Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জ্বালানি চ্যালেঞ্জের মুখে দেশ

প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : জ্বালানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশ। যে হারে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে, সে তুলনায় গ্যাসের সন্ধান মিলছে না। এতে করে আগামী ছয় বছরের মধ্যে গ্যাসের মজুদ কমে ৩০ শতাংশে চলে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সঙ্কটের মূল কারণ হচ্ছে গ্যাস অনুসন্ধানে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারা। এই সঙ্কট মোকবিলায় তারা স্থলভাগ এবং বঙ্গোপসাগরে খুব দ্রুত গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তবে সরকার মনে করছে, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশের চলমান গ্যাস সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব।
গ্যাস সঙ্কট এখন এতটাই প্রকট যে, জ্বালানি বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে নতুন করে আবাসিক খাতে যেন গ্যাসের সংযোগ দেয়া না হয়। একইসাথে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেয়ার কথা বলা হলেও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নেতারা বলছেন, শিল্পে গ্যাস সংযোগ না পাওয়ার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারছে না। বিদেশীরাও শিল্পখাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। তারা গ্যাস সঙ্কট দ্রুত দূর করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে, দেশে মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ২৭.১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। আর এই পরিমাণ মজুদ থেকে ব্যবহৃত হয়েছে ১৪.০৩২ টিসিএফ। মজুদ আছে আর মাত্র ১৪.০৮৮ টিসিএফ। পেট্রোবাংলার হিসেবে, ২০১৯ সালের মধ্যে গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ঘাটতি ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। যার লক্ষণ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
গ্যাস ব্যবহারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৮টি খাতে প্রতি বছর প্রায় এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। সারাদেশে গ্যাসের গ্রাহক রয়েছে ৩০ লক্ষাধিক। তবে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারির সংখ্যাও ৩ লাখের নিচে নয় বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান হোসেইন মনসুর। ব্যবহারের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি গ্যাস যায় বিদ্যুৎ খাতে। আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে শিল্প খাত। আবাসিক খাতে উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র মাত্র ১২ শতাংশ ব্যবহৃত হয়।
গ্যাস সঙ্কট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, গ্যাস পেতে বাপেক্স যে অনুসন্ধান করেছে সেটি খুবই নগণ্য। গ্যাস অনুসন্ধান বলতে যা বোঝায় প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। তিনি ভবিষ্যৎ উন্নয়ন বিবেচনায় দ্রুত বঙ্গোপসাগরে এবং স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, বঙ্গোপসাগরে যে গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া তা অত্যন্ত ধীর গতিতে হচ্ছে। তিনি মনে করেন, গ্যাসের অনুসন্ধান চালানোর পাশাপাশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা।
তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্যাসের তীব্র সঙ্কট দূর হতে দেশবাসীকে আরো বছর দু’য়েক অপেক্ষা করতে হবে। তিনি স্বীকার করেন যে, বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে গ্যাসের মজুদে অদূর ভবিষ্যতে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাই আমদানি করা এলএনজি দিয়ে সঙ্কট উত্তরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। গ্যাস নিয়ে তিনি দেশবাসীকে ‘আতঙ্কিত’ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, গ্যাসের অবস্থার উন্নতির জন্য সরকার তিন ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
নসরুল হামিদ বলেন, বর্তমানে যে হারে গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে এ হার অব্যাহত থাকলে মজুদ গ্যাস ১৬ বছর পর্যন্ত চালানো যাবে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে গ্যাস যদি চাহিদা অনুযায়ী উত্তোলন করা হয় তবে সে ক্ষেত্রে ১৬ বছর দূরের কথা ৬ বছরেও তা শেষ হতে পারে। তিনি অবশ্য এমন আশার বাণীও শুনান যে, দেশের স্থলভাগে কিংবা সাগর প্রান্তে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলে সব হিসাব পাল্টে যাবে।
এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, বাংলাদেশের স্থলভাগে বড় ধরনের কোনো গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে সাগর প্রান্তে আবিষ্কৃত হতে পারে এক বা একাধিক গ্যাস ক্ষেত্র। সেটিই এখন দেশের ইন্ধন শক্তির বড় ভরসা।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সক্ষমতা নানা কারণেই বাধাগ্রস্ত। যে হারে এই প্রতিষ্ঠানটির সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কথা সে হারে পাচ্ছে। বরং অর্থ সঙ্কট, অনুসন্ধান কাজে ব্যবহৃত আধুনিক সরঞ্জামাদির সঙ্কট, জনবল ঘাটতি Ñ বিভিন্ন কারণেই প্রতিষ্ঠানটি ধুঁকছে। এরপরও চলতি বছর বাপেক্সের সফলতা আছে। এই প্রথম বাপেক্স আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নিয়ে অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজ পেয়েছে। কুমিল্লা-ভাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রের দুটি কূপ খননের জন্য ক্রিশ এনার্জি বাপেক্সকে নির্বাচিত করেছে।
তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও প্রাপ্তি
বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাসের তথ্য জানতে দ্বিমাত্রিক জরিপ (মাল্টিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে) করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য ৫টি কোম্পানি দরপত্র জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করা যায়নি। এছাড়া সাগরের ১২, ১৬ ও ২১ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধান কাজের জন্য চলতি বছর কনোকো ফিলিপস আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত পিএসসি না করে চলে গেছে।
অন্যদিকে, গ্যাস সঙ্কট কাটাতে নতুন করে কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। কোনো অনুসন্ধান কূপ থেকে উল্লেখ করার মতো গ্যাসও উত্তোলন করা যায়নি। একমাত্র শেভরনের জালালাবাদের গ্যাসক্ষেত্র থেকে নতুন করে ১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে।
এলএনজি ও এলপিজি
গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে সরকার এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পেট্রোবাংলা এ জন্য মহেশখালীতে ভাসমান একটি টার্মিনাল নির্মাণ করছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেডের সঙ্গে অনুস্বাক্ষর করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের তরফ থেকে পাওয়ার সেল স্থলভাগে একটি আলাদা এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৮ থেকে দেশে এই নতুন জ্বালানি ব্যবহার শুরু করার পরিকল্পনা করা হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
এ ব্যপারে জ্বালাননি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আগামী দু’বছরের মধ্যে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হবে।
সরকার আবাসিকে পাইপলাইনের গ্যাসের পরিবর্তে সিলিন্ডার ব্যবহার উৎসাহিত করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ইচ্ছেমতো দামে বেসরকারি কোম্পানিগুলো এলপিজি বিক্রি করে। অনেক ভুঁইফোঁড় কোম্পানি সিলিন্ডার তৈরি করছে। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্যাস ব্যবহারে যে বৈষম্য তা না কমে আরো বাড়ছে।
এ ব্যপারে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস-এলপিজি’র ব্যবহার বাড়ালে গ্যাসের ওপর চাপ অনেকটাই কমবে। এক্ষেত্রে এলপিজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলপিজি ব্যবহার শুরু হলে চাহিদা মোতাবেক অবশ্যই সরবরাহ করা যাবে। দামেরও সমন্বয় ঘটানো হবে।
এডিবির প্রতিশ্রুতি কাটছাঁট
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডকে দেয়া ১২৫ কোটি টাকা ঋণের প্রতিশ্রুতি বাতিল করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটি তিতাস গ্যাস ফিল্ডের গ্যাস উদগিরণ নিয়ন্ত্রণ এবং ফিল্ডের মূল্যায়ন ও উন্নয়নে ৮১০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও এখন ৬৮৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিচ্ছে এডিবি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (এডিবি) এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং শ্লথ গতির কারণে প্রকল্প থেকে ১২৫ কোটি টাকা প্রতিশ্রুতি কমিয়ে দিয়েছে দাতা সংস্থা এডিবি। যে সমস্ত কাজ এডিবির অর্থায়নে ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ করার কথা ছিল সেইসব কাজে অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে অর্থ ব্যয় করেনি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড। এর পরিবর্তে অন্য খাতে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। যা ভালভাবে নেয়নি সংস্থাটি। এ কারণেই সাহায্য কমিয়ে দিয়েছে এডিবি।
এই প্রকল্পে ঋণ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে Ñ তিতাস গ্যাস ফিল্ডে গ্যাস উদগিরণ সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তিতাস ১৭ ও ১৮ নং কূপ খনন ফলাফল এবং ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ৪টি মূল্যায়ন-কাম-উন্নয়ন কূপ খনন করা। গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি তথা দেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা পূরণ করা এবং তিতাস ফিল্ডের স্ট্রাকচারে প্রকৃতি, অবস্থা ও বিস্তৃতি নিরূপণ করা। কিন্তু এ কাজগুলো সঠিকভাবে না হওয়ায় এডিবি ১২৫ কোটি টাকা ফেরত নিচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জ্বালানি চ্যালেঞ্জের মুখে দেশ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ