Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা

প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:২০ পিএম, ২৫ আগস্ট, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : মুরগি বিক্রি করে সংসার চালান মনোয়ার হোসেন। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ভাড়া থাকেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। আগে সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল। এখন নেই। একদিকে ব্যবসা মন্দা তার উপর তিন ছেলেই ব্যবসার টাকা চুরি করে। দিন শেষে যা লাভ হয় তার সিংহভাগই লুট হয়ে যায় তিন ছেলের হাতে। বড় ছেলে মাদকসেবি। অভাব অনটন নিয়ে সংসারে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে। মনের দুঃখে গত সপ্তাহে গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। ফাঁসিতে ঝোলার কয়েক মিনিটের মধ্যে একজন এসে দরজা ভেঙ্গে তাকে উদ্ধার করায় বেঁচে যান। কী কারণে আত্মহত্যা করতে বসেছিলেন জানতে চাইলে মনোয়ার হোসেন উপরোক্ত কারণগুলো জানান। ক্ষুদে ব্যবসায়ী মনোয়ার ভাগ্যগুণে বেঁচে গেলেও আত্মহত্যায় অনেকের জীবনই অকালে শেষ হয়ে যাচ্ছে। গত ১৪ আগস্ট রোববার রাজধানীর ভাটারা থানার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করে মৌসুমী আক্তার মৌ নামে এক তরুণী। এক বেসরকারি বিশ্বদ্যিালয়ের অনার্সের ছাত্রী মৌসুমী প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। ১৯ জুন রোববার চট্টগ্রাম কোতয়ালী থানার পাথরঘাটা এলাকায় বাবা-মায়ের সাথে অভিমান করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন নুরুন্নাহার আক্তার মুন্নি নামে এক তরুণী। পুলিশ ভাষ্যমতে, পারিবারিক বিষয় নিয়ে দুদিন আগে মুন্নীকে বকা দেয় বাবা-মা। এ ঘটনার জের ধরে পরিবারের সদস্যদের অগোচরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে মুন্নী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এই চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অধিকাংশ দেশে নারীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ পুরুষ আত্মহত্যা করেন। অথচ বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর আত্মহত্যার হার বেশি। প্রতিবেদনটির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ২০১২ সালে ১০ হাজার ১৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৫ হাজার ৭৭৩ জন নারী, আর পুরুষ ৪ হাজার ৩৯৪ জন।  হু বলছে প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আট লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে নিজের জীবন শেষ করার পথ বেছে নেন। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। আরও বহুগুণ মানুষ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। সংস্থাটি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, ২০২০ সাল নাগাদ প্রতিবছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবেন। আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবেন এর ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। গত বছরের এক জরিপ অনুযায়ী, আত্মহত্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪তম। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, হতাশা ও বিষণœতা আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ। আর্থিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে মানুষের মধ্যে প্রথমে হতাশা ও পরে বিষণœতার জন্ম নেয়। এই হতাশা ও বিষণœতাই এক পর্যায়ে মানুষকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ধর্মীয় চেতনাবোধের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের হতাশা কাটিয়ে ওঠার মাধ্যমে আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক ও মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো: কামাল উদ্দিন বলেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা, অশান্তি ও বিষণœতার জন্ম নেয়। এক পর্যায়ে তা আত্মহত্যার প্রবণতার দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলেও নানা কারণে মানুষের মানসিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এতে করে মানুষের মধ্যে হতাশা ও মানসিক চাপসহ অশান্তি বাড়ছে। ড. কামাল উদ্দিন বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করার জন্য মানসিক সুস্থতার পরিবেশ দরকার। পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে সর্বোপরী রাষ্ট্রে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। সেজন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার। তিনি প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের জন্য স্কুল সাইকোলজিস্ট পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ প্রদানের পরামর্শ দেন।   
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গত চার বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৪ সালে ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজার ১২৯ জন। যারা আত্মহত্যা করেছেন বা চেষ্টা করেছেন, তাদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, ১৫-৪৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তথ্য মতে, রাজধানীতে আত্মহত্যাজনিত কারণে প্রতিমাসে গড়ে ২১ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ নারী। যাদের বয়স ২৫-এর নিচে। বাকি ৩০ শতাংশ পুরুষ ও ৫ শতাংশ শিশু। আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বখাটেদের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত হওয়া, ধর্ষণের শিকার হওয়া, প্রেমে প্রতারিত ও ব্যর্থ হওয়া, অভিভাবকদের বকাঝকা, পরীক্ষায় ফেল করা কিংবা আশানুরূপ ফল না হওয়া কিশোরীদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। আর গৃহবধূরা পারিবারিক সমস্যা-সহিংসতা, দাম্পত্য কলহ, যৌতুক, একাধিক কন্যাসন্তান প্রসব করা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে বেশি আত্মহত্যা করেন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সালে যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার ৮৬ শতাংশ ঘটেছে পারিবারিক সহিংসতার কারণে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির ‘বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা শতকরা ৫ ভাগ বেড়েছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কেবল সহিংসতার শিকার হয়ে ২০১৫ সালে ৩০১ জন শিশু ও নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। একটি বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, দেশে আত্মহত্যার দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঝিনাইদহ এলাকার মানুষ। এই এলাকায়ও নারীদের আত্মহত্যার হার পুরুষের তুলনায় বেশি। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এই ৬ বছরে ঝিনাইদহ জেলায় ১ হাজার ৯৪৪ জন আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে নারী ১ হাজার ২৩৮ জন, পুরুষ ৭০৬ জন। আর এই সময়ে যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের মধ্যেও নারীর সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। ছাত্রী, গৃহবধূ ও কম শিক্ষিত নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। বয়স্ক নারীরাও আত্মহত্যা করেন। তবে তাঁদের সংখ্যা খুব কম। বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিসিন-এর ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অব সুইসাইড প্যারা রুরাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। তাদের মধ্যে ৬১ শতাংশ নারী। এতে বলা হয়, প্রতারণার কারণে শহরাঞ্চলে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। আর গ্রামাঞ্চলে আত্মহত্যার মূল কারণ যৌতুক। তবে কিশোরীরা বেশির ভাগ সময় বখাটেদের মাধ্যমে উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সমস্যা যতো কঠিনই হোক না কেনো আশাহত হওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে আল্লাহর উপর আস্থা রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই দুর্বল কোনো মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। নিজেকে সময় দিতে হবে। কী কী করলে অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে তা করার চেষ্টা করতে হবে। একাকীত্ব কাটিয়ে নিজের সমস্যার কথা কাছের মানুষকে বলতে হবে। নিজের কোনো সমস্যা নিয়ে ভাবনার আগে চারপাশে তাকাতে হবে। দেখা যাবে অন্যরা আরও খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। নিজের জীবন বিপন্ন করার আগে স্ত্রী-সন্তান, স্বামী, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজনদের কথা ভাবতে হবে। বিষণœতাকে কাটাতে নেশাগ্রস্ত হওয়া যাবে না। সর্বোপরী আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস ও ইসলামী চেতনাবোধকে জাগ্রত করতে হবে। তাহলেই কেবল আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব।



 

Show all comments
  • সাজ্জাদ ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১০:৫৬ এএম says : 0
    বিষয়টি খুবই উদ্বেগের
    Total Reply(0) Reply
  • মারুফ ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১:০৮ পিএম says : 0
    প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করাটা বোকামি বলে আমি মনে করি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ