Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিল্প বিনিয়োগের অন্তরায়

কোম্পানি আইনের পাঁচটি ধারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখতিয়ারের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা সংঘ-স্মারক পরিবর্তনে যেতে হচ্ছে আদালতে

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

যৌক্তিক কারণেই হয়তো নির্ধারিত সময়ে কোনো বাণিজ্যিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) হয়নি। সময়সীমা অতিক্রান্তের পর এ এজিএম সম্পাদনে প্রয়োজন হয় উচ্চ আদালতের আদেশ। সেই আদেশ অর্জনে বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘুরতে হয় মাসের পর মাস। আদালতের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই যথাযময়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। কোম্পানি আইন-১৯৯৪ এর কয়েকটি ধারা সৃষ্টি করেছে এ অন্তরায়। গতবছর আইনটির সংশোধনী হলেও সাধারণ দু’টি পরিবর্তন ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ কারণে সংঘ স্মারক পরিবর্তন এবং বার্ষিক সাধারণ সভা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। আইনজ্ঞদের চোখে যা শিল্পবিনিয়োগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে বড় ধরনের অন্তরায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) ৬ ধরনের প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দিয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে, পাবলিক কোম্পানি, প্রাইভেট কোম্পানি, বিদেশি কোম্পানি, ট্রেড অরগানাইজেশন, সোসাইটি (সমিতি) এবং পার্টনারশিপ ফার্ম বা অংশীদারী কারবার। আরজেএসসি বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র অফিস যা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোম্পানি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গঠনের সুবিধা দিচ্ছে। কোম্পানির মালিকানা সম্পর্কিত সব নথিপত্র সংরক্ষণ করছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তিনটি আইনে কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। এগুলো হচ্ছে, (১) কোম্পানি ও বাণিজ্য সংগঠন : কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ (কোম্পানি আইন, ১৯১৩ এর সংশোধনী), (২) সোসাইটি : সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৮৬০ এবং (৩) অংশীদারী কারবার : অংশীদারী কারবার আইন, ১৯৩২। এসব আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনগত নানা ধরনের অন্তরায়ের সম্মুখিন হচ্ছে আরজেএসসি। সূত্রমতে, কোম্পানি আইনের ১২(১) এ উল্লেখ রয়েছে, এ আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে কোনো কোম্পানি উহার বিশেষ সিদ্ধান্ত ক্রমে নিম্নলিখিত সব বা যে কোনো কার্যসম্পাদনের প্রয়োজনে, কোম্পানির উদ্দেশ্য সম্পর্কিত ইহার সংঘ স্মারকের বিধানসমূহ পরিবর্তন করিতে পারে। কিন্তু ১২(২) ধারায় বলা হয়েছে, উক্ত পরিবর্তন সাধন সম্পর্কে আবেদন করার পর আদালত কর্তৃক তাহা অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত এবং আদালত কর্তৃক যতটুকু গৃহীত হয় ততটুকুর অতিরিক্ত উহা কার্যকর হবে না। উক্ত ধারার ফলে কোম্পানির মিতব্যয়িতা বা অধিকরতর দক্ষতার সঙ্গে কার্যাবলী পরিচালনা কিংবা নতুন বা উন্নততর উপায়ে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন, কোম্পানির পরিব্যপ্তি সম্প্রসারণ, পরিবর্তন, অন্য কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি-সংঘের সঙ্গে একীভ‚ত হওয়ার প্রক্রিয়া জটিল আকার ধারণ করেছে।

অনেক কোম্পানি তার কার্যক্রমের সঙ্গে অন্য কোম্পানির সঙ্গে সুবিধাজনকভাবে বা লাভজনকভাবে সংযুক্ত হতে পারছে না। অনেক কোম্পানি সম্পত্তি বিক্রি কিংবা বিক্রয় সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করতে পারছে না। কারণ আদালত বেশ কিছু বিষয় নিশ্চিত হয়েই এ অনুমোদনগুলো দিয়ে থাকেন। আদালত এ মর্মে সন্তুষ্ট হতে চান যে, কোম্পানির প্রত্যেক ডিবেঞ্চারধারীকে এবং পরিবর্তনের ফলে আদালতের মতে যাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে এমন প্রত্যেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত নোটিশ দেয়া হয়েছে কি-না।

আদালতের বিবেচনায় উপরোক্ত পরিবর্তন সম্পর্কে আপত্তি করার অধিকারী সব পাওনাদারের যদি আপত্তি থাকে, আদালত নির্দেশিত পদ্ধতিতে উত্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন কি-না। সংশ্লিষ্ট পাওনাদারের সম্মতি নেয়া হয়েছে কি-না। অথবা তার পাওনা বা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে কি-না। কিংবা আদালতের সন্তুষ্টি অনুযায়ী উক্ত পাওনা বা দাবি পরিশোধের জন্য জামানত দেয়া হয়েছে কি-না। এসব বিষয়ে সন্তুষ্টি লাভ সময় সাপেক্ষ। ফলে আদালতের ‘সন্তুষ্টি’ অর্জনে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি এবং আরজেএসসিকে বহু কাঠ-খড় পোড়াতে হয়।

সূত্রমতে, শিল্প-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং সহজীকরণের লক্ষ্যে গতবছর ২৫ ফেব্রæয়ারি ‘এক ব্যক্তি কোম্পানি’ গঠনের আইনগত বিধান প্রণয়নে এক ব্যক্তি কোম্পানি (দ্বিতীয় সংশোধন) গেজেট হয়। সংশোধনীতে কোম্পানি নিবন্ধনের সময় সিলের নিবন্ধন করানোর বাধ্যবাধকতা তুলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের জন্য কোম্পানি সিলের প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে কোম্পানির নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনায় কোম্পানি সিল ব্যবহার করা যাবে। এ সংশোধনী শিল্পবিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

তবে আইনের সর্বশেষ সংশোধনীর পরও বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ১২,১৩,১৪,১৫ ও ১৬ ধারা। ১২ ধারাটি কোম্পানির সঙ্ঘ স্মারক পরিবর্তন সংক্রান্ত। ১৩ ধারাটি কোম্পানির ‘পরিবর্তন অনুমোদনের ক্ষেত্রে আদালতের ক্ষমতা’ বিষয়ক। ১৪ ধারায় রয়েছে ‘আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়। ১৫ ধারা- কোম্পানির অনুমোদনের পরবর্তী কার্যাবলী এবং ১৬ ধারায় রয়েছে কোম্পানির ‘বর্ধিত সমযের মধ্যে নিবন্ধনের ব্যর্থতা ফলাফল’ সংক্রান্ত বিধান। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানি আইনের এ বিধানগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন বাণিজ্য ও শিল্পোদ্যোক্তারা। বিদ্যমান ধারাগুলোর জটিলতার কথা আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে। কিন্তু সর্বশেষ সংশোধনীতে সেটির প্রতিফলন না ঘটায় সংশ্লিষ্টরা হতাশ।

আরজেএসসি সূত্র জানায়, কোম্পানি আইনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি ধারাসহ কার্যক্রম সহজীকরণে সরকারের কাছে বেশ কিছু সংশোধনী চাওয়া হয়। কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত ধারা-৩৮ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপ-ধারা-৮ (ক) (খ) এবং (গ) সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়। ধারা-৮১ ও ৮২ অনুযায়ী কোম্পানির সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের সময় বর্ধিতকরণে ‘আদালত’র পরিবর্তে ‘নিবন্ধক কর্তৃক’ বর্ধিতকরণের বিধান চাওয়া হয়। এছাড়া ধারা-৮৫ এর সভা ও ভোট সম্পর্কিত ধারায় সভার নোটিশের সময় বর্ধিতকরণ, সময়-স্থান ও বিষয়বস্তু স্পষ্টকরণসহ উপ-ধারা ৮৫(১) এর (ক), (খ) সংশোধন এবং (চ), (ছ), এবং (জ) সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়। শেয়ার বরাদ্দপত্র এবং বন্ধকের বিবরণী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাখিলে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে দাখিলের পরিবর্তে নিবন্ধকের অনুমতি সাপেক্ষে দাখিলের লক্ষ্যে ধারা ১৫১ এর উপ-ধারা (৪) ও ১৭১ এর উপ-ধারা (১), (২) এর সংশোধন চাওয়া হয়। এছাড়া আরজেএসসি’র বিদ্যমান ডিজিটাল সেবাকে আইনগত ভিত্তি প্রদানে ৪০৫, ৪০৬, ৪০৭, ৪০৮ এবং ৪০৯ এর সংযোজন সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সর্বশেষ সংশোধনীতে এসব প্রস্তাবের প্রতিফলন ঘটেনি।

এ বিষয়ে কোম্পানি আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট মীর আব্দুল হালিম বলেন, কোম্পানি আইনের সর্বশেষ সংশোধনী বাণিজ্য ও শিল্পোদ্যোক্তাদের হতাশ করেছে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প সম্প্রসারণের পথে বড় অন্তরায় হয়ে কাজ করবে। কারণ গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয়ই এ সংশোধনীতে ঠাঁই পায়নি। একটি হচ্ছে, কোম্পানি সংঘ স্মারকে কোনো ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তা হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের প্রয়োজন হয়। এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল, সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ। অথচ কোম্পানি আইনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই এ ধরনের সাধারণ কাজের অনুমতি দিতে পারে। ভারতসহ উপমহাদেশে এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বিধান, স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি, উন্নয়ন ও আধুনিকায়, হয়রানি লাঘব, শেয়ারবাজারে আইনের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো, কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান, রিটার্ন দাখিল সহজতর করার বিষয়গুলোই বাদ পড়েছে সংশোধনীতে। জটিল বিষয় উপেক্ষা করে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনে অত্যন্ত সীমিত আকারে সাধারণ দু’টি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি কোম্পানি আইনে বিদ্যমান জটিলতা নিরসনে খুব বেশি সহায়ক নয়। দেশের অসংখ্য প্রোপাইটরশিপ ব্যবসাকে আয়করের আওতায় আনতে একক ব্যক্তি কোম্পানি গঠন ব্যবস্থা হয়তো সুফল দেবে।

এফবিসিসিআই’র সাবেক সহ-সভাপতি ব্যবসায়ী আবুল কাসেম হায়দার এ বিষয়ে বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কোনো ধরনের পরিবর্তনের জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। এতে অনেক সময়ক্ষেপণ ও হয়রানির শিকার হতে হয়। বিনিয়োগবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আইনের এ ধারা সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিবন্ধকের হাতেই এ এখতিয়ার দেয়া হয়েছে।

এদিকে আরজেএসসির নিবন্ধক মকবুল হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, বিদ্যমান আইনের আওতায় থেকেই আমরা চেষ্টা করছি সেবা সহজীকরণের। তিন ধাপের কোম্পানি নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আমরা নামিয়ে এনেছি একধাপে। এখন কোনো কোম্পানি মালিককে একবারের বেশি আরজেএসসিতে হাজির হতে হবে না। নিবন্ধিত কোম্পানির নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দাখিলকৃত কাগজাদি পরীক্ষান্তে সঠিক পাওয়া গেলে নাম পরিবর্তনের সার্টিফিকেট ইলেক্ট্রনিক স্বাক্ষরের মাধ্যমে আবেদনকারীর ই-মেইলে সরাসরি প্রেরণ করা হবে। এ ব্যবস্থা ফেব্রæয়ারির প্রথম থেকেই কার্যকর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।



 

Show all comments
  • ডালিম ৩১ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:২১ এএম says : 0
    শিল্প বিনিয়োগের অন্তরায় দূর করা জরুরী
    Total Reply(0) Reply
  • নিয়ামুল ৩১ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:২২ এএম says : 0
    কোম্পানি আইনের সর্বশেষ সংশোধনী বাণিজ্য ও শিল্পোদ্যোক্তাদের হতাশ করেছে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প সম্প্রসারণের পথে বড় অন্তরায় হয়ে কাজ করবে।
    Total Reply(0) Reply
  • বুলবুল আহমেদ ৩১ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:২৩ এএম says : 0
    এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত
    Total Reply(0) Reply
  • মমতাজ আহমেদ ৩১ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:২৩ এএম says : 0
    সাঈদ আহমেদ সাহেবকে নিউজটির জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি
    Total Reply(0) Reply
  • এনায়েতুল্লাহ ৩১ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:২৪ এএম says : 0
    আশা করি অতি শিঘ্রই এই অন্তরায়গুলো দুর হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিল্প বিনিয়োগ

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ