Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জনস্বাস্থ্য কি শুধু কথার কথা?

প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী

পরিবেশ শব্দটি বর্তমানে অত্যন্ত পরিচিত শব্দ হয়ে পড়েছে। প্রায় সর্বত্র এখন পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা হতে দেখা যায়। এই বিষয়ের ওপর পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, এমনকি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনও হচ্ছে। সকলের এক কথা। পরিবেশের উন্নয়ন করতে হবে। ক্ষুদ্র গ-িতে পরিবেশ বলতে বুঝানো হয় জনসাধারণের স্বাস্থ্যের বিষয়। কোন কোন জিনিস মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, সেগুলোকে কি করা হলে তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষ রক্ষা পাবে এবং কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর হবে-এসব বিষয়ের ওপর সাধারণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, পত্র-পত্রিকায়ও লেখা হচ্ছে। আর বৃহত্তর গ-ির অর্থাৎ কোন কোন জিনিস পৃথিবীর আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, প্রাণিজগতের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হযে উঠছে এবং সে অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে চাইলে করণীয় কি সে কথা। এ বিষয় নিয়ে ঢাকায় ক’টি সম্মেলনও হয়ে গেল। দেশি-বিদেশি বেশ ক’জন বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের তরফ থেকে বেশ ক’জন এবং বিদেশি ৪০ জন সম্মেলনে তাদের মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপনা করেছেন। তাদের আলোচ্য বিষয় ছিল বিশ্বব্যাপী গ্রীণ হাউজ এ্যাফেক্ট-এর ফলে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে তা থেকে বাংলাদেশকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তার নীতিমালা ও করণীয় নির্ধারণ করা। বিষয়টি অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের, সাধারণ মানুষের বুঝার পক্ষে কষ্টকর।
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বিজ্ঞানীদের, বিশেষজ্ঞদের এই আলোচনার বিষয় নয়। আমাদের আলোচনার বিষয় অত্যন্ত সাধারণ জিনিস, সাধারণ ঘটনা। এসব জিনিস আমাদের চোখের সামনে ঘটছে অহরহ, আমাদের চরম ভোগান্তি হচ্ছে এ সবের মোকাবিলা করা। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলি। রাজধানী ঢাকা নগরীতে আমরা যারা বাস করছি তারা যে কি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। ঢাকা বাঙলাদেশের রাজধানী। কম করে হলেও কোটি লোকের বাস এই নগরীতে। স্বাধীনতা পূর্বকালের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের শৈশব-কৈশোর শেষ হয়ে এখন আমরা যৌবনে পৌঁছেছি। আমাদের বুঝ আক্কেল হয়নি এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। কেউ এ কথা বলুক আমরাও তা চাই না। আমাদের যে কিছু আক্কেল জ্ঞান হয়েছে, নিজেদের ভালমন্দ আমরা কিছু বুঝতে পারি এ কথার প্রমাণ আমরা অসংখ্যবার দিয়েছি গত কয়েক বছরে। বহু সংগ্রাম, বহু আন্দোলন ও বহু প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বৈরশাসককে হটিয়ে দেশে জনগণের শাসন-গণতন্ত্র কায়েম করেছি। আশা ছিল গণতন্ত্র কায়েম হলে জনগণের অর্থাৎ আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের জানমাল রক্ষার প্রতি সরকারের নজর একটু বেশি পড়বে। কারণ গণতন্ত্র মানে জনগণের সরকার। কাজেই নিজেদের সরকার তার নিজের মানুষ জনগণের সুখ-সুবিধার প্রতি আগের চেয়ে অর্থাৎ বিদেশি ও স্বদেশি স্বৈরসরকারের চেয়ে একটু বেশি নজর দেবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না, জনগণের সেই আশায় গুড়ে বালি। জনগণ তাদের অবস্থায় রয়ে গেছে। পরিবর্তন কিছুটাও হয়নি। বরং গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে রাজধানীর জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত কর্মহীন যুবক-যুবতী চাকরির আশায়, নদীভাঙা, সর্বস্বহারা মানুষ আহারের সন্ধানে এসে উঠেছে রাজধানীতে। ফলে রাজধানীর সব এলাকা লোকে গিজগিজ করছে, সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বস্তি। এই বাড়তি জনগোষ্ঠীর থাকা-খাওয়ার যেমন ভদ্রজনোচিত কোন ব্যবস্থা নেই, আবর্জনা ফেলার কোন স্থান নেই, তেমনি তাদের প্রাত্যহিক প্রাকৃতিক কাজেরও কোন নির্দিষ্ট স্থান নেই। ফলে নগরীর সব পাড়ার রাস্তার পাশ, ডোবার পাড়, বাড়ির পিছন হয়ে উঠেছে মলমূত্র ত্যাগের স্থান। আর গৃহস্থালীর আবর্জনা? এখন নগরীর যে কোন পাড়ার রাস্তার পাশের ও মোড়ের বাড়ির সামনে এমনকি, গুলশান-বনানীর মত অভিজাত এলাকায় এবং মতিঝিল এলাকার মত অভিজাত ও ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকায়ও সর্বক্ষণ আবর্জনার স্তুপ পড়ে থাকার দৃশ্য একটি সাধারণ ব্যাপার। এসব আবর্জনা দিনের পর দিন পড়ে থেকে গলে-পচে শুধু যে দুগন্ধ ছড়ায় তা নয়, বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগজীবাণু ছড়ানোর মত ‘জনসেবামূলক কাজে? অবদান রাখছে-এ কথা কি অস্বীকার করা যায়। অথচ এ সব দেখার জন্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মত একটি বৃহৎ সংস্থা রয়েছে। নগরবাসীর দেয়া কর ও সরকারি অর্থে পরিচালিত এই সংস্থার প্রকৃত কাজ কি অনেক সময় সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে অনেকে। কারণ নগরবাসীর সুখ-সুবিধা, তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কোন কাজে কর্পোরেশনকে কখনও ব্যস্ত দেখা যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছি কিন্তু কোন সভ্য দেশে দিনের এগারোটা-বারোটায় খোলা ট্রাকে করে পঁচা-বাসি আবর্জনা নিয়ে যেতে কোথাও দেখিনি, আমাদের রাজধানী এই ঢাকা নগরীতে এটি একটি সাধারণ দৃশ্য। যানবাহন আর পথচারীতে এ সময় নগরীর প্রায় রাস্তা থাকে ঠাসা। ঠিক তখন দেখা যায়, পৌর কর্পোরেশনের খোলা ট্রাক বিভিন্ন ধরনের পচা দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা রাস্তায়, মানুষের গায়ে ছিটিয়ে ছুটে যাচ্ছে, তখন কর্পোরেশনের জনসেবার নমুনা দেখে লোকে কাঁদবে না হাসবে তাই ঠিক করতে হিমশিম খায়।
এই আবর্জনার ব্যাপারে আরও কথা আছে। সব দেশের শহুরে বাসাবাড়ির, দোকানপাটের, এমনকি কাঁচাবাজারেরও আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট স্থান থাকে, ডাস্টবিন থাকে। কিন্তু আমাদের ঢাকা নগরীতে পৌর কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে বড় সহানুভূতিশীল। নগরবাসীকে আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে, ডাস্টবিনে ফেলতে বাধ্য থাকার মত কষ্ট তারা দিতে চায় না। তাই সদর রাস্তা, মার্কেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি হাসপাতালের সামনে আবর্জনার স্তূপ সৃষ্টি করলেও কর্পোরেশন কোন আপত্তি করে না। শুধু তাই নয়, বোধহয় নগরবাসীকে এই কষ্ট থেকে রেহাই দেয়ার জন্য অনেক মহল্লায় অনেক পাড়ায় কোন ডাস্টবিন তৈরি করা হয়নি। ফলে জনগণ ইচ্ছামত যে কোন স্থানে আবর্জনা ফেলার স্বাধীনতা ভোগ করছে।
এর পর নগরীর নালা-নর্দমাগুলোর কথা ধরা যাক। এমন কোন নালা বা নর্দমা নেই যাতে আবর্জনা পড়ে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে নেই, পচা পানি উপচে উঠে এলাকার জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলছে না। দিনের পর দিন এমন অবস্থা চলছে। এগুলো দেখাশোনার, প্রতিকারের কেউ আছে বলে মনে হয় না। এসব ব্যাপারে উদাহরণ স্বরূপ কোন নির্দিষ্ট স্থানের উল্লেখ করে লাভ নেই। গোটা শহরটা চলছে এভাবে। প্রাচ্যের রানী না হোক, ঢাকা যে এক সময় একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন শান্তিময় শহর ছিল সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশ বিভাগের পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় কলকাতাসহ বিভিন্নস্থান থেকে লোকজন ছুটে আসত এখানে। তারা ঢাকার পরিচ্ছন্ন রূপ দেখে মুগ্ধ হত। এই শহরের বুকে ছড়ানো ছিল অসংখ্য পুকুর, ঝিল, ডোবা ও বিল। শাপলা ও পদ্মফুলের অপূর্ব শোভা, কলমীসহ বিভিন্ন জলজ শাকের সমারোহ আর হরেক জাতের মাছে ভরপুর ছিল এসব ঝিল, বিল, পুকুর, ডোবা। কিন্তু এখন হয়েছে তার উল্টো। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এসব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। ভর্তি হয়ে এসবের বুকে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। যে কয়টা এখনও নামমাত্র টিকে আছে সেগুলো শাপলা, পদ্ম আর মাছের বদলে মলমূত্র, পোকামাকড় আর আবর্জনার আঁস্তাকুড়ে পরিণত হয়ে দুর্গন্ধ আর দূষিত বাতাস ছড়িয়ে জনজীবন করে তুলছে অতিষ্ঠ। রোগব্যাধি প্রসারে সাহায্য করছে বিপুলভাবে। এ ধরনের পুকুর-ডোবার সঠিক সংখ্যা কত তা বলা না গেলেও গোটা শহরে ও আশপাশের এলাকায় এ সংখ্যা যে শ’-এর বেশি হবে এ কথা নিশ্চিত।
ইতোপূর্বে মাঝে মধ্যে নগরীতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে দেখা যেত। তাতে উল্লেখযোগ্য কিছু হতো এমন নয়। তবে জনমনে পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনবোধ যে কিছুটা হলেও জাগত সে কথা সত্য। কিন্তু বর্তমানে সে সবের বালাই নেই। বরং উল্টোটা হচ্ছে। রাজধানীর উপকণ্ঠ নয়, মধ্যেই বলা যায়, নিচু জমি উঁচু করার নামে সায়েদাবাদের পরে চট্টগ্রাম-সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলের দিকে যাওয়ার রাস্তাগুলোর দু’পাশে অনেক দূর পর্যন্ত বছরের পর বছর নগরীর যাবতীয় আবর্জনা ফেলে যে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে তা আশপাশের বিরাট এলাকার মানুষজনের স্বাস্থ্যের পক্ষে কত মারাত্মক সে কতা না বলাই ভাল। নগরীর পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য এখন শুধু কথার কথা, বাস্তবে এ সবের কোন মূল্য আছে এমন মনে হয় না। তা না হলে সারা দুনিয়ার মানুষ পরিবেশের উন্নতি নিয়ে চিন্তিত, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলোর দূরীকরণ ও অনুকূল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যস্ত, সেই সময় আমাদের দেশে চলছে তার ঠিক উল্টো ব্যবস্থা। অবস্থাটা যেন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য দফতর ও পৌর কর্পোরেশনের মত সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর স্বাস্থ্য ভাল থাকলেই হল, সরকারি কাজ ভালভাবেই চলবে-জনগণের কথা বেশি চিন্তা করে লাভ নেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ঢাকা রাজধানী হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাহরাসহ অনেক নামি-দামি ও গুণীজনের আগমন ঘটে প্রায়ই। এই ঢাকা নগরীতেই আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাস এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিস। এ ঢাকা মহানগরীকে একটা সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন বসবাস উপযোগী করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। বিশেষ কোন সংস্থা বা বাহিনী দ্বারা এ কঠিন কাজ সম্পাদন করা কঠিন। আমাদের সকলকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। তাহলেই আসবে সফলতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসবে অসংখ্য পর্যটক এবং আয়ের একটা প্রধান উৎস হতে পারে পর্যটন। কাজেই আর বিলম্ব নয়, এখনই আমাদেরকে তৎপরতা শুরু করতে হবে সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার উদ্দেশ্য।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জনস্বাস্থ্য কি শুধু কথার কথা?
আরও পড়ুন