Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিন্ডিকেটের কবলে রূপালী ব্যাংক

প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৪ পিএম, ২৭ আগস্ট, ২০১৬

৩ মাসে প্রভিশন ঘাটতি ৭৭৬ কোটি টাকা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার : সব রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি কমলেও বেড়েছে রূপালী ব্যাংকে। এজন্য ব্যাংকের একটি সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন রূপালী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সিন্ডিকেটটির কারণে গত তিন মাসে কোনো ঋণ নবায়ন হয়নি। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। যার কারণে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতি।
জুন ২০১৬ হিসাব অনুযায়ী, সোনালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক, বিডিবিএল ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতি কমিয়ে আনলেও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে রূপালী ব্যাংকের। গত মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি তো ছিল না, উল্টো উদ্বৃত্ত ছিল ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। জুন শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৭৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের তিন গুণ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, গত মার্চে জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২৩১ কোটি টাকা থাকলেও জুনে এসে কোনো ঘাটতিতে নেই ব্যাংকটি। আলোচিত বেসিক ব্যাংক আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রভিশন ঘাটতি কমিয়েছে ২৫ কোটি টাকা।
গত প্রান্তিকের চেয়ে সোনালী ব্যাংক ৫৯৩ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি কমিয়ে এনেছে। অগ্রণী ব্যাংক ও বিডিবিএলের প্রভিশন ঘাটতিও কমেছে। রূপালী ব্যাংকের অস্বাভাবিক হারে প্রভিশন ঘাটতি বৃদ্ধির কারণ জানতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় ও কর্পোরেট শাখায় কয়েক দিন ধরে ঘুরে জানা গেছে, গত দু’মাস ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করেন দেবাশীষ চক্রবর্তী যিনি কোনো ঋণ ফাইলে স্বাক্ষর করেননি। আর ব্যাংকটির আন্তর্জাতিক বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হাসনে আলমের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যারা কোন ঋণ নবায়ন, রিসিডিউল, কিংবা অনুমোদিত ঋণও ছাড় করতে দিচ্ছেন না। যার ফলে নিয়মিত ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
কেস স্টাডি-১ : রমনা কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ব্রহ্মপুত্র ট্রেডিং কর্পোরেশন। এটি গত তিন বছর ওই শাখার সবচেয়ে ভাল গ্রাহক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার ঋণের পরিমাণ ৫ কোটি টাকা, যা নবায়ন ও বৃদ্ধির জন্য ডিসেম্বর মাসে প্রধান কার্যালয়ে এলেও হাসনে আলমের সিন্ডিকেট এই ঋণটি আটকিয়ে রাখে প্রায় ৭ মাস। এতে তিনি জুন প্রান্তিকে খেলাপিতে পরিণত হয়েছেন। একই শাখার গ্রাহক ডিএসএল সোয়েটারকেও খেলাপিতে পরিণত করেছে এই সিন্ডিকেট। যার ঋণের পরিমান ৩৬ কোটি টাকা। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে কথা বলতে রাজি হননি।
কেস স্টাডি-২ : পুরান ঢাকার জনসন রোড শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ছৈয়দিয়া রাইস মিল যার ঋণের পরিমান ৩৫ কোটি টাকা। যার বিপরীতে তার ফেনী সদরের ২৭২ শতাংশ জমি বন্ধকী দেওয়া রয়েছে। এছাড়া পর্যটন কেন্দ্র শ্রীমঙ্গল ও অন্যান্য জায়গার বিপুল পরিমাণ জামানত দিয়ে আবৃত করা আছে ঋণটি। এই গ্রাহককে ‘নিঃস্ব’ করতে হাসনে আলমের সিন্ডিকেট নিয়মনীতির তোয়ক্কা না করে নোটিশ ছাড়াই জমি নিলামে তোলেন। পরবর্তীতে গ্রাহক শাখায় যোগাযোগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মানুসারে নির্ধারিত ডাউন পেমেন্ট জমা দিলেও ঋণটির রিসিডিউল প্রস্তাব শাখা থেকে এখনো আঞ্চলিক অফিসেই যায়নি।
এছাড়া রূপালী সদন কর্পোরেট শাখার গ্রাহক শীতল স্টিল মিল, পল্টন কর্পোরেট শাখার চেীধুরী লেদার, রংপুরের ময়নাকুঠি, নীলসাগরসহ ১৩৭টি বড় গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের ঋণ নবায়ন না করায় তারা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপি বৃদ্ধি পাওয়ায় হঠাৎ এই অস্বাভাবিক প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির হিসাব বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
এবিষয়ে ছৈয়দিয়া রাইস মিলের মালিক মিলন জানান, হাসনে আলম ঋণ বাছাই কমিটির সদস্য সচিব। তিনি সুদের ব্যাংকিং পছন্দ করেন না। তাই সদ্য বিদায়ী এমডি চলে যাওয়ার পর তিনি প্রত্যেক জোনাল অফিসকে ঋণ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এমনকি প্রধান কার্যালয়ের এসএমই এবং আইসিডি বিভাগের সকল ডিলিং অফিসারকে তার রুমে ডেকে কিছু সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নজির দেখিয়ে কোনো ঋণ ফাইলে স্বাক্ষর না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন, যার ফলে কেউ আর ঋণ নিয়ে মাথা ঘামায় না।
সোনালী অগ্রণী জনতাসহ অন্যান্য বাণিজ্যক ব্যাংক সম্প্রতি মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিনিয়োগ ক্ষমতা বৃদ্ধি করলেও রূপালী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি দেবাশীষ চক্রবর্তী উল্টো কাজ করেছেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভাগীয় মহাব্যবস্থাপকদের ঋণ ক্ষমতা ২ কোটি থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকা করেছেন।
হাসনে আলম সিন্ডিকেটের সদস্য ডিজিএম জাহাঙ্গীরকে সম্প্রতি জিএম (চলতি) করা হয়েছে। এখানেও নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের মানবসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ডিজিএমকে জিএম (চলতি দায়িত্ব) করার ক্ষমতা একমাত্র নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরই আছে। তাছাড়া অনুমতি লাগে পরিচালনা পরিষদ। কিন্তু একই সিন্ডিকেটের সদস্য বিধায় নিয়ম-নীতির তোয়ক্কা না করে জিএম করে রংপুরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
হাসনে আলমের কথা না শুনলে তার ওপর বদলির খড়্্গ নামান মানবসম্পদ বিভাগের জিএম আব্দুল মজিদ শেখ। সম্প্রতি হাসনে আলমের নিষেধ উপেক্ষা করে ঋণ ফাইলে স্বাক্ষর করেছিলেন খুলনা সহকারী-মহাব্যবস্থাপক বায়োজিদ মোল্যা। মাত্র ৫ লাখ টাকার ঋণ ফাইলে স্বাক্ষর করার অপরাধে ওই দিনই তাকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে বরিশালে, যা করেছেন আব্দুল মজিদ শেখ।
হাসনে আলমের সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্য হচ্ছেনÑজিএম আব্দুল মজিদ শেখ, সুলতানা মনোয়ারা, কায়সুল হক, ডিজিএম মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর, আবুল বাশার মজুমদার, রবিউল হক ভূইয়া, এজিএম নাজমুল ও হালিম। তারা সবাই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ব্যাংক শাখার নেতা বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে হাসনে আলম বলেন, আমাদের চীফ এক্সিকিউটিভের অনুমতি ছাড়া আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
কায়সূল হক ইসলামী ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা। তার অন্যতম অনুসারী নাজমূল ৯৬-৯৮ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। আব্দুল মজিদ শেখ ও আব্দুল হালিম জামায়াতের ‘রোকন’ বলে জানা গেছে।
গ্রাহকের অর্থের সুরক্ষা দিতে ব্যাংকগুলোর ঋণের ঝুঁকি বিবেচনা করে তার বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয়। এ কারণে খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকের প্রভিশন রাখার প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। প্রভিশন ঘাটতি রেখে কোনো ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এ ছাড়া বর্তমান আইনে কোনো ব্যাংকে টানা দু’বছর ঘাটতি থাকলে ওই ব্যাংককে বড় অঙ্কের জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিন্ডিকেটের কবলে রূপালী ব্যাংক
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ