Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দখল-উচ্ছেদ খেলা

অভিযানের পর খবর রাখে না ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন

ইয়াছিন রানা/ মো. জাহিদুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৪ এএম

রাজধানী ঢাকার অলিতে-গলিতে, পথে-ঘাটে, গণপরিবহনে কিংবা চায়ের দোকানের আড্ডায় বহুল ব্যবহৃত দু’টি শব্দ হলো- উচ্ছেদ ও দখল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মোট আয়তন তিনশ’ কিলোমিটারের কিছুটা বেশি। এরমধ্যে উত্তরের ১৯৬.২২ কি.মি. ও দক্ষিণের ১০৯.২৫ কি.মি.। দুই সিটির মানচিত্র একসাথে দেখলে তা না হবে বর্গাকৃতির, না হবে ত্রিভুজাকৃতির। কেমন যেন একটু এলোমেলো গড়নের। তবে নগরীর মানুষজনের কথায় সিটির ৩৬০ ডিগ্রিতে সাজানো যায় দুই সিটিকে। শহরকে সুন্দর করতে অবৈধভাবে দখল করা রাস্তা, খাল, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন। তবে উচ্ছেদের পর আবারও শুরু হয় দখল। কারণ একবার উচ্ছেদ করে উদাসীন হয়ে পড়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ যেন বৃত্তাকার এক বিন্দুতে উচ্ছেদ-দখল খেলা। তবে কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে ভিন্নতা। দখলের পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সচেতনতায় পুনরায় দখল হয়নি সে জায়গা।

রাজধানী ঢাকাকে বসবাসযোগ্য সুন্দর নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এজন্য অবৈধভাবে দখল করা রাস্তা, খাল, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে সংস্থা দুটি। কিন্তু উচ্ছেদের পর কিছু কিছু জায়গা আবারও দখলদাররা দখল করে নিচ্ছে। ফলে উচ্ছেদের সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মিরপুর-১১ তে বিহারি ক্যাম্পে উচ্ছেদের পর উচ্ছেদ হওয়া জায়গা দখলে রেখেছে বিহারিরা। তাদের বিল্ডিং ভেঙে দেয়ার পর খোলা আকাশের নিচেই পলিথিন ও চাদর দিয়ে ঘরের স্থান দখল রেখেছে। এর মধ্যে খাট দিয়ে রাতে ঘুমাও তারা। যাদের দোকান ভেঙে দেয়া হয়েছে সেই জায়গাতে চৌকি বসিয়ে মালের পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করছে। যাতে দোকানের স্থানটি তাদের দখলে থাকে।
উচ্ছেদের পর আবারও দখল হয়ে গেছে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের কার পার্কিং এর জায়গা। কিছুদিন আগে ফুটপাতের দোকান উচ্ছেদ করার পর তা আবারও দখল হয়ে গেছে। এছাড়া বিমানবন্দর রেললাইন থেকে হজ ক্যাম্প পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশ হকারদের দখলে।

জুরাইন রেললাইনের দুই পাশে কিছুদিন আগে উচ্ছেদ করা হলেও তাতে অস্থায়ীভাবে দোকান বানিয়ে আবারও দখল করা হয়েছে। জুরাইন থেকে গেন্ডারিয়া স্টেশন পর্যন্ত একই অবস্থা। একই চিত্র রাজধানীর হাতিরপুল বাজারেরও। ফুটপাত থেকে দোকান উচ্ছেদ করা হলেও বর্তমানে ফুটপাতের বাইরের রাস্তাও দখল করে ব্যবসা করছে হকাররা। গুলিস্তানের রাস্তায় বারবার হকারদের উচ্ছেদ করা হলেও দখলমুক্ত হয়না অদৃশ্য কারণে।

উচ্ছেদের পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মনিটরিং না থাকার কারণে ফের দখল হয়ে যায় সেই জায়গা। রাজধানীতে উচ্ছেদের পর দখলের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, প্রথমে দখলমুক্ত জায়গা অস্থায়ীভাবে দখল করা হয়, পরবর্তীতে রূপ নেয় স্থায়ী দখলে। ফুটপাত দখলের অভিনব কায়দা হচ্ছে ভ্যান ও টুকরিতে মালামাল নিয়ে দোকানদারি করা। দোকানদারি শেষ করে ভ্যান বা টুকরি নিয়ে স্থান ত্যাগ করে হকাররা। পরদিন আবার দোকান করে। এক্ষেত্রে তাদের সুবিধা হল, প্রশাসন ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদে আসলে ভ্যান বা টুকরি নিয়ে পালিয়ে যায় হকাররা। এতে মালামালের ক্ষয়ক্ষতি হয় না। প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে আবারও ফুটপাতে ব্যবসা করতে চলে আসে।

রাজধানীর পল্লবীতে জানুয়ারি মাসে টানা তিনদিনের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখের সেই অভিযানে প্রায় পাঁচ শতাধিক দোকানপাট ও অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করে ডিএনসিসি। তবে সময় গড়াতেই পুনরায় দখল হতে থাকে উচ্ছেদকৃত জায়গা। সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রাস্তার যে দুইপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রাস্তা সম্প্রসারণ করা হয়েছিল কয়েকদিনের ব্যবধানেই সেখানে পুনরায় গড়ে উঠেছে খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী ঘর। জায়গায় জায়গায় চা-সিগারেটের দোকান, জুতা, কাপড়, গৃহস্থালীর বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পসরা, মোবাইলের খুচরা যন্ত্রাংশসহ নানা ধরনের অস্থায়ী অবকাঠামো। উচ্ছেদকৃত হাজী বিরিয়ানীর দোকানটি পুরো গুঁড়িয়ে দিলেও মাথার ওপর একটি সামিয়ানা ও চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে চলছে বিরিয়ানি বিক্রির ঢল। তবে তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে বিধায় পাঞ্জাবি, শাড়ি ও লুঙ্গির বিক্রি সবচেয়ে বেশি।
৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের পাশের জায়গাও দখল হয়ে গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় কাউন্সিলর আবদুর রউফ নান্নু বলেন, মেয়র সাহেব যদি আমাকে পুলিশ দেয় এবং বলে তুমি তোমার মতো কাজ করো, কোন ঝামেলা থাকলে আমি আছি। কেউ যদি আমাকে সহযোগিতা না করে তাহলে আমিতো ঝুলে থাকব। মেয়রের কাছে কোনো সহযোগিতা চেয়েছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেয়রের কাছে সহযোগিতা চাইছি। বলছি, আমাকে দশ প্লাটুন পুলিশ দেন। আপনার লোকও থাকবে। এত বড় অর্ডার দেয়া বা কাজ করা তো আমার এখতিয়ার নেই। আমাকে পুলিশ দিলে দিবে দুইটা। এতো প্লাটুন পুলিশ তো দিবে না।

উত্তর সিটির অভিযানের পরও কেন উচ্ছেদকৃত জায়গা পুনরায় দখল হয়ে যাচ্ছে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, দখল যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তা আবার উচ্ছেদ করব। উচ্ছেদকৃত জায়গা পুনরায় দখলের সুযোগ নেই। এছাড়া নগরবাসীর সুবিধার কথা মাথায় রেখেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমাদের নগরবাসীর সুবিধার জন্য আমরা এ কাজগুলো করি।

তবে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, প্রতিদিনই বাড়ছে দখলের পরিমাণ। পূর্বের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তারা আরও জানিয়েছেন, প্রথমে বসানো হয় অস্থায়ী দোকান, পরে স্থায়ী নজরদারী না থাকায় তা চলে যায় স্থায়ী দখলে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, সিটি করপোরেশনের কাউকে উচ্ছেদের পর আমরা আর দেখিনি।
উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার সময় ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, জনগণের চলাচল নির্বিঘ্ব করতে উচ্ছেদ পরবর্তী রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ করা হবে। ফুটপাতের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে এখানে (পল্লবী) সর্বোচ্চ ৭৫ ফুট এবং সর্বনিম্ন ৬০ ফুট চওড়া রাস্তা করা হবে। উচ্ছেদ অভিযানে কেউ বাধা দিলে তা প্রতিহত করা হবে। রাস্তার ওপরে যেসব বৈদ্যুতিক খুঁটি আছে তা সরিয়ে নেওয়ার জন্য ডেসকোর সাথে কথা হয়েছে। আমরা একটি পরিকল্পিত নগরী তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছি।

অবৈধভাবে পুনরায় দখল নেয়া দোকানদারদের কাছে এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, তারা নিজেদের উদ্যোগেই পুনরায় তুলছেন অস্থায়ী দোকান। দোকান ভেঙে দেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানান তারা। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মালপত্র বিক্রি করতেই তারা দোকান তুলছেন।

এদিকে বিহারি ক্যাম্প উচ্ছেদ করায় আপিল বিভাগে মেয়র আতিকুল ইসলামসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে হয়েছিল আদালত অবমাননা মামলা। আদালত ২০২১ সালের ২ মে পর্যন্ত ক্যাম্প উচ্ছেদ না করা নির্দেশ দিয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন রিটকারীদের আইনজীবী। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, আদালতের সেই আদেশ না মেনেই মিরপুরে বিহারি ক্যাম্পগুলোতে ভাঙচুর চালিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

তবে রাজধানীতে ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। উচ্ছেদের পর মিরপুরের ঠিক বিপরীত চিত্র ভাষানটেকে। উত্তরের ১৫ নম্বর এই ওয়ার্ডে ডিএনসিসি অভিযান চালায় জানুয়ারির ৫ তারিখে। সরেজমিনে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত কোনো জায়গা দখল হয়নি। বরং যতটুকু অংশ ভাঙা গেছে, তার বাইরের বৈধ জায়গাকে কেন্দ্র করেই চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মান্ডা ও জিরানি খাল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, উচ্ছেদের পর নতুন করে দখল হয়নি। তবে খালের উপর বাঁশের সাঁকো উচ্ছেদ করা হলেও আবারও সাঁকো বসিয়ে যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করেছেন বাড়ির মালিকরা।



 

Show all comments
  • মমতাজ আহমেদ ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৩:৩৪ এএম says : 0
    অবৈধ দখলদারদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। এ কাজটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Bazlur Rashid ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৩:৩৪ এএম says : 0
    যারা অবৈধ দখলদার তাদের বিরুদ্ধে যেমন আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তেমনি যারা পুনরায় দখল করবে তাদের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Ibrahim Kamal ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৩:৪৩ এএম says : 0
    উচ্ছেদের পর উদ্ধারকৃত জায়গা অতি দ্রুত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Pavel Zaman ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৩:৪৫ এএম says : 0
    যারা অবৈধ দখলদার তারা কি করে পুনরায় দখলের সাহস পায়?
    Total Reply(0) Reply
  • Omar Faruk ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৩:৪৬ এএম says : 0
    উচ্ছেদ অভিযানের নামে এ খেলা চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Ehsan Khan ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৩:৪৭ এএম says : 0
    অবৈধ দখল উচ্ছেদের এই অভিযান এখন অনেকটা খেলো হয়ে পড়েছে। উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলায় পরিণত হয়েছে। তাহলে এই অভিযান চালিয়ে কী লাভ হচ্ছে?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দখল-উচ্ছেদ খেলা

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ