Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অনিয়ম ও গ্রাহক হয়রানি

ডিপিডিসির জুরাইন কার্যালয়ের দুর্নীতিবাজরা বেপরোয়া জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে : ব্যবস্থাপনা পরিচালক

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ডিপিডিসির জুরাইন অফিস দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কথায় কথায় মিটারে ক্রুটি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের বিল প্রদানের হুমকী দিয়ে গ্রাহককে জিম্মি করে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আবার বড় ধরণের অভিযোগ প্রমানের পরও মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে আপোসের নজিরও রয়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, ভুল রিডিং দিয়ে অতিরিক্ত বিল করে উৎকোচ আদায়, মিটার টেম্পারিং অভিযোগ তুলে হয়রানিসহ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রকৌশলী, সুপারভাইজার, মিটার রিডারসহ এখানকার কর্মচারিরা। এ নিয়ে অভিযোগ করতে গেলে পাল্টা হয়রানির শিকার হতে হয়। এক মাস ধরে জুরাইন বিদ্যুৎ অফিসের আওতাভুক্ত এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে গ্রাহক হয়রানির যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে তা ভয়াবহ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, করোনার মধ্যে গত বছর কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিল অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে। যারা এ কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখনও কারো বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বিল বা মিটারের ক্রুটি দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জুরাইন বিদ্যুৎ অফিসের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মেজবাহ উদ্দিন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জুরাইন অফিসের অনিয়ম, দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রশ্রয়ে বিদ্যুৎ অফিসে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর মধ্যে আছেন সহকারী প্রকৌশলী সাকরুল আলম, সহকারী প্রকৌশলী ওহিদুল হক, উপ-সহকারী প্রকৌশলী এনায়েত হোসেন, সুপারভাইজার সাদ্দাম হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল ফারুক আফ্রাদ, মিটার রিডার আবু সাঈদ, হারুন অর রশিদ, সাখাওয়াতসহ বেশ কয়েকজন। এরা কৌশলে গ্রাহককে ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মধ্যে সহকারী প্রকৌশী মো. সাকরুল আলম (পরিচিত নং ২২১২৩) কে গত ২৪ ডিসেম্বর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক আদেশে ধানমন্ডি অফিসে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই বদলি আটকে গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৮০নং নামা শ্যামপুরের বাসিন্দা মো. মোশারফ হোসেন ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগে বলেছেন, গত ১৫ নভেম্বর জুরাইন বিদ্যুৎ অফিসের ইঞ্জিনিয়ার সাকরুল আলম আমার বাসায় এসে বিদ্যুতের লাইনে ত্রæটি দেখতে পান। কিন্তু সে সময় আমি বাসায় না থাকায় আমার স্ত্রী বার বার অনুরোধ করার পর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর আমি বিদ্যুৎ অফিসে গেলে সহকারী প্রকৌশলী সাকরুল আলম আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। জরিমানা ও বিল বাড়িয়ে করার হুমকী দেন। মোশাররফ তার অভিযোগে বলেছেন, ইঞ্জিনিয়ার সাকরুল আলম কিছু দালালচক্রের মাধ্যমে গ্রাহকদেরকে নানাভাবে হয়রানি করে থাকেন। একই রকম অভিযোগ নামা শ্যামপুরের আরেক গ্রাহক সুলতানের। তিনিও সাকরুল আলমের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি দেখিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ করেছেন ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে। ১৫৩ নং শ্যামপুরের বাসিন্দা মো. মোক্তার হোসেন (গ্রাহক নং ২২৫১৫৬৭৪) তার অভিযোগে বলেছেন, আমার এক কঠারও কম জমির উপর একটি সেমি পাকা বাড়িতে বিদ্যুতের মিটারে কিছু অনিয়ম পায় জুরাইন বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন। যা আমার জানা ছিল না। এ নিয়ে বিদ্যুৎ অফিসে গেলে আমাকে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। যা কোনো অবস্থাতে আমার পক্ষে পরিশোধ করার সম্ভব নয়। মোক্তার নিজেকে বেকার অক্ষম দাবি করে এ বিষয়ে অনুনয় বিনয় করেও কোনো প্রতিকার পান নি। তার পৌনে এক কাঠার বাড়ির সেমি পাকা বাড়ির জন্য সাড়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানার অঙ্ক নিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে। ৬০ নং মুরাদপুরের গ্রাহক জাহানারা বেগমের অভিযোগ, তার বাড়ির মিটারের কোনো অনিয়ম না থাকার পরেও মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে মোটা অঙ্কের বিল চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৪৬৯ নং দক্ষিণ দনিয়ার গ্রাহক কামাল হোসেনের অভিযোগ, তার কাছে থেকে সুপারভাইজার সাদ্দাম হোসেন ও লাইন্যান সাখাওয়াত ঘুষ না পেয়ে মোটা অঙ্কের জরিমানা করেছে। ১৪১৮ নং দনিয়া বাসিন্দা হাকিম মৃধার অভিযোগ মিটারে লোড বৃদ্ধির কথা বলে সুপারভাইজার সাদ্দাম হোসেন ৬৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন। এর সাথে আব্দুল্লাহ আল ফারুক আফ্রাদেরও সংশ্লিষ্টতা আছে। ১২১৬ নং জুরাইনের গ্রাহক মো. হুমায়ুন কবিরের (গ্রাহক নং ২২০২৮২২৭) অভিযোগ, মিটার রিডার হারুন অর রশিদ এবং তারই আপন ভাই জুরাইন বিদ্যুৎ অফিসের সহকারী প্রকৌশলী ওহিদুল হক এর সহযোগীতায় তার মিটারে রিডিং জমা রেখে তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। হুমায়ুন কবিরের মতো আরও কয়েকজন একই রকম অভিযোগ করে বলেন, দুই ভাই মিলে মিটারে বিল জমা করে গ্রাহককে জিম্মি করে অবৈধ পন্থায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ৭৫৪ নং দনিয়ার গ্রাহক সাইফুদ্দিনের (গ্রাহক নং ২২৬৩৩৪২৯) বাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মিটার খুলে নিয়ে যান ইঞ্জিনিয়ার সাকরুল আলম। এর পর তার সমস্যার সমাধান না করে মোটা অঙ্কের বিল করার জন্য হুমকী ধমকী দেন। অন্যদিকে, ১৩৬৯ নং দনিয়ার বাসিন্দা আবুল ফায়েজ ঢালীর (গ্রাহক নং ২২০১৫৮২৭) চার তলা দুই ইউনিটের বাড়িতে বাইপাসের মাধ্যমে অবৈধ সংযোগ পাওয়ার পরও নির্বাহী প্রকৌশলী, সহকারি প্রকৌশলী সাকরুল আলম ও উপ সহকারি প্রকৌশলী এনায়েত হোসেন মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে মাত্র ২৫ হাজার টাকার বিল করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এখনও ওই বাড়িতে অবৈধ সংযোগ অব্যাহত রয়েছে।

গ্রাহক সুলতানা বেগম এবং ব্যবহারকারি আক্তার হোসেনের (গ্রাহক নং ২২৩১৩৯৩৮) বাড়িতে গত ৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ জোনের টাস্কফোর্স প্রধান কামাল হোসেন পরিদর্শন করে। সেখানে তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো অনিয়ম পাননি। সে হিসাবে প্রতিবেদনও দাখিল করেন। কিন্তু টাস্কফোর্স প্রধানের প্রতিবেদনকে উপেক্ষা করে নির্বাহী প্রকৌশলীর নির্দেশে সহকারী প্রকৌশলী ওই বাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মিটার খুলে নিয়ে আসেন। এরপর তারা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন বলে অভিযোগ আছে।

এদিকে, কিছুদিন আগে মিটার রিডার আবু সাঈদ জাপানী বাজার এলাকার আব্দুল মাজেদ নামে এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের বাড়িতে নতুন মিটার লাগানোর কথা বলে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে যান। দু’চারদিনের মধ্যেই তিনি মিটার লাগিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এক মাস অতিক্রম হওয়ার পর শিক্ষক আব্দুল মাজেদ অভিযোগ করেন। এরপর সাঈদ সেই টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন। জানা গেছে, এই আবু সাঈদ এক সময় জুরাইন অফিসের সিউিরিটি গার্ড ছিল। মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে সে এখন মিটার রিডার। কোটি টাকার মালিক সাঈদের কদমতলীর গ্যাস রোডে সাত তলা বাড়ি নির্মাণাধীন আছে। তেঘড়িয়া এলাকার কলম ফ্যাক্টরীর পাশে ১২ কাঠা জমি রয়েছে তার। কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছনেও তার একটা মার্কেট রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে তার রয়েছে লাখ লাখ টাকার সম্পদ। আব্দুল কাইয়ুম (গ্রাহক নং ২২০৯৪৭৯৫) নামে এক গ্রাহকের অভিযোগ, আবু সাঈদ তার কাছে থেকে নতুন মিটার লাগানোর কথা বলে ১৫ হাজার টাকা নিয়েও মিটার দেয়নি। এ ছাড়া নতুন সংযোগ দেয়ার কথা বলে বহু গ্রাহকের কাছে থেকে কয়েক লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগ আছে সাঈদের বিরুদ্ধে। একজন ভুক্তভোগি বলেন, সাঈদ আমার টাকা নিয়ে নয়ছয় করার পর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি।

ভুক্তভোগিরা জানান, জুরাইন অফিসের অধীনে এলাকাগুলোতে এখন লোডশেডিং নিত্যনৈমিত্তক ঘটনা। শীতের মধ্যেও দিনে কয়েকবার লোডশেডিং হয়। এ নিয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলে না। এসব অভিযোগের বিষয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, যারা এ ধরণের কাছে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ