Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাড়ছে নারী অপরাধী

রাজধানীতে সক্রিয় ৫০ ছিনতাইকারী : পেশাদার শতাধিক

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে চার বছর আগেও কোহিনুর বেগম মালা (৩৫) সবজি কুড়িয়ে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। অভিনয়ের প্রতি শখ থাকায় বেশ কিছু দিন কাজ করেন নাট্যমঞ্চে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর এখন তিন নম্বর স্বামী ইয়াসিন মিয়াকে নিয়ে থাকেন মানিকনগর এলাকায়। তিনি সংসার জীবনে প্রবেশ করলেও এক পর্যায়ে ছিনতাইকারী, ডাকাত ও অপহরণকারীদের আশ্রয়দাতা হয়ে উঠেন। থানা পুলিশ থেকে আদালতপাড়া পর্যন্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেও শেষ রক্ষায় হয়নি।

অবশেষে গত ২৬ জানুয়ারি রাতে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন মালা। রাজধানীতে শুধু মালা একা নন। তার মতো নারী অপরাধীরা সমাজের উচ্চ পর্যায় থেকে বস্তি সর্বত্র বিচরণ করছে। অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি, অপহরণ, প্রতারণা, অবৈধ অস্ত্র বহন, মাদক বিক্রি ও মাদক বহন, মানুষকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়া ও জাল টাকা বহনসহ নানা ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে নারীরা। এ ধরনের শতাধিক পেশাদার নারী অপরাধী সক্রিয় রয়েছে রাজধানীতে। বিভিন্ন সময় এরা অপরাধ করে ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ায় বেশ কয়েকজন নারী অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সাধারণ লোকদের প্রতারণায় ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ হত্যার মতো অপরাধের সাথেও জড়িত এসব নারী। এদের রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। অপরাধ করেও ছাড়া পাওয়ার মতো শক্ত খুঁটি আছে তাদের। ধরা পড়ার পরও এরা সহজে বেরিয়ে আসে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সম্প্রতি ছিনতাই ও অপহরণসহ নানা অপরাধের সাথে নারী অপরাধীদের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে এসেছে। অপরাধীরা নারী না পুরুষ সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। আইনের চোখে অপরাধীরা সকলেই সমান। আমরা অপরাধীদের নজরদারির মধ্যে রাখছি। অপরাধ করে কেউ ছাড় পাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রভাষক এ বি এম নাজমুস সাকিব দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অপরাধীরা অপরাধ করার আগে চিন্তা করে কেমন ধরনের ঝুঁকি নিতে হবে এবং ধরা পড়লে কেমন সাজা হবে। তবে সাজার তুলনায় লাভের অঙ্ক বেশি হওয়ায় নারীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মাদক ও প্রতারণামূলক অপরাধে নারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

তিনি বলেন, সমাজে নারীদের সন্দেহের বাইরে রাখা হয়। এই সুযোগে নারীরা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আগে পুরুষ অপরাধীরা নারীদের বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করত। এতে করে অনেক সময় নারীরা পারদর্শী হয়ে উঠে। পরে তারাও বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা শুরু করে। অপরিচিত নারীদের সাথে চলাফেরার ক্ষেত্রে সর্তক এবং সচেতন হলেই এমন অপরাধ প্রবনতা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মিশু বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, মানিকনগরের ওয়াসা রোডে কোহিনুর বেগম মালার বাসায় ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের আখড়া ছিল। তার দলের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি-ছিনতাই করে ওই বাসায় মালপত্র রাখত। সেখানেই ভাগ-বাটোয়ারা হতো। ডাকাতি-ছিনতাইয়ের পরিকল্পনাও হতো সেখানে। দলের কোনো সদস্য গ্রেফতার হলে তার স্বামী ইয়াসিন তাদের জামিনের ব্যবস্থা করতেন। কারওয়ান বাজারে থাকার সময় ছিনতাই গ্রæপের সঙ্গে পরিচয় ছিল মালার। ইয়াসিনও ছিল ছিনতাইকারী দলের সদস্য। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে স্বামী-স্ত্রী মিলে ডাকাত-ছিনতাইকারীদের সহায়তা শুরু করেন। ইয়াসিনকে গ্রেফতার করা গেলে এ-সংক্রান্ত আরও তথ্য পাওয়া যাবে।
পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপরাধী সিন্ডিকেটরা নারীদের দিয়ে অপরাধ করার বিষয়টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেয়ার একটা সহজ কৌশল বলে মনে করে। এছাড়া নারীরা অনেক সময় সন্দেহের বাইরে থাকে। সেক্ষেত্রে এরা সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করে। অন্যদিকে এদের অন্তরালে পুরুষ সিন্ডিকেটের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয়ভাবে মদদ দিয়ে থাকে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে প্রায় এক বছর আগে চুরি হওয়া শিশুকন্যা জিমকে নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধারের পর জাহানারা নামে এক মহিলাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। কিন্তু কয়েক মাস পরই জেল থেকে বের হয়ে ফের ঢামেকের বহিঃবিভাগে সঙ্গীসহ তাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। জাহানারাসহ আরও কয়েকজন মহিলার নামে বেশ কয়েকবার শিশু চুরির অভিযোগ ছিল। কিছুদিন আগে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ইমা। তাকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে নারী অপরাধীদের বিভিন্ন অপরাধ কৌশল। বিভিন্ন প্রলোভন ও কৌশলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি হাতিয়ে নিয়েছে।

ডিবি পুলিশের সূত্র জানায়, রাজধানীতে নারী পকেটমারের চক্রে পুরুষ সদস্যও আছে। দুই-তিনজন একসঙ্গে কাজ করে। আর সহযোগী বা সুরক্ষা দেয়ার কাজ করে আরো তিন-চারজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও ঢাকা মেডিক্যাল ঘিরে রোগী অপকর্ম করছে ২০ থেকে ২৫ জন। একটি দলের হোতা রুমাকে ২০১৫ সালে গ্রেফতার করা হলে পরে সে জামিনে ছাড়া পেয়েছে। নিউ মার্কেটকেন্দ্রিক সক্রিয় অন্তত ১০টি গ্রæপ। মহাখালী থেকে প্রেমা ও শামসুন্নাহার নামে দুই দলনেতাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পরে তাদের হদিস মেলেনি।

গত বছরের ৫ মার্চ গুলশানে একটি ফ্ল্যাটে বাসার লোকজনকে অচেতন করে ৬০ ভরি সোনার অলঙ্কার নিয়ে যায় এক নারী। তদন্তে নেমে ডিবি চক্রটিকে শনাক্ত করে। দলের প্রধান পারভীন আক্তার শাহিনুর ওরফে আলপিনা খাতুনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই নারী অভিজাত এলাকায় অপকর্ম করত। বারিধারার একটি বাসা থেকেও ২৭ ভরি সোনার অলংকার ও হীরার আংটি নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে সোনার দোকানি, বাড়ির তথ্য দাতাও রয়েছে। এমন আরো চক্র আছে বলেও তথ্য মিলেছে।

ডিবির সূত্র জানায়, বেশির ভাগ প্রতারক বুয়া ও পকেটমারের বাসা টঙ্গী, গাজীপুর, কেরাণীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও সাভার এলাকায়। এরা এসে কাজ শেষে আবার বাড়ি ফিরে যায়। আর ঢাকায় যারা বসবাস করে তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছাড়া বাকিদের প্রায় সবাই বস্তিতে বসবাস করে।

গত ২৬ জানুয়ারি ডিবির মতিঝিল বিভাগ তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ মোবাইল ফোন চোর চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩০টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এই ছয় জনের গ্রুপে রুনা ওরফে রোজিনা নামে এক নারী সদস্য রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নারী অপরাধী

৩১ জানুয়ারি, ২০২১
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ