পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘সীতাকুন্ড গুলিয়াখালী সৈকত যেন ঘাসের বিছানা। সাগরের ঢেউ এসে এসে সবুজ ঘাসের কার্পেট ভিজিয়ে দেয়। সী-বীচের কিনারে গাছেও চড়েছি। বান্দরবানে নীলগিরি গেলাম। মেঘলা পার্কে মজা করেছি। কাজিনদের সাথে ক্যাবল কারে চড়েছি। আমার অনেক ভালো লেগেছে’। বাংলাদেশ এলিমেন্টারী স্কুল, চট্টগ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র মো. নাঈমুল ইসলাম শান। গেল সপ্তাহে ওদের নিকটাত্মীয় চারটি পরিবার মিলে মা-বাবার সাথে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ইনকিলাবকে জানায় শান।
প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রাম। ‘চট্টগ্রামকে ঘুরে দেখলে অভিভক্ত বাংলাকে প্রায় দেখা হয়েই যায়’। একথা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল এ মুহূর্তে পর্যটনে রঙিন-বর্ণিল। গৎবাঁধা যান্ত্রিক জীবন-যন্ত্রণা আর ইট-পাথর-লোহার খাঁচা ছেড়ে স্বস্তি ও মনের প্রশান্তির খোঁজে মায়াবী প্রকৃতির কোলে ছুটছেন লাখো মানুষ। শহর-নগরের দূষিত বায়ু থেকে মুক্ত হয়ে ক’টা দিনের জন্য বিশুদ্ধ বাতাসে অক্সিজেন নিচ্ছেন বুক ভরে। অনেকেই আসছেন শানের মতো সপরিবারে। বিনোদন কেন্দ্র হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট গেস্টহাউস রেস্তোরাঁ জমজমাট। ট্যুর অপারেটররা ব্যস্ত। বাস-কোচ, ট্রেন, লঞ্চ-নৌযান, আকাশপথে যাত্রীদের বড় অংশই এখন পর্যটক। মন্দা কাটছে। দৈনিক শত কোটি টাকা ব্যবসায়িক লেনদেন হচ্ছে।
করোনা মহামারীর অচলায়তন ভেঙেছে ‘হাওয়া বদলে’র এই ভরা মওসুম। স্বাস্থ্যবিধি মানছেন বেশিরভাগ পর্যটক। সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলার সাথে করোনায় স্বাস্থ্যবিধি নিয়েও নজরদারি আছে প্রশাসনের। তৎপর ট্যুরিস্ট পুলিশ। পর্যটন-বিনোদন স্পটগুলোতে খোলা আকাশতলে প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপ-মাধুর্য উপভোগর মধ্যদিয়ে নিজেকে নবরূপে চেনা-জানার প্রচেষ্টা যেন। চাটগাঁর কৃতিসন্তান বরেণ্য ব্যান্ডশিল্পী মরহুম আইয়ুব বাচ্চুর গানের ভাষায়- “চলো বদলে যাই...”।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। পৌষের ভয়ও নেই, শীত সহনীয়। আবহাওয়া অনুকূলে। সড়ক মহাসড়ক, নৌপথ ও আকাশপথে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থাও সহজ। উত্তর চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুন্ড-স›দ্বীপ থেকে দক্ষিণে বাঁশখালীর সাগরপাড়, দক্ষিণ-পূর্বে লোহাগাড়া, পার্বত্য থানচি-রুমা-আলীকদম থেকে পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে শুভলং-সাজেক ভ্যালী, আলুটিলা, রামগড় পর্যন্ত শতাধিক স্পট লাখো পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত। গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সঙ্গে ইংরেজি নববর্ষ-২০২১ ঘিরে চারদিক নতুন মাত্রায় উৎসবে মাতোয়ারা।
পর্যটনের সম্ভার-সমারোহে কী আছে তা নয়; বরং কী নেই চট্টগ্রামে! পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, গভীর গিরিখাদ, গুহা ও সুড়ঙ্গ দেখে শিহরিত হওয়ার আনন্দ অবর্ণনীয়। বঙ্গোপসাগর, সৈকত, নদ-নদী, হ্রদ, ঝরণা, রাবার ও চা বাগান, উপক‚লে লবণ চাষ, পাহাড়ে জুমের ফল-ফসল চাষাবাদ, শুঁটকি মহাল, দূর সমুদ্রে জাহাজের সারি, সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বন্দরে আলো জ¦লমল জাহাজবহর, পতেঙ্গায় দেশে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র দৃষ্টিনন্দন চট্টগ্রাম বোট ক্লাব, প্রজাপতি পার্ক, কর্ণফুলী ও ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ হালদা নদীতে চাটগাঁর ঐতিহ্য সাম্পান-নৌকায় কিংবা প্রমোদতরীতে বহিঃসমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো, ডলফিনের নাচানাচি দেখা সত্যিই উপভোগ্য। পাহাড়ি জুমচাষের বিষমুক্ত ফলমূল সবজি কিনে ফিরছেন পর্যটকরা মনের সুখে। স্থানীয় লোকজনের পটু হাতে তৈরি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পপণ্য বিকিকিনি হচ্ছে প্রচুর।
ঐতিহাসিক চন্দনপুরা তাজ মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, মীরসরাই ছুটি খাঁন মসজিদ, সিআরবি (অবিভক্ত বাংলার রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার) ভবন ও হাতীর বাংলো, বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমির স্মৃতিবিজড়িত সুফি দরবেশ হযরত শাহ আমানত (রহ.), হযরত সুলতান বায়েজীদ (রহ.), শাহ মিসকিন (রহ.), শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.), শাহ বদরের (রহ.) মাজার, ফটিকছড়ি মাইজভান্ডার দরবার, হাটহাজারী বড় মাদরাসা, ষোলশহর জামেয়া মাদরাসা, চট্টগ্রাম কলেজ রেড বিল্ডিং, পরীর পাহাড়, হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজের পাহাড়চূড়ায় দূর্গ, মহাকবি আলাওল, মলকা বানু, ভেলুয়া সুন্দরীর দীঘি, রেলওয়ে জোড় দীঘিসহ অনেক সুপ্রাচীন স্থাপনা পর্যটকদের টানছে। ফয়’স লেক, চুনতি ও ফটিকছড়ির হাজারীখিল অভয়ারণ্য, বুনো পশুপাখি জীববৈচিত্র্য মিলিয়ে যেন চিত্রশিল্পীর তুলিতে আঁকা অপরূপা চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামবাসীর মেহমানদারিতে বিমুগ্ধ দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকরা। চাটগাঁয় এমন অনেক খাবার-দাবার রয়েছে যা বিশ্বে আর কোথাও মিলবে না। ঐতিহ্যবাহী গণিবেকারীর বেলা বিস্কুট, মিষ্টি বাখরখানি, মেজ্জাইন্না গরুর গোশত, কালোভূনা, নলাকাঁজি, চর্বিবিহীন গয়াল গরুর গোশত, দোমাছা, ঝাল শুঁটকি-সীমের বীচি-বেগুন কারি, দুরুচ কুড়া-রাতা কুড়া (বিশেষ কৌশলে রান্না আস্ত মোরগ) পোলাও। সবচেয়ে বড় কথা চাটগাঁইয়া মেহমানদারির রীতি-রচম ঐতিহ্য। যা প্রাচীন যুগের খ্যাতনামা চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন, হিউয়েন সাঙ স্বীকার করে গেছেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের আরও উল্লেখযোগ্য পর্যটন ও বিনোদন স্পটের মধ্যে রয়েছে- নগরীর জয় পাহাড়ের পাদদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বিভিন্ন দেশের সৈনিকদের সমাধি ক্ষেত্র ওয়ার সিমেট্রি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ে চালন্দা গিরিপথ, রাউজানে ঐতিহাসিক সাহেব বিবি মসজিদ, হাটহাজারীর নন্দীরহাট লক্ষীচরণ সাহা জমিদার বাড়ি, সীতাকুন্ড-মীরসরাইয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়, খৈয়াছড়া ঝরণা, নাপিত্তাছড়া ট্রেইল, কমলদহ ঝরণা, মহামায়া লেক, মুহুরী সেচ প্রকল্প, বাওয়াছড়া লেক, কাপ্তাইয়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়া লেক ভিউ আইল্যান্ড, নগরীর টাইগারপাস বাটালি হিল, চশমা ঝরণা, জিলাপির পাহাড়, খেজুরতলা সী-বীচ, সীতাকুন্ড ইকো পার্ক, রাঙ্গুনিয়া শেখ রাসেল এভিয়ারি ও ইকোপার্ক, চন্দ্রঘোনা কেপিএম’র সংলগ্ন লেকভিউ ক্লাব, সীতাকুন্ড সহস্রধারা ঝরণা, ভাটিয়ারী গলফ ক্লাব ও লেক, চান্দগাঁও মিনি বাংলাদেশ, আনোয়ারা পারকী সমুদ্র সৈকত, পতেঙ্গা সৈকত, আউটার রিং রোড, বায়েজিদ-সলিমপুর লিংক রোড ইত্যাদি।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের পর্যটন শিল্পখাত প্রসঙ্গে গতকাল বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সহ-সভাপতি মোঃ খোরশেদ আলম বলেন, প্রাকৃতিক নিসর্গের লীলা নিকেতন সমগ্র চট্টগ্রাম পর্যটন ও বিনোদনের সম্ভারে সমৃদ্ধ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের মাধ্যমে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র প্রসারিত করা সম্ভব।
সদ্য পার্বত্য বান্দরবানে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র সপরিবারে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রফেসর মোঃ মাঈনূল ইসলাম। তিনি বলেন, নীলগিরি, মেঘলা, নীলাচল, স্বর্ণ মন্দিরসহ বান্দরবানের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে গিয়েছি। মেঘলা পার্ক আগের চেয়ে বেশ সুন্দর, তবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যাবল সংযোজন হয়েছে, এটি মনোমুগ্ধকর। পর্যটন বিকাশে বান্দরবানে উন্নয়ন কাজ চলছে। প্রচুর রিসোর্ট ও হোটেল রয়েছে। যা পর্যটনের জন্য আশাব্যঞ্জক। নীলগিরি আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে। বাথরুম ও নামাজের সুব্যবস্থা রয়েছে। নীলগিরির নয়নাভিরাম দৃশ্য মন জুড়িয়ে যায়।
বিশিষ্ট ব্যাংকার ক্রীড়াবিদ মোঃ তৌফিকুল ইসলাম বাবু এরমধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, প্রাচ্যের রাণী খ্যাত বাংলাদেশের অপরূপা প্রকৃতির লীলাভূমি চট্টগ্রামে যতই ঘুরছি মন-প্রাণ নেচে ওঠে। গাইতে ইচ্ছে করে- এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি। বিদেশে না গিয়ে নিজদেশের সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য সবাইকে চট্টগ্রামে আসার আহ্বান জানাই। নিজঘরেই যেখানে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য সেখানে এত অর্থব্যয় করে বিদেশ ভ্রমণ অর্থহীন। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশে চট্টগ্রাম অগ্রণী ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে। এরজন্য দেরিতে হলেও সরকারের মহৎ সব উন্নয়নমূলক উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। চট্টগ্রাম যাতে বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে এটাই প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।