Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বুরকা ও বিকিনি কী করে বুরকিনি হলো

প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : ফ্রান্সের সমুদ্র তীরবর্তী কয়েকটি শহর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাদের সমুদ্র সৈকতে মহিলাদের বুরকিনি পরা নিষিদ্ধ করেছে। বুরকিনি হচ্ছে এমন সাঁতারের পোশাক যাতে মুখ এবং হাত ও পায়ের পাতা ছাড়া শরীরের বাকি সব অংশ ঢাকা থাকে। এ সপ্তাহে যে ঘটনাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় তা হচ্ছে নাইসের পুলিশের একটি ছবি, যা দেখে মনে হয় যে তারা এক মহিলাকে তার বডিস্যুটের ওপর পরিহিত ব্লাউজ খুলতে বাধ্য করছে।
বুরকিনি হচ্ছে কিছু মুসলিম দেশে নারীদের পরা বুরকা ও বিকিনির সমন্বিত রূপ। এর ডিজাইনার হচ্ছেন আহেদা জ্যানেট্টি। ফ্রান্সের ভিলেনিউভ-লুবে শহরে বুরকিনি পরার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ফ্রান্সের শীর্ষ প্রশাসনিক আদালত বাতিল করেছেন। এ সিদ্ধান্ত ফ্রান্সের অন্যান্য শহরে আরোপিত বুরকিনির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে পূর্বনজির হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফ্রান্স তার ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে বুরকিনি হচ্ছে তার সর্বশেষ ঘটনা। ফ্রান্স হচ্ছে ইউরোপের মধ্যে প্রথম দেশ যে বুরকা ও নেকাব আবরণ নিষিদ্ধ করে। সাত বছর আগে দেশটি রাষ্ট্র পরিচালিত স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য পর্দাসহ সকল ধরনের ধর্মীয় প্রতীক পরিধান নিষিদ্ধ করে।
বুরকা
পবিত্র কুরআনে সুনির্দিষ্টভাবে বুরকার উল্লেখ করা হয়নি। কুরআনে নারী ও পুরুষের প্রকাশ্যে শালীন আচরণ ও শালীন পোশাক পরার কথা বলা হয়েছে। তবে শরীরের কোনো কোনো অংশ আবৃত করতে হবে তা ব্যাখ্যার বিষয়। ড্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ববিদ কেইটলিন কিলিয়ান বলেন, এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ইসলামী পোশাকের উদ্ভব ঘটেছে যাতে স্থানীয় ঐতিহ্য ও ইসলামী প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন ব্যাখ্যারও প্রতিফলন ঘটেছে।
কুরআনে পর্দা সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘(হে নারীগণ!) তোমরা তোমাদের ঘরের (বাড়ির চতুর্সীমানার) ভেতর অবস্থান কর এবং বাইরে বের হয়ো না, যেমন ইসলামপূর্ব জাহিলি যুগের মেয়েরা বের হতো।’ (সূরা আহযাব, আয়াত : ৪৩)
অন্যত্র, ‘(হে নবী!) আপনি আপনার পতœীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, যখন কোনো প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়, তখন তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। (যেন পর্দার ফরজ লঙ্ঘন না করে। এমনকি চেহারাও যেন খোলা না রাখে। তারা যেন বড় চাদরের ঘোমটা দ্বারা নিজেদের চেহারাকে আবৃত করে রাখে।) ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব, আয়াত : ৬০)
কুরআনে আরো বলা হয়েছে : ‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানসমূহের হিফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে, আল্লাহ তা অবহিত আছেন। আর ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানসমূহের হিফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের ওড়না বক্ষদেশে দিয়ে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে।’ (সূরা নূর, আয়াত : ৩০-৩১)
কুরআনে উপরের পর্দাকে খিমার বলা হয়েছে, যা হিজাবের বদলে মস্তকাবরণ, যাকে আক্ষরিকভাবে পার্টিশন বা পরদা বলা যায় এবং তা শালীনতা রক্ষার ব্যাপক নীতিগত দিকের পরিচায়ক। কিলিয়ান লিখেছেন, পরদা ইসলামপূর্ব যুগের বিষয় এবং বিভিন্ন ধর্মের মহিলারা তা পালন করত। সেইসাথে তা শ্রেণি অবস্থানের সাথেও সংযুক্ত ছিল। ধনী নারীরা সম্পূর্ণরূপে শরীর ঢাকা পর্দা করত, কিন্তু দরিদ্র নারীরা যাদের কাজ করতে হতো তারা তাদের পরদা ছোট করত অথবা একেবারেই করত না।
আজকাল ইসলামের ঐতিহ্যবাহী প্রথা অনুসরণকারীরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুরকা পরিধান করে।
বিকিনি
আজ যাকে আমরা বিকিনি বলে জানি তার উদ্ভব ১৯৪৬ সালে। এর ডিজাইনার হলেন ফরাসি লুই রিয়ার্ড। তিনি মার্শাল দ্বীপের বিকিনি প্রবাল প্রাচীরে আণবিক বোমা পরীক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ নামটি গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আণবিক বোমা যেমন ভূরাজনীতিকে প্রচ- কাঁপিয়ে দিয়েছিল তেমনি এ স্বল্পাকৃতির বসনও সংস্কৃতিকে প্রবল ধাক্কা দেবে ও কম্পন তুলবে এ ধারণায় তিনি এ নামটি পছন্দ করেন।
একই সাথে সহকর্মী ডিজাইনার জ্যাকস হেইম টু পিস পোশাককে এটম বলে আখ্যায়িত করেন।
তবে স্মিথসোনিয়ান সাময়িকী উল্লেখ করেছে, বিকিনির ইতিহাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালকে ছাড়িয়ে অতীতের আরো গভীরে প্রসারিত। সাময়িকী রোমে চতুর্থ শতকের রেখাচিত্রে দেখা যায়, সে দেশের নারীরা ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে দু’টুকরো অ্যাথলেটিক পোশাক পরতেন। রিয়ার্ডের পোশাক আরো কিছুটা দুঃসাহসী। তিনি ঘোষণা করেন যে বিকিনি পোশাককে ততক্ষণ পর্যন্ত খাঁটি বলা যাবে না যতক্ষণ না তা একটি আংটির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করানো যায়।
১৯৫০-এর আগে স্পেন ও ইতালি তাদের সমুদ্র সৈকতে মহিলাদের বিকিনি পরা নিষিদ্ধ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ভ্যাটিকান একে পাপপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করে। ষাটের দশকে এটা সাগর তীরে পরার পোশাক বলে গৃহীত হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে বাধার সম্মুখীন হয়। আজ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অধিকাংশ স্থানেই কেউ আর বিকিনির দিকে বাঁকা চোখে তাকায় না।
বুরকিনি
লেবাননী-অস্ট্রেলিয়ান ডিজাইনার আহেদা জ্যানেট্টি বুরকিনির ডিজাইন করেন এবং ২০০৪ সালে বুরকা ও বিকিনির সমন্বয়ে বুরকিনি নামকরণ করেন। তিনি বলেন, আমাকে বুরকা শব্দটির দিকে দৃষ্টি দিতে হয়েছিল। এটাকে এক ধরনের কোট বা কভার-অল হিসেবে গণ্য করে অন্যদিকে বিকিনিকে রেখে আমি এ দুয়ের সমন্বয় করি।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েদের জন্য বাইরে পা রাখা ভয়ের ব্যাপার। তাদের পক্ষে খোলামেলা সুইমিং পুল, সমুদ্র সৈকত বা এ রকম স্থানে যাওয়া ভীতিকর। আমি চেয়েছি তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে, আমি চেয়েছি ইতিবাচক কিছু করতে। যে কেউই আমার বুরকিনি পরতে পারে; খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু যে কেউই। এটি হচ্ছে একটি শালীন পোশাক। যার স্কিন ক্যান্সার আছে অথবা কোনো নতুন মা যে বিকিনি পরতে চায় না তার জন্যও। এটি ইসলামী পোশাকের প্রতীক নয়।
জ্যানেট্টি বলেন, ৪০ শতাংশ বুরকিনিই অমুসলিম নারীরা কেনে। পলিটিকো সাময়িকীকে তিনি বলেন, ইহুদি নারীরা এটাকে লুফে নিয়েছে। আমি মরমনদেরও এটা পরতে দেখেছি। এক বৌদ্ধ নান তার সব বন্ধুদের জন্য এটা কিনেছে। আমি দেখেছি যেসব মহিলার স্কিন ক্যানসার আছে, অথবা শরীরে দাগ আছে, নতুন মায়েরা, নিজেদের ত্বক দেখাতে অস্বস্তি বোধ করে এমন মায়েরাÑসবাই এটা পরে। সূত্র কোয়ার্টজ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বুরকা ও বিকিনি কী করে বুরকিনি হলো
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ