Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিত্যপণ্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে

প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এম. কে. দোলন বিশ্বাস
পাতে ডাল না পড়লে বাঙালির ভোজনে পূর্ণতা আসে না। তবে মসুর ডালের যে দাম তাতে মাসে ৩০ দিন ডাল-ভাত খাওয়ার আগে অনেক পরিবারকেই এখন অন্তত দু’বার ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন মসুর ডালের দাম কম হলেও দেশের বাজারে তা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আর হেঁসেলঘরে যে দুই উপকরণ না থাকলে ডাল রান্নাই সম্ভব নয়, সেই তেল ও লবণের দামও বেড়েছে কয়েক গুণ। পাশাপাশি চিনির দরও লাগামছাড়া। চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করার অজুহাতে রিফাইনারিগুলো এ দুই পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। গত এক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দাম এক-তৃতীয়াংশ কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। উল্টো দাম বেড়েছে। আর অপরিশোধিত লবণের দাম বাড়ার অজুহাতে দেশের বাজারে লবণের দাম কেজিপ্রতি বেড়ে ৩৫ টাকায় পৌঁছেছে।
গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, হঠাৎ নিত্যপ্রয়াজনীয় ওইসব পণ্যের দাম বাড়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসছেন। ইতোমধ্যে ভোজ্য তেল, চিনির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ভোক্তা পর্যায়ে এ দুই পণ্যের দাম কত হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন থেকে প্রতিবেদন নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। উভয় পণ্যের ক্ষেত্রেই আমদানি মূল্য, পরিশোধন ব্যয় এবং সরকারের শুল্ক-করাদিসহ উৎপাদন খরচ হিসাব করে ট্যারিফ কমিশন দেখিয়েছে, রিফাইনারিগুলো অযৌক্তিক হারে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। সরকারের অন্য সংস্থাগুলোও একই মতামত দিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, গত জুলাই মাসের শেষের দিকে রিফাইনারিগুলো হঠাৎ তেল ও চিনির মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আগাম কোনো আলোচনা করেননি মিল মালিকরা। মূল্য বাড়ানোর কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাত এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মুনাফা দ্বিগুণ করার তথ্য তুলে ধরে ট্যারিফ কমিশনে একটি আবেদন পাঠিয়েছেন মিল মালিকরা। তাতে নিজেদের মুনাফাও দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার পণ্যের দাম যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সে জন্য চিনির ওপর আরোপিত ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারেরও দাবি করেছেন তারা। অবশ্য বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের বিরোধিতা করে বলেছে, রিফাইনারিগুলো কম দামে আমদানি করা চিনি অধিক মুনাফায় অযৌক্তিকভাবে বেশি দরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে।
ভোজ্য তেল ও চিনির রিফাইনারিগুলো আগে ১ শতাংশ মুনাফা ধরে পণ্যের দাম নির্ধারণ করত। এখন তা ২ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। কেজিপ্রতি পণ্যের দাম নির্ধারণে পরিবেশকদের মুনাফা দুই টাকা থেকে চার টাকা এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের মুনাফা দুই টাকা থেকে চার টাকা করার প্রস্তাব করেছে। রিফাইনারিগুলো তেল ও চিনি আমদানির ব্যয় ব্যাংক ঋণ হিসেবে দেখিয়ে পণ্যমূল্য হিসাবে ১২ শতাংশ হারে ঋণের সুদ যোগ করে। কিন্তু আদতে পণ্য আমদানির জন্য রিফাইনারিগুলোকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় না। ডিও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পণ্যের আগাম দাম নিয়ে তা দিয়ে পণ্য আমদানি করেন তারা। ফলে তেল ও চিনির মূল্যে রিফাইনারি কম্পানিগুলোর প্রকৃত মুনাফার হার দুই অঙ্কের ঘরে। গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত রিফাইনারি মিলগুলোর চিনি আমদানির তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন জানিয়েছে, রিফাইনারিগুলো কম দামে আমদানি করা চিনি অধিক মুনাফায় অযৌক্তিকভাবে বেশি দরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে। বর্তমানে বাজারে যে দরে চিনি বিক্রি করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই প্রতি টন ৫০ থেকে ৫২ হাজার (প্রতি কেজি ৫০-৫২) টাকার বেশি হওয়ার যৌক্তিকতা নেই।
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের মতের সঙ্গে একমত বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনও। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে ট্যারিফ কমিশন বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দর বাড়লেও বাংলাদেশের চিনিকলগুলো কম দামে আগেই প্রায় সাত লাখ টন অতিরিক্ত চিনি আমদানি করে রেখেছে। মিল গেটে ওই চিনির মূল্য কোনো মতেই কেজিপ্রতি ৫৮ থেকে ৫৯ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এর সঙ্গে কেজিতে পরিবেশক বা পাইকারি ব্যবসায়ীর দুই টাকা, আর খুচরা ব্যবসায়ীর তিন টাকা মুনাফা ধরলে চিনির বাজারদর হওয়ার কথা প্রতি কেজি ৬৩-৬৫ টাকার মধ্যে। কিন্তু মিল মালিকরা মিল গেটে ৬২ থেকে ৬৪ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করছেন। এর সঙ্গে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীর মুনাফা যোগ হয়ে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৭২-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা অযৌক্তিক।
চিনির দর নির্ধারণ পদ্ধতি হলো আগের মাসে যে দরে আমদানি করা চিনি খালাস হয়েছে এবং যে দরে চিনি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে, তার গড় মূল্য। তাতে জুলাইয়ে টনপ্রতি ৩৮৬ ডলার দরে আমদানি হওয়া চিনি খালাস হয়েছে। আর এলসি খোলা হয়েছে ৪৭০ ডলার দরে। এ দুটির গড় করলে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির দর পড়ে ৪২৮ ডলার। এর সঙ্গে পরিশোধন ব্যয়, শুল্ককর ও ভ্যাট, অন্যান্য খরচ এবং কম্পানির মুনাফা যোগ করে প্রতি কেজি চিনির মিল গেট মূল্য সর্বোচ্চ ৫৮-৫৯ টাকা হতে পারে। এর সঙ্গে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগ করলে কেজিপ্রতি ৬৪-৬৫ টাকায় চিনি বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু মিল গেটেই এখন প্রতি কেজি চিনির দাম নেয়া হচ্ছে ৬২-৬৪ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত ১০ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির দর ৩৯ হাজার ৩৪০ টাকা। এক বছর আগে এর দর ছিল ৩০ হাজার ৯৪৬ টাকা। ১০ আগস্ট পরিশোধিত চিনির দর ছিল টনপ্রতি ৪৬ হাজার ৪৫০ টাকা। এক বছর আগে এর দর ছিল ৩৮ হাজার ৮৫ টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জুলাইয়ে প্রতি কেজি ৩৭ টাকা দরে অপরিশোধিত চিনির এলসি খোলা হয়েছে। আর এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ২৫ টাকা দরে।
গত জুলাই মাসের শেষের দিকে হঠাৎ দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম লিটারে দুই থেকে চার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে এ কাজ করেছেন তারা। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত ১১ আগস্ট প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৯২ থেকে ৯৬ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে জানান, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে ভোজ্য তেলের এই মূল্য বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম সপ্তাহখানেক আগে বাড়তে শুরু করেছে। বর্ধিত দামে তেল আমদানি করার আগেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে রিফাইনারিগুলো। ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে, গত ১০ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দর ছিল ৫৯ হাজার ৬০১ টাকা। এক সপ্তাহ আগে এ মূল্য ছিল ৫৬ হাজার ৫৫৩ টাকা। এক মাস আগে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৫৭ হাজার ৪২৪ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিপার্টমেন্টের তথ্য মতে, গত জুলাইয়ে ৫৯ টাকা কেজি দরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানির এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা, আর তা নিষ্পত্তি করেছেন ৪৯ টাকা কেজি দরে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী, দেশের ভেতরে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ ৮৮ থেকে ৮৯ টাকা হলে তা যৌক্তিক। অথচ তা বিক্রি করা হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৬ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতি লিটার তেলে ভোক্তাদের চার থেকে সাত টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম ৩৫ শতাংশ কমেছে। গত ১০ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি মসুর ডালের দাম ছিল ৫০ হাজার ৪৪০ টাকা। গত মাসের এই দিনে টনপ্রতি মসুর ডালের আন্তর্জাতিক দর ছিল ৭৭ হাজার ৯০৭ টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দর কমেছে ৩৫.২৫ শতাংশ। আর গত এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দর কমেছে ২৩.৮৪ শতাংশ। গত বছর ১০ আগস্ট প্রতি টন মসুর ডালের আন্তর্জাতিক দর ছিল ৬৬ হাজার ২২৫ টাকা। কিন্তু দেশের বাজারে গত এক মাসে দাম এক টাকাও কমেনি। বছরওয়ারি হিসাব করলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ২৪ শতাংশ দরপতন হলেও দেশের ভেতরে দাম বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টের হিসাবে, গত জুলাইয়ে ৭১ টাকা কেজি দরে মসুর ডাল আমদানির এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। আর এই সময়ে মসুর ডাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে প্রতি কেজি ৮২ টাকা দরে। টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, এক মাস ধরে দেশের বাজারে মানভেদে মসুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এক বছর আগে দাম ছিল ৯৫ থেকে ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশের বাজারে মসুর ডালের দর বেড়েছে ৮.৭০ শতাংশ।
টিসিবির বাজারদরের তথ্য অনুযায়ী, বাজারে প্রতি কেজি পরিশোধিত লবণের দাম এখন ২৫ টাকা থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। গত বছর এই সময়ে প্রতি কেজি লবণের দাম ছিল ১৫ থেকে ২৮ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে লবণের দাম বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। এ অবস্থায় দেশের বাজারে কাঁচা লবণের দাম বাড়ার কারণে খাবার লবণের দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ লবণ আমদানি করে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, লবণের মৌসুমে দেশে অপরিশোধিত বা কাঁচা লবণের দাম থাকে কেজিপ্রতি চার টাকা। সেই লবণ পরিশোধনের পর বাজারে ছাড়েন লবণ কল মালিকরা। কিন্তু এখন লবণের মৌসুম শেষ। নতুন মৌসুম শুরু হবে আগামী নভেম্বরে। এ সময়টায় কাঁচা লবণের সরবরাহ কম থাকে। চাষিদের কাছ থেকে মৌসুমের সময় কম দামে কিনে মজুদ করে রাখা ফড়িয়ারা এখন বেশি দরে সেই কাঁচা লবণ বিক্রি করছে লবণ কল মালিকদের কাছে। আর তাতেই লবণের দাম বেড়েছে।
আমরা মনে করি, একটি দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে গেলে নিশ্চয় সেদেশের নিত্যদ্রব্যাদির মূল্য সাধারণত জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশে যেনো বাস্তবতা একেবারে উল্টো। এ পরিস্থিতি থেকে অতিদ্রুত উত্তোরণ ঘটানোই হবে সবার জন্য মঙ্গলকর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিত্যপণ্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে
আরও পড়ুন