পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : জিমের ছয়তলা থেকেই দৃশ্যটি চোখে পড়লো। ঢাকা টু চট্টগ্রাম মহাসড়কে শনির আখড়া ব্রিজের ওপর কুয়াশার মধ্যে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে মেয়েটি। শীতের সকালে ৪/৫ বছর বয়সের মেয়েটির গা খালি এবং পাশেই পড়ে রয়েছে স্কুল ব্যাগ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটি বই। মা আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেয়েটিকে উঠাতে। কিন্তু মেয়ে উঠছে না শীতের মধ্যেই গড়াগড়ি দিচ্ছে। ‘স্কুলে যাব না’ কাঁন্নাকাটি করছে। পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে দূর পাল্লার বাস। আবেদীন টাওয়ার নামের বিল্ডিং থেকে নীচে নামতেই দেখা গেল আরেক দৃশ্য। ঈদুল আজহার কোরবানীর জন্য হাট থেকে ত্যাজী বেয়াড়া ষাঁড় ক্রয় করে নিরাপত্তার জন্য দু’পাশে টান টান করে দড়ি দিয়ে বেঁধে বাড়ি নেয়া হয়; ঠিক তেমনি করে একটি ৪/৫ বছর বয়সী একটি ছেলেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ব্যাগ হাতে এক হাত ধরেছে মা অন্যহাত ধরেছে কাজের মেয়ে। কিন্তু বেয়াড়া ষাঁড়ের মতোই ছোট্ট ছেলেটি হাত খোলার চেষ্টা এবং গাইগুঁই করছে। দু’টি দৃশ্যই পথচারীদের চোখে আকৃষ্ট করে। ম্যাম বকা দিয়েছে এ জন্য ছেলে স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু অভিভাবক নাছোর স্কুলে নিয়ে যাবেই। এটা নাকি রাজধানী ঢাকার নিত্যচিত্র। ছোট ছোট শিশুরা যারা স্কুল যেতে ভয় পায় তাদের জোড় করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ভয়ে-আতঙ্কে শিশুরা স্কুল যেতে চায় না। কিন্তু অভিভাবকরা জোর করে তাদের স্কুলে যেতে বাধ্য করে থাকে। এভাবেই বেড়ে উঠছে ঢাকায় লাখ লাখ শিশু।
শিশুদের খেলার জন্য রাজধানী ঢাকায় এমনিতেই পর্যাপ্ত মাঠ নেই। নিরাপত্তাসহ নানা কারণে শিশুরা মুরগীর হাইব্রীড বাচ্চার মতোই বন্ধ ঘরেই বেড়ে উঠছে। তার ওপর স্কুলে ভর্তির চাপ, একগাদা বই, অতিরিক্ত পড়ার চাপ শিশুর কচিমনকে দুর্বিসহ করে তুলছে। রাজধানী ঢাকায় জন্ম নেয়া লাখ লাখ শিশুকে ৩ বছর বয়সে এই অবস্থায় পড়তে হয়। ঢাকায় জন্ম নেয়ার অর্থই যেন লেখাপড়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া। শিশুর বয়স, মনমানসিকতা, পড়া ধরে রাখার ক্ষমতা কিছুরই তোয়াক্কা করেন না অভিভাবকরা। বয়স ৩ বছর পার হলেই যে কোনো মূল্যে স্কুলে ভর্তি হও, পড়া মাথার মধ্যে ঢুকাও আর পরীক্ষার হলে উগড়ে দাও। মহল্লায় মহল্লায় কিছু শিক্ষিত বেনিয়া কি-ারগার্টেন খুলে বসেছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের স্কুলে নেয়ার ফন্দিফিকির করে থাকে। বাচ্চার বয়স কম হওয়ায় যারা পরের বছর স্কুলে পাঠানোর চিন্তাভাবনা করেন কি-ারগার্টেন বেনিয়াদের প্রলোভনে তারাও কম বয়সেই শিশুর নাম স্কুলে লেখান। কোনো কোনো অভিভাবক আবার ক্লাসে ছেলেমেয়েরা ফাস্ট হলো না সেকেন্ড হলো তা নিয়েই প্রতিযোগিতায় নেমে অবুঝ শিশুদের জীবন দুর্বিসহ করে তোলেন। বিজ্ঞানের এ যুগে শিশুদের খেলাধূলা, মন ও শরীরের বিকাশ কোনো দিকেই খেয়াল নেই যেন কারো। এতে করে শিশুদের মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ঢাকায় এখন শিক্ষা হয়ে গেছে সবচেয়ে বড় বাণিজ্য। অল্প পুঁজিতে প্রচুর লাভ। ব্যাঙের ছাড়ার মতো হাজার হাজার স্কুল, কি-ারগার্টেন গড়ে উঠেছে যত্রতত্র। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার পকেটে কিছু ঢুকিয়ে দিলেই কি-ারগার্টেনের অনুমতি মেলে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৩ থেকে ৫ বছর বয়সের শিশুকে প্লে শ্রেণিতে ভর্তি নেয়া হয়। মায়ের দুধ ছাড়েননি এমন বাচ্চাদেরও ভর্তি করে নেয়া হয়। জানা যায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩০৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাক-প্রাথমিক বা ছোট ওয়ান থেকে ভর্তি করা হয়। তবে প্রাথমিক স্তরের ক্ষেত্রে হাইস্কুল সংলগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলো অভিভাবকদের কাছে লোভনীয়। কারণ পরবর্তীতে ছেলেমেয়েদের ভর্তির জন্য উদ্বিগ্ন থাকতে হয় না। যার জন্য ৩১টি সরকারি হাই স্কুল ও অর্ধশতাধিক নামকরা বেসরকারি হাইস্কুলে ভর্তি মৌসুমে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা। এই ভর্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ৩ থেকে সাড়ে দিন বছর বয়সে কি-ারগার্টেনে পড়তে হয় শিশুদের। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)-র তথ্য অনুযায়ী ঢাকার সরকারি হাইস্কুলের মধ্যে মাত্র ১৩টিতে প্রথম শ্রেণি রয়েছে। সরকারি এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর ঢাকায় গড়ে ২ লাখ শিশু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। অধিকাংশ শিশুকেই পরীক্ষা দিতে হয়। ৩/৪ বছর বয়সের শিশু পরীক্ষার বোঝে! অবুঝ শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা প্রতিযোগিতায় নেমে শিশুদের জীবন করে তোলেন দুর্বিসহ। শিশুরা বোঝে না পরিবেশ প্রকৃতি। যারা নিজেদের জানতে পারেনি তাদের কেন এভাবে স্কুলে প্রতিযোগিতায় নামানো হয়? দুধের বাচ্চাকে কেন স্কুলে পাঠাতে হবে? শিক্ষা নিয়ে ব্যবসায় নামা কি-ারগার্টেনের মালিকদের বিরুদ্ধে কেন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয় না?
যে বয়সে শিশুদের খেলনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা; সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধূলা করার কথা, দাদী-নানী-মা-খালার মুখে ‘ঘুম পাড়ানী মাসিপিসির গল্প শুনে; দূর আকাশের তারা দেখে ঘুমানোর কথা, সে বয়সে তাদের পড়াশোনার যুদ্ধে নামতে হয়; মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা দিতে হয়। ক্লাসে বইয়ের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে যেতে হয় পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে। ব্যাকপ্যাক বই-খাতা, পানির বোতল, সামান্য খাবার, কলম-পেন্সিল বহন করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক বটে। কিন্তু বোঝার ভার এতো বেশী যে তা ৫/৬ বছর বয়সী শিশুর জন্য মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ভর্তি হলেই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিশুদের স্কুলে যেতে হয়। অথচ বয়সের কারণে শিশুর ওই সময় ঘুমিয়ে থাকার কথা। ইচ্ছেমতো ঘুম থেকে ওঠার কথা। ঢাকায় বসবাসের কারণে ঘুমের সময় ৩/৪ বছর বয়সী শিশুদের পড়ার টেবিলে, শ্রেণি কক্ষে কাউকে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে হয়। গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়ের বই পড়তে হয়। শিশুর শরীরের গঠন, বেড়ে ওঠা, মন মানসিকতাও কোনো কিছুই চিন্তা করা হয় না। শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষার্থীর বয়স ও ধারণ ক্ষমতার কথা বিবেচনা করেই কোনো শ্রেণিতে কতটা বই উপযুক্ত এবং শিশুর শিক্ষাক্রম কেমন হবে তা ঠিক করে দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তুক বোর্ড (এনসিটিবি)। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে এনসিটিবির তিনটি বই দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। তৃতীয় শ্রেণিতে আরো তিনটি বই যোগ হয়েছে। সেগুলো হলো বাংলাদেশ ও বিজ্ঞান পরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান এবং ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা। অথচ কি-ারগার্টেগুলো একগাদা বই ধরিয়ে দেয় শিশু বয়সের ছাত্রছাত্রীদের হাতে। শিশুদের মধ্যে যারা স্কুল যেতে উৎসাহী তারাও বই দেখে ভড়কে যান। সামর্থের চেয়ে অধিক ওজনের ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে স্কুলে যান। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো ব্যাগের ওজন বহনকারী শিশুর ওজনের ১৫%-এর বেশী হওয়া একেবারেই অনুচিত। তারা এ ওজন ১০%-এ সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কি-ারগার্টেনগুলোতে কার্যত ৩ বছর বয়সী শিশুদেরও পড়ানো হয়। মূলত ঢাকার স্কুলগুলোতে কোন ক্লাস থেকে শিক্ষার্থী পড়ানো হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। কোনো স্কুলে প্লে নামে একটি শ্রেণি খুলে রেখেছে। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়সের তিন বছর আগেই এই শ্রেণির লেখাপড়া শুরু হয়। কোথাও জুনিয়র ওয়ান বা প্রাক-প্রাথমিক বা ছোট ওয়ান নামে একটি শ্রেণি আছে। এই শ্রেণিতে লেখাপড়া শুরু করা হয় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির এক বছর আগে। আবার অনেক স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে লেখাপড়া শুরু হয়। শিশুর শিক্ষাজীবন শুরুর এ ভিন্নতার কারণে যারা শিশুকে প্রথম শ্রেণি থেকে পড়াতে চান, তারা সন্তান ভর্তি করতে গিয়ে দুর্ভোগ ও জটিলতায় পড়েন। যার কারণে অভিভাবকরা বাচ্চার বয়স ৩ বছর হতে না হতেই প্লে ও নার্সারি ক্লাসে ভর্তি করে দেন। ছোট বাচ্চারা স্কুলে যেতে ভয় পায়। এতে শিশুর বিকাশেই শুধু সমস্যা নয়; শিশুর জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। হেসে খেলে বেড়ানোর বয়সে শিশুদের জটিল জীবনে প্রবেশ করতে হয়। স্কুল ছুটির সময় দেখা যায় বিভিন্ন স্কুল ও কি-ারগার্টেনের ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ভারী ব্যাগ বহন করছে। ব্যাগের ভারে অনেকের পিঠ হেলে যাচ্ছে। অথচ তাদের ভারী ব্যাগ মহন করতেই হচ্ছে। যারা নিজেরাই একা হাটতে পারেন না কাদের ঘাড়ে ব্যাগের বোঝা! এতো দূর্বিসহ জীবন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।