্দি মিলিশিয়ারা আমাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
ওয়াশিংটনে পেন্টাগনের মুখপাত্র পিটার কুক নিশ্চিত করেন, সোমবার দিবাগত রাতে সিরিয়ার আল বাব-এর কাছে আদনানিকে লক্ষ করে মার্কিন প্রিসিশন বোমা ফেলা হয়। তবে তিনি তার মৃত্যু নিশ্চিত করেননি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা এ হামলার ফলাফল মূল্যায়ন করছি।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দু’জন আমেরিকান কর্মকর্তা বলেন, আদনানি যে গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন, একটি মার্কিন ড্রোন থেকে তার ওপর বোমা ফেলা হয়। সিআইএ ও স্পেশাল অপারেশনস ফোর্স তার গতিবিধি সম্পর্কে তীক্ষè নজর রাখছিল।
৩৯ বছর বয়স্ক আদনানি ছিলেন আইএসের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি ছিলেন আইএসের প্রধান মুখপাত্র ও প্রচারবিদ। তিনি আইএসের পৃথিবীকাঁপানো নিষ্ঠুর কাজ শিরñেদ ও গণহত্যার ভিডিওগুলো তৈরির কর্মকা- পরিচালনা করতেন। তাছাড়া নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ করে তাদের সিরিয়ায় আইএসের সাথে যোগ দিতে পাঠাতেন।
আইএসের আটক ব্যক্তিরাও গ্রুপের কর্মকা-ে আদনানির ভূমিকার কথা জানিয়েছে। তিনি গ্রুপের বৈদেশিক কর্মকা- তত্ত্বাবধান করতেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে যোদ্ধা সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন এবং তাদের সংগঠিত করে প্যারিস, ব্রাসেলসসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালান।
সাম্প্রতিক সময়ে ইরাক ও সিরিয়ায় এলাকা হারানোর প্রেক্ষিতে আদনানির মৃত্যু আইএসের জন্য আরেকটি গুরুতর বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সন্ত্রাসী নেতাদের হত্যার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে, কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের হামলা সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে নির্মূল করতে সত্যই কার্যকর কিনা।
বিশেষ করে ইসলামিক স্টেটের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা হামলার মুখে সর্বোচ্চ নমনীয়তা অবলম্বন করতে সক্ষম হয়েছে।
র‌্যান্ড কর্পোরেশনে সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ সেথ জি. জোন্স বলেন, আদনানির মৃত্যুতে আইএসের একজন গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও কার্যক্রম পরিচালনা নেতার প্রস্থান ঘটল, তবে তা শুধু ব্যক্তি হিসেবে। যদিও তার জায়গা পূরণ সম্ভব নয় বলে ধারণা, আইএস অন্য নেতাকে তার স্থানে বসাবে যেমন তারা অন্যদের ক্ষেত্রে করেছে।
আদনানি অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় প্রায়ই তার মৃত্যু ও আহত হওয়া নিয়ে গুজব শোনা যেত। যেমন গত জানুয়ারিতে ইরাকি কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন যে ইরাকের আনবার প্রদেশে এক বিমান হামলায় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। কিন্তু শিগগিরই এ খবর মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইএসের জন্য আদনানির মতো গুরুত্বের একজন নেতা সম্পর্কে তাদের সরকারি চ্যানেলে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা একেবারেই অসম্ভব মনে হয়।
তার মৃত্যু আইএসের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে একটি রকমের ধাক্কা বলে গণ্য হবে। গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি আমেরিকার সামরিক ও সন্ত্রাস দমন বাহিনীর নজরে ছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর তার জন্য ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আইএসের আটক ব্যক্তিরা বলেন, আইএসের বৈদেশিক কার্যক্রম ইউনিট ছিল গ্রুপের ভিতর একটি পৃথক শাখা। তার কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ শাখা আদনানির কাছে জবাবদিহি করত। তিনি শুধু খলিফা আবু বকর আল বাগদাদির কাছে রিপোর্ট করতেন। বিশ্লেষকরা বলেন, আদনানিকে বাগদাদির স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
আইএস ইরাক ও সিরিয়ায় এখনো কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বেসামরিক লোক ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর নিয়মত হামলা চালায়। আদনানির ইউনিটের দায়িত্ব ছিল বিদেশে হামলা চালানো। এ ইউনিট তাদের যোদ্ধাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ প্রদান, নগদ টাকা প্রদান ও অস্ত্র সরবরাহ করত।
তাদের হামলার প্রধান লক্ষ্য ইউরোপ। এ বছর নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, আইএসের বৈদেশিক হামলায় তুরস্ক, মিসর, তিউনিসিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৬৫০ জন লোক নিহত হয়েছে।
২০১৪ ও ২০১৫-তে আইএস বিপয়য়ের সম্মুখীন হতে শুরু করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আদনানির বৈদেশিক হামলা অব্যাহত থাকে।
মে মাসে আদনানি আমেরিকার উদ্দেশে বলেন, তোমরা কি মনে কর যে শহর ও এলাকার পতন দিয়ে পরাজয় নির্ধারিত হয়? ইরাকে যখন আমরা শহর হারিয়েছি ও কোনো শহর ও এলাকা ছাড়াই মরুভূমিতে পশ্চাদপসরণ করেছি তখন কি আমরা পরাজিত হয়েছি? না। মনোবল ও লড়াইয়ের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলা হচ্ছে পরাজয়।
আইএসের কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পশ্চিমা স্বার্থে হামলা চালাতে ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুযোগ বুঝে সরাসরি হামলায় অনুপ্রাণিত করা। ২০১৪ সালে আদনানি পশ্চিমা মুসলমানদের যেখানে ও যেভাবে সম্ভব পাশ্চাত্যের উপর হামলা চালাতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বিদেশী সরকারগুলোর প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আমরা তোমাদের মাতৃভূমিতে হামলা করব। তিনি ইউরোপীয়দের, বিশেষ করে তার ভাষায় হিংসুক ও নোংরা ফরাসিদের হত্যা করার জন্য মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানান।
সে বছর আইএস প্রায় দু’ডজন হামলার পরিকল্পনা করে। কতক ক্ষেত্রে হামলার সাথে সিরিয়ার সরাসরি কোনো সংযোগ ছিল না। তবে সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় যে হামলাকারীরা অনলাইনে আইএসের প্রচার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
আইএসের বৈদেশিক হামলা বিষয়ে গ্রন্থ রচনায় নিয়োজিত সন্ত্রাসবাদ গবেষণা ও বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান ক্রোনোজ এডভাইজরির মাইকেল এস স্মিথ দ্বিতীয় বলেন, গত দশকে পাশ্চাত্যে সহিংসতা সংঘটন ও উস্কানির ক্ষেত্রে আল-আদনানির মতো আর কোনো জিহাদি নেতা নিষ্ঠাবান ও কার্যকর প্রমাণিত হননি।
আইএসের মুখপাত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পরিচালক হিসেবে তার মিশ্র ভূমিকা ছিল গ্রুপের কেন্দ্রীয় কৌশলেরই প্রতিফলন।
আদনানির প্রকৃত নাম ছিল তাহা সোবহি ফালাহা। তিনি সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশের বিনিশ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
বিনিশের এক অধিবাসী নাজদাত হাজ কাদুরের মা ছিলেন আদনানির দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তিনি বলেন, আদনানির পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। আদনানির ভাইরা কাদুরের দাদির বাগানে কাজ করত। তারা জলপাই গাছে পানি সেচ করত। আদনানি ছিলেন আইএসের পূর্বসূরি সংগঠন আল কায়েদা ইন ইরাকের জীবিত ও সক্রিয় মুষ্টিমেয় কয়েকজন সদস্যের অন্যতম। আমেরিকার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ইরাকিদের প্রতিরোধ লড়াই থেকে গ্রুপটি জন্ম নেয় এবং আবু মুসা আল জারকাবির নেতৃত্বে তৎপরতা শুরু করে। সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে তখন বিদেশী, সিরীয় ও অন্যান্য যোদ্ধাদের আমেরিকানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইরাকে যাবার সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। ইরাকে লড়াইকারী বিদেশী যোদ্ধাদের মধ্যে আদনানিও ছিলেন একজন।
আদনানি আল কায়েদা ইন ইরাক প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি দক্ষিণ ইরাকের আমেরিকান বন্দীশালা ক্যাম্প বাক্কায় আটক ছিলেন।
২০১১ সালে সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে তাকে আবার বিনিশ শহরে দেখা যায়। তারা আল কায়েদার সিরিয়া শাখা নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। আল কায়েদা থেকে পরে ইসলমিক স্টেট আত্মপ্রকাশ করে ও নিজস্ব খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে। তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা। সূত্র দি নিউইয়র্ক টাইমস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মার্কিন ড্রোন হামলায় ঊর্ধ্বতন নেতা আদনানি নিহত
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ