Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারেনি বিএনপি

কারাবন্দির তিন বছর সিনিয়র নেতাদের অনাগ্রহ মনে করছেন নেতাকর্মীরা

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

দুই বছরের বেশি সময় ধরে করাবাস এবং প্রায় এক বছর ধরে নিজ গৃহে কারাবন্দী রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত হলেও শর্তারোপ এবং করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এখনো চিকিৎসা শুরু হয়নি শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ বেগম জিয়ার। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, বেগম খালেদা জিয়া মানসিকভাবে ভালো আছেন। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ। হাতে-পায়ে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছেন, জয়েন্ট পেইন বেড়েছে। বাসায় থাকলেও তিনি এখনো কারাবন্দী। এমনভাবে শর্ত দেয়া হয়েছে যে, তার চিকিৎসা বাইরে করানো যাবে না, এমনকি বাংলাদেশের কোন হাসপাতালেও না। আর তার চিকিৎসা এভাবে সম্ভব না। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়া উচিত। সরকারের কাছে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে আগেই। এখন বাকীটা সরকারের কাজ।

তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সিনিয়র নেতাদের আন্তরিকতার অভাবেই বেগম জিয়া এখনো কারাবন্দী রয়েছেন। লোক দেখানো কিছু মানববন্ধন, প্রতিবাদ কর্মসূচি দিয়ে দায় সারছেন তারা। কিন্তু সরকারকে চাপে রেখে তার মুক্তি আদায় করার মতো কোন কার্যকর কিছুই করতে তিন বছরে ব্যর্থ হয়েছেন নীতি নির্ধারণী নেতারা। অথচ বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠনের পর দলটির অনেক নেতাই আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন। যে নেত্রীর বদান্যতায় অনেকেই এমপি-মন্ত্রী, ধন-সম্পদের মালিক বনেছেন সেই নেতাদের অনেককেই এখন রাজপথে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে যে ৮জন এমপি হয়েছেন তারাও গত দুই বছরে কোন সভা-সমাবেশ-কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেননি।

মুন্সিগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা বশির উদ্দিন বলেন, আমরা সত্যিই অভাগা এক নেত্রীর কর্মী। যিনি শুধু দিয়েই গেছেন, পেলেন শুধু লজ্জা আর অপমান, জেল-জুলুম।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি গোলাম সরোয়ার বলেন, নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হতে চাইলেন সাড়ে ৪ হাজারের বেশি, তাদের মধ্যে ৩০০ জন মনোনয়ন পেলেন, নির্বাহী কমিটিতে আছেন প্রায় ৬ জন। এদের মধ্যে যদি ১০০জন প্রার্থী ও ৩০০ জন কেন্দ্রীয় নেতা রাজপথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তাহলে যেকোন আন্দোলন সফল হতে বাধ্য। সরোয়ার বলেন, দলের পক্ষ থেকে সার্কুলার জারি করা উচিত যাদেরকে পদ দেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেককে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে হবে। পদের যে দায়বদ্ধতা সেটি দৃশ্যমান হতে হবে।

তিন বছরের বেশি সময় ধরে কারাবন্দী বিএনপি প্রধান। তিনি কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই মানববন্ধন, প্রতীকী অনশন, বিক্ষোভ মিছিল, সভা-সমাবেশ করেছেন দলটির নেতারা। এই সময়ে তাকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, প্রার্থী হতে রেকর্ড সংখ্যক সাড়ে ৪ হাজার প্রার্থী, বিজয়ীরা শপথ গ্রহণও করেছেন অনেকেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বার্তা দেয়া হয়েছে বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা এসব করছেন। এরপরও নেতাকর্মীদের প্রিয় নেত্রীর মুক্তি না হওয়ায় সভা-সমাবেশে কঠোর কর্মসূচির অঙ্গীকার করছেন। কিন্তু নির্বাচন, শপথ, সভা-সমাবেশ, আদালত ঘুরে ফিরে আসে কিন্তু দলের প্রধানের মুক্তি না হওয়ায় সিনিয়র নেতাদের এসব কথায় আর আস্থা রাখতে পারছে না কর্মীরা। বিক্ষোভ-মিছিল দিয়ে বেগম জিয়া কোনদিনই মুক্তি পাবে না, কঠোর কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে বাধ্য করার দাবি জানান তারা। দলের জেলা-উপজেলা, বিভাগীয় যে স্থানেই নীতিনির্ধারণী নেতারা সভা-সমাবেশে গেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা দাবি জানিয়েছেন কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার। জীবন বাজী রেখে তারা সেসব কর্মসূচি সফল করার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু তিন বছরেও কার্যকর কোন কর্মসূচি কিংবা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটির দায়িত্বে থাকা নেতারা। নেতাদের এমন নিরব ভূমিকায় অভিযোগ করে অনেকেই বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চান না বেগম জিয়া মুক্ত হন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন এবং নির্বাহী কমিটির মাধ্যম সারির একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা গুরুত্বপূর্ণ নেতারাই চান না বেগম খালেদা জিয়া কারামুক্ত হোক। তারা যদি চাইতো তাহলে বেগম জিয়ার মুক্তি সময়ের ব্যাপার। তারা আরও বলেন, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে সরকারের উদ্দেশ্যে কঠোর কোন কথা বললে বা নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে এধরণের কোন বার্তা দিলেই ডেকে নিয়ে অপমান-অপদস্ত করা হয়। দু’একটি ঘটনায় নেতারা অপদস্ত হওয়ার পর এসব নিয়ে আর কেউ কথা বলছেন না।

স্থায়ী কমিটির ওই নেতা আরও জানান, আগে স্থায়ী কমিটির সভায় বেগম জিয়ার বিষয়ে আলোচনা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে স্থায়ী কমিটির সভাগুলোতে তাকে মুক্ত করা বা তার বিষয়ে কোন আলোচনাও করেন না কেউ।
এদিকে বেগম জিয়াকে কারামুক্ত করতে না পারায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিএনপি নেতাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপি কর্মী মোহাম্মদ নূর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে লিখেছেন, বিএনপির হাইকমান্ডকে বলছি, এয়ার কন্ডিশনের ভিতরে আঙুল চুষেন। যদি খালেদা জিয়ার কিছু হয়, তাহলে এর দায় সরকার নয়, আপনাদেরকে নিতে হবে।

মামুন শিকদার নামে ছাত্রদলের এক নেতা লিখেছেন, বিক্ষোভ-মিছিল চাই না, আমরা চাই সারা দেশব্যাপী লাগাতার হরতাল-অবরোধ। এছাড়া দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।
বেগম খালেদা জিয়ার জন্য বিএনপি কার্যকর কোন আন্দোলন করতে পেরেছে কিনা জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সরকারকে চাপে রেখে বেগম জিয়াকে মুক্ত করার মতো কিছুই আমরা করতে পারিনি। দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে তেমন নির্দেশনাও আসেনি। আবার যারা সাহস রাখে তারা নিজেরা নির্দেশনা না পেয়ে কোন রিস্ক নিতে চায়নি। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এখনো বিএনপি প্রধান কারাবন্দী বলে মনে করেন এই নেতা। তিনি আশা প্রকাশ করেন স্থায়ী কমিটি নিশ্চয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন এবং নির্দেশনা দিবেন।

দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার ও স্বৈরাতান্ত্রিক সরকারে সঙ্কট এক না। এখন বাংলাদেশ গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সঙ্কটজনক সময় অতিক্রম করছে। বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকা বা তাকে মুক্ত করতে না পারাটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি শোচনীয় ঘটনা। এটিকে ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে দেখতে হবে যে, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংগঠক অথবা সংগঠনের নেতারা যেসব কৌশল গ্রহণ করে সেটা সফলভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে কিনা। স্বৈরতন্ত্রকে পরাভূত করার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে শ্রম, দক্ষতা, কৌশল সেটা সফলভাবে করা সম্ভব হয়েছে কিনা। যদি করা না হয় তাহলে সেটি এখনি করা উচিত। তাহলে মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে

স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনেক কর্মসূচি পালন করেছি। কিন্তু যে দেশে একটা ফ্যাসিস্ট, কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী সরকার থাকে তারা গণতন্ত্রের ভাষা বুঝেও না, পাত্তাও দেয় না। তিনি মনে করেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যতটুকু করার ছিল সেটুকু তারা করেছেন। ড. মোশাররফ বলেন, এখনো বিএনপি বেগম জিয়াকে মুক্ত করার জন্যই সকল আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। গত নির্বাচনেও আমরা গেছি তাকে মুক্ত করার জন্যই।

আজ প্রতিবাদ সমাবেশ: বেগম খালেদা জিয়ার কারাবন্দীর তিনবছর পূর্ণতার দিনে তার মুক্তির দাবিতে আজ রাজধানীতে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে বিএনপি। সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচি পালন করবে দলটির নেতাকর্মীরা। #



 

Show all comments
  • নাবিল আব্দুল্লাহ ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৩:৫৮ এএম says : 0
    বিএনপি নেতা কর্মী কারণে দেশের আজ এই অবস্থা। তার জন্য দায় নিতে হবে উচ্চপদস্থ নেতাদের।
    Total Reply(0) Reply
  • Rashadul Islam ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৩:৫৮ এএম says : 0
    জালিমের কারাগারে যখন একজন ইমানদার মৃত্যু বরণ করতে দেখেছি, সেখানে বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত করতে না পারাটা স্বাভাবিক।
    Total Reply(0) Reply
  • মমতাজ আহমেদ ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৪:০০ এএম says : 0
    জনগন সবই দেখছে, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি এবং করবেও না।
    Total Reply(0) Reply
  • Nazmul Karim Soikot ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৪:০২ এএম says : 0
    আন্দোলন না করে শুধু বকবক করে মুক্তি হবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • M S Rayhan ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৪:০২ এএম says : 0
    পুরো বাংলাদেশে এখন তাদের হাতে জিম্মি। বাংলাদেশের মানুষের সব লুটেপুটে নিয়ে যাচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Sujon ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৪:০৪ এএম says : 0
    নেতারা যখনই আন্দোলনের কথা বলে তখনই সাধারন কর্মীরা অহেতুক গ্রেফতার হয়,,, কি দরকার তাদের সাথে এমন খেলার!
    Total Reply(0) Reply
  • mozibur binkalam ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৬:৩৪ এএম says : 0
    ভুল....... খালেদা জিয়াকে মুক্ত হতে দেয়নি ফ্যাসিবাদী সরকার।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খালেদা জিয়া

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ