পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
এ এফ এম ফারুক-চান মিয়া, ছাতক থেকে : সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে এক সময়ে ছিল ছাতকের ব্যাপক বিস্তৃতি। ১৯৮৪ সালে উপজেলা পরিষদ গঠনের পর ১৩ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয় ছাতক ও ৭টি উপজেলা নিয়ে গঠিত হয় দোয়ারাবাজার উপজেলা। কোম্পানীগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হয় আরো কয়েকটি ইউনিয়ন। এখন দোয়ারাবাজারের বাংলাবাজার ইউনিয়নের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি হচ্ছে বাঁশতলা। ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া রাজ্যের পাদদেশে অবস্থিত বাঁশতলা বাংলাদেশের একমাত্র ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু ১১টি সেক্টরের মধ্যে ১০টি সেক্টরই ছিল ভারতের অভ্যন্তরে। আর দেশের মধ্যে একটি সেক্টরই ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যার নাম ঐতিহাসিক বাঁশতলা।
সর্বমহলে বাঁশতলা এখন পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত। কিছুদিন আগেও এ বাঁশতলার ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেকে অবগত ছিল না। কিন্তু এখন বাঁশতলা রুচিশীল প্রকৃতি প্রেমিদের মন কেড়েছে। ছাতকের সুরমা নদী পার হয়ে নোয়ারাইবাজার থেকে যেতে হয় বাঁশতলা। নদী পার হতে লাফার্জ ঘাটে ফেরি ও শহরের পশ্চিম বাজারে রয়েছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। এরপর সিএনজি চালিত অটোরিক্সা অথবা নিজেদের যানবাহনে বালিউরা ও বাংলাবাজার অতিক্রম করে প্রায় আড়াই ঘন্টা পথ চলার পর গারো পল্লীর দেখা মিলবে। এখানকার নোয়ারাই-বাংলাবাজার ১৩ কিঃমিঃ সড়কটি প্রায় ২৬ বছর আগের। দীর্ঘদিন থেকে এটি সংস্কার না হওয়ায় পাকা সড়ক ভেঙ্গে এখন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। ফলে ৩০ মিনিটের রাস্তা যেতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা। এখানে ভারতীয় সীমানার কোল ঘেঁষে পাহাড়ের উপর গারো জাতির বসবাস। তাদের সাজানো-গোছানো ঘর-বাড়ির পরিবেশ অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের সীমান্ত। এখানের চারদিকে সবুজের সমারোহ। বিকেল বেলা পাখিদের কলরব ও বাতাসের মনমাতানো শব্দে প্রাণ জুড়ায়। ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ে সাজানো বিস্তীর্ণ এলাকা। দেখলে মনে হবে কেউ যেন চারদিকে সবুজ রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। ভারত সীমান্তে পাহাড়ী ঝরনা চোখে পড়ার মত। এখান থেকে ফিরে হকনগরস্থ মৌলা নদীর উপর সøুইস গেট দর্শন না করে যাওয়া যায় না। ১ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০০৫ সালে এটি নির্মিত হয়। যদিও নদী শাসন প্রকৃতি বিরোধী তবুও বয়ে চলা পাহাড়ি ঝরনার মাঝে এ সøুইস গেট আলাদা সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। এখানে ঠা-া ও শীতল স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটলে সহজেই শরীরের ক্লান্তি দূর করে। সøুইস গেটে পানির মনোহারি শব্দে গোটা এলাকা যেন মুখরিত হয়ে আছে। সøুইস গেট ছাড়িয়ে কিছুটা সামনে গেলই দেখা মিলবে মুক্তিযুদ্ধের ৫ নং সদর সেক্টর। এখানে কিছুটা ত্রিভুজ আকৃতির শহীদ মিনারের বেদিতে বসলে প্রাকৃতিক ঠা-া বাতাস মন ছুঁয়ে যাওয়ার মত। এখনাকার আশপাশের পরিবেশ খুবই মনোরম। সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশের মিতালি দেখে মনে হবে যেন ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়।’
সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলাটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ও পর্যটকদের আকর্ষণ করার এক অতুলনীয় পরিবেশ এখানে। এখানে রয়েছে টেংরা টিলা গ্যাস ফিল্ড, খাসিয়া মারা নদীর উপর রাবার ড্যাম, মারপসি খালের উপর বক্স সøুইস গেট, বাংলাবাজার উপ-প্রকল্পে হাইড্রোলিক ট্রাকচার ও এন্ড এম সেড, বাঁশতলা হক নগর শহীদ স্মৃতি সৌধ, আদিবাসী পাহাড়, মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক, বীরাঙ্গনাসহ আরো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এখানে যাবার দু’টি রাস্তা হচ্ছে, (১) ছাতক শহরের নোয়ারাই বাজার থেকে এবং (২) দোয়ারাবাজার সদর থেকে সিএনজি অটো রিক্সা, অটো টেম্পু ও ভাড়ায় মোটর সাইকেল পাওয়া যায়। এখানকার মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। দোয়ারাবাজারের অদূরে বাংলাবাজার ইউনিয়নের বৃহত্তর গ্রাম হচ্ছে কলাউরা। গ্রামটি পাড়ি দিলেই চোখে পড়ে আকাশের সাথে যেন পাহাড়ের চির মিতালী। এখানে ভারত থেকে নেমে আসা মৌলা নদীর উপর নির্মিত সøুইস গেট, ৩দিকে মেঘালয় পাহাড়ে ঘেরা বাঁশতলা স্মৃতি সৌধ, পাহাড়ি ঝরনার কলরব, পাখ-পাখালির কুহু কুহু ডাকে মনের মণিকোঠায় স্পন্দন জাগে। বলতে গেলে বাঁশতলায় মনোমুগ্ধকর অসাধরণ এক পরিবেশ বিরাজমান। যা পর্যটকদের নজর কাড়ার মতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন হেলাল পাহাড় বেষ্টিত এই এলাকায় ৫নং সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন।
জানা গেছে, বাঁশতলাসহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় যারা শহীদ হয়েছেন এখানেই তাদের সমাহিত করা হয়। এসব শহীদের স্মৃতি অমøান করে রাখার জন্যে হকনগর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সরকারী অর্থায়নে হকনগর স্মৃতি সৌধ এলাকায় পর্যটকদের জন্যে নির্মাণ করা হয়েছে, একটি রেষ্ট হাউজ, হকনগর কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা। স্মৃতি সৌধের পাশে রয়েছে দু’শতাধিক বছরের পুরোনো আদিবাসী পাহাড়। এখানে রয়েছে গারোদের বসবাস। পাহাড়ে উঠলে প্রকৃতির প্রকৃত চেহারা অবলোকন করতে প্রত্যহ হাজারো প্রকৃতি প্রেমীরা এখানে এসে জড়ো হয়। ঝুমগাঁও এলাকায় বসবাস করে আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের প্রায় ২৫টি পরিবার। তারা নিজ হাতে তৈরী করে নিজেদের ব্যবহার্য যাবতীয় আসবাবপত্র। গারো পাহাড়ে রয়েছে একটি মিশনারী স্কুল, একটি উপাসনালয় ও পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্যে সরকারী অর্থায়নে নির্মিত একটি সিঁড়ি। সব মিলিয়ে পর্যটকদের মন কাড়ার মতো এখানকার পরিবেশ।
কিন্তু সব কিছুকে মøান করে দিয়েছে একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। দু’টি রাস্তাই চলাচলের ক্ষেত্রে এখন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সুরমা ব্রিজের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক-দোয়ারাবাজার ও ছাতক-বাংলাবাজার-বাঁশতলা সড়কে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। এখানে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ খুবই অতিথিপরায়ণ। যুদ্ধের সময়ে যেভাবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছেন সেই ধারাবাহিকতায় এখনো তাদের মধ্যে পর্যটকদের আদর-আপ্যায়নে সদা হাস্যোজ্জ্বল পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। দেখলে তাদেরকে অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির মনে হয়।
সিলেট থেকে আগত পর্যটক মোর্শেদা আলেয়া হাফিজ জানালেন, এখানে খাবারের ভাল কোন হোটেল নেই। এজন্যে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের সমস্যায় পড়তে হয়। হকনগর বাজারের ব্যবসায়ী মিনহাজ ইলেক্ট্রনিক্সের পরিচালক আব্দুল মুমীন, সমাজসেবী আফতাব আলী, বাবুল মিয়া, বদরুল ইসলাম জানান, ছাতকের জিয়াপুর নিবাসী তৎকালীন এমএলএ মরহুম আব্দুল হকের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্যে তার জীবদ্দশায়ই এলাকাবাসী তার নামানুসারে গ্রামের নাম হকনগর রাখেন। এসময় মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে তিনি এখানে প্রতিষ্ঠা করেন একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়া হতো। হকনগর প্রাথমিক বিদ্যালয় নামেও তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এখনও মরহুম আব্দুল হকের নামানুসারে হকনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হকনগর গ্রাম ও হকনগর স্মৃতিসৌধসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকলেও কালেরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে হকনগর হাসপাতালটি। একসময়ে হকনগর হাসপাতালে নরসিংপুর, বাংলাবাজার, বগুলা, লক্ষীপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা সেবার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু এখন এটি বন্ধ করে হকনগর কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করলেও প্রায়ই এটির দরজায় তালা ঝুলে। এখানে পরিবার পরিকল্পনাসহ অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হলেও চিকিৎসা সেবার জন্যে কোন ডাক্তার নেই। এজন্যে এলাকার বিপুল সংখ্যক লোক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এলাকাবাসী মরহুম এমএলএ আব্দুল হক প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ন্যায় এখানে হকনগর হাসপাতাল পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। তাদের দাবি, যুদ্ধকালীন সময়ে শুধু ক্যাপ্টেন হেলাল ও এমএলএ আব্দুল হকের বর্ণাঢ্য অবদানের সাথে এলাকাবাসীর ও সার্বিক সহযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।