Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ওয়াসার পানিতে জনদুর্ভোগ

ময়লা দুর্গন্ধময় পানের অযোগ্য : চোখ মুখ জ্বলে : শরীর চুলকায়

প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৭ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

উমর ফারুক আলহাদী : রাজধানীর ওয়াসার পানিতে এবার নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। চোখে-মুখে পানি লাগলেই জ্বালাপোড়া শুরু হয়। গোসল করার পর শরীর চুলকায় এবং চাকার মতো ফুলে যায়। ওয়াসার পানি ব্যবহারে অনেক এলাকায় শিশুদের গায়ে চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে। অনেক স্থানে পানি ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত। এ পানি ফুটিয়েও পান করা যাচ্ছে না। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি পানের কারণে ডায়রিয়া আমাশয়ের মতো রোগেও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে ওয়াসার পানি নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। পানি নিয়ে নগরবাসীর চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের কার্যকর কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর উদাসীনতার কারণে নগরীতে বিশুদ্ধ পানির চরম সঙ্কট বলে অভিযোগ করেছেন নগরীর ভুক্তভোগীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর রামপুরা, মগবাজার, যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী, গোলাপবাগ, গোপীবাগ, গেন্ডারিয়া মানিকনগর, মতিঝিল ফকিরাপুল, শাজাহানপুর, মতিঝিল সোনালী ব্যাংক স্টাফ কোয়াটার, বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ কোয়াটার, গোড়ান, সবুজবাগ, মুগদা, বাসাবো কমলাপুরসহ পশ্চিম কারওয়ান বাজারের গার্ডেন রোড, পুরান ঢাকার শশী মোহন বসাক লেন, বনগ্রাম, মৈশুন্ডি, সুত্রাপুর, ধোলাইখাল, অভয়দাস লেন, স্বামীবাগ প্রভৃতি এলাকায় ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ ও ময়লা পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ফেনাযুক্ত কালচে বা সবুজ বর্ণের পানি সাংসারিক কোন কাজে আসছে না। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার পানিতে শুধু দুর্গন্ধই নয় ব্যবহার করলে চোখ-মুখ, নাক জ্বালাপোড়া করে। ওই পানি দিয়ে জামা-কাপড় ধোয়ার পর নষ্ট হয়ে যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ এখন ওয়াসার পানি পান করাতো দূরের কথা অজু-গোসলও করা যায় না।
রামপুরা বাজার এলাকার মনির জানান, ওই এলাকার পানি চোখে-মুখে দিলে প্রচ- জ্বালা করে। গোসল করলে গা চুলকায়। ওয়াসার পানি তাই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এ এলাকার জনগণের পানির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেও কোন লাভ হচ্ছে।
মগবাজার এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. সাফায়াত উল্লাহ জানান, রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানির হাহাকার চলছে। পানি নিয়ে রাজধানীবাসী বিপাকে। ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করছে তাতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। ফুটিয়েও তা পান করা যাচ্ছে না। এমনকি ব্যবহার করতেও গা ঘিন ঘিন করে। এ দূষিত পানিতে শিশুদের শরীরে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রকম চর্মরোগ। বাড়ছে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগব্যাধির প্রকোপ। এ ব্যাপারে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো কিছু বলতে নারাজ।
পানি নিয়ে রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের ত্রাহি অবস্থা। দুর্ভোগ-দুর্গতির শেষ নেই। পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকাতেই গত ৩ মাস ধরেই পানি সঙ্কটের পাশাপাশি পানিতে তীব্র দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ফেনাযুক্ত কালচে ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সাংসারিক কাজেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বরং ঘরময় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাড়াচ্ছে রোগ-বালাই। তাছাড়া ওয়াসার পানির সাথে ময়লা, কেঁচো, এমনকি পয়োবর্জ্যও আসছে। দূষিত পানি পান করে অনেক মানুষকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে এসব নগরবাসী বিভিন্ন এলাকার গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছে। আর এ নিয়েও চলছে নানা হাঙ্গামা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকাতে তীব্র পানির সঙ্কট বিরাজ করছে। গত ৮ মাস ধরেই সেখানে ওয়াসা দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ করছে। যা ব্যবহারের অযোগ্য। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই রাজধানী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে ভুক্তভোগীরা মনে করছেন। তাদের দাবি এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। না হলে এর দায়ও সরকারকে বহন করতে হবে।
মতিঝিল এলাকার ব্যবসায়ী বলেন,পানির অপর নাম জীবন। যদি ওই পানি হয় দূষিত ময়লা-আবর্জনা পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত তবে এ পানির নাম মরণ। তিনি বলেন, বিশুদ্ধ পানি পান করা প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজন। কিন্ত রাজধানীর ওয়াসার পানি পান করে এখন অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ওয়াসা শতকরা ১৩ শতাংশ পানি নদী থেকে সংগ্রহ করে। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা থেকে যে প্রক্রিয়ায় পানি সংগ্রহ করা হয় তাতে পানি বিশুদ্ধ হয় না। এছাড়া পানি বিশুদ্ধ করতে অনেক সময় ওয়াসা অতিমাত্রায় কেমিক্যাল ব্যবহার করে। যার কারণে পানি দুর্গন্ধ হয়। দূষিত পানি চোখে লাগলে চোখ জ্বালা-পোড়া করে।
মানিকনগর এলাকার গৃহবধূ নাসিমা জানান, ওয়াসার পানি পান করা যায় না। ময়লা আবর্জনা থাকে। পানিতে দুর্গন্ধ। এছাড়া ঠিকমত পানিও পাওয়া যায় না ওয়াসার পানির রাইনে। ভোর রাত থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কিছুটা পানি ওয়াসার লাইনে আসলেও তাতে তীব্র দুর্গন্ধ। ফুটানোর পর পাত্রের তলায় কালো গাদ জমা হচ্ছে। ফলে পানি পান করা সম্ভব হচ্ছে না। গেন্ডরিয়া গার্ডেন রোডের বাসিন্দা সমা বেগম জানান, ‘পানি চোখে লাগলেই চোখ জ্বালা-পোড়া শুরু হয়। এমনকি অনেক সময় নাক মুখও জ্বলে। আমরা ওয়াসার কাছ থেকে বিশুদ্ধ পানিই আশা করি।
এ ব্যাপারে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, সায়দাবাদ পানি শোধনাগারের সরবরাহ করা পানিতে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারের ফলে পানি কিছুটা ঝাঁঝালো হয়ে পড়েছে। তবে শিগগিরই সমস্যা নিরসনের চেষ্টা চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার ‘ভয়ঙ্কর দূষিত’ পানি পরিশোধন করে সরবরাহের করে ওয়াসা। তবে তা কতটুকু বিশুদ্ধ এ নিয়ে বির্তক রয়েছে। এছাড়া পানির মান যত ভালোই হোক না কেন, গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর পথে পাইপ লাইনে তা আর পানযোগ্য থাকে না। এছাড়া আবাসিক ভবনগুলোর রিজার্ভ বা ওভারহেড ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তারা বলছেন, আদাবরের বাসিন্দা আমান উল্লাহ কিংবা আজিমপুরের গৃহিণী দিলরুবা জামানের মতো মধ্যবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী পানি ফুটিয়ে তারপর ফিল্টার করে পান করতে পারে। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম রাসেলের মতো অনেকেই ট্যাপের পানি সরাসরি পান করার কথা ভাবতেও পারেন না। কিন্তু আগারগাঁও বস্তির রিকশা চালক রানা মিয়া ও তার পরিবারকে রাস্তার কলের পানিই খেতে হয়।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, মেইন লাইন ছিদ্র করে এটা করার কারণে পানিতে ময়লা প্রবেশ করছে। তাছাড়া ওয়াসার কিছু পুরনো লাইন থাকার কারণেও এটা হতে পার। পাশাপাশি বাসা-বাড়িতে যে ট্যাংকি রয়েছে তা দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করার কারণেও পানিতে দুর্গন্ধ হতে পারে। তবে ফুটানো পানি নিরাপদ। পানি পরিশোধনে অতিমাত্রায় কেমিক্যাল ব্যবহারের ফলেও এই সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি স্বীকার করেন।
এদিকে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক মো. আবু নোমান জানান, ওয়াসার ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি পান করে অনেকেই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুরা এর খেসারত দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়াসা শতকরা ১৩ শতাংশ পানি নদী থেকে সংগ্রহ করে থাকে। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা থেকে যে প্রক্রিয়ায় পানি সংগ্রহ করা হয় তাতে পানি বিশুদ্ধ হয় না। তাছাড়া পানি বিশুদ্ধ করতে অনেক সময় ওয়াসা অতিমাত্রায় কেমিক্যাল ব্যবহার করছে। যার ফলে পানি দুর্গন্ধময় হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সায়েদাবাদ ও চাঁদনীঘাট শোধনাগার থেকে সরবরাহকৃত পানিতে এ দুর্গন্ধ বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তবে পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াসা বলছে, শুষ্ক মৌসুমে পানি সমস্যা বেড়ে যায়। ঢাকা শহরে দিনে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন লিটার পানির দরকার। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন থেকে ২ বিলিয়ন পানি। তাছাড়া ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই ৩ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে ঢাকায় পানি স্বল্পতা প্রকট হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাজধানীর প্রায় দেড় কোটি মানুষের জন্য প্রতিদিন ২৩০ কোটি লিটার পানির চাহিদা থাকলেও এর বিপরীতে ওয়াসার উৎপাদন ক্ষমতা ২১০ কোটি লিটারের মতো। এর ৭৮ শতাংশ তোলা হয় গভীর নলকূপ দিয়ে, বাকিটা নদীর পানি। সরকারিভাবে রাজধানীবাসীর জন্য ‘বিশুদ্ধ পানি’ সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র কর্তৃপক্ষ ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু ময়লা, দুর্গন্ধ এবং রোগজীবাণুর শঙ্কায় ওয়াসার পানি সরাসরি কল থেকে পান করার চল উঠে গেছে অনেক আগেই। তার বদলে বাসাবাড়িতে জ্বালানি পুড়িয়ে পানি ফুটিয়ে ও ফিল্টার করে এবং অফিস আদালতে বোতলজাত পানি কিনে ঢাকাবাসীর জীবন চলছে। আর ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) মো. আতাউর রহমান বলছেন, পাইলট প্রকল্প ধরে ‘বিশুদ্ধ পানি’ দেওয়ার বিষয়টি তাদের মাথায় আছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিফ কেমিস্ট মো. আব্দুস সাত্তার মিয়াহ নিজেই নগরবাসীকে ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে পানি পানের পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, আমার নিজের বাসায়ও ট্যাপের পানি সরাসরি খাই না। ফুটিয়ে তারপর ফিল্টার করে খেতে হয়। অন্য সবাইকেও আমি একইভাবে পানি বিশুদ্ধ করার পরামর্শ দিই।
আবার ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলছেন, শোধনাগারে পানি দূষণমুক্ত করার ‘সবোর্চ্চ প্রক্রিয়া’ চালানোর পরও ঢাকায় সরবরাহ করা পানিকে ‘বিশুদ্ধ’ বলা কঠিন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, যেসব পাইপ ৫০ বছর আগে বসানো হয়েছে, সেখানে বাইরের ময়লা পানি ঢুকে যাচ্ছে সহজেই। সায়েদাবাদ শোধনাগার থেকে হয়তো ভালো পানি গিয়েছিল, কিন্তু মাঝখানে পাইপলাইনে উচ্চচাপ না থাকায় বিষাক্ত হয়ে উঠতে পরে। বাসায় যে পানি যাবে তা নিরাপদ হবে না।



 

Show all comments
  • Abu Noman ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:২৯ পিএম says : 0
    Plz Solve it immediately
    Total Reply(0) Reply
  • ইব্রাহিম ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:৩০ পিএম says : 0
    এভাবে চলতে পারে না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ওয়াসার পানিতে জনদুর্ভোগ

৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ