Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীর পানিবদ্ধতা : কারণ এবং প্রতিকারের উপায়

প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
নগরায়নের এমন কোন সমস্যা নেই যা ঢাকা নগরীতে নেই। ঢাকা নগরীর বহুবিধ সমস্যা বিভিন্ন নাগরিক-গোষ্ঠীর চোখে ভিন্ন রূপে ধরা পড়ে। তবে এর প্রভাব থেকে কেউই সম্পূর্ণরূপে মুক্ত নয়, তা সে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্ত যে কোন গোষ্ঠীভুক্ত হোক না কেন। সব মহানগরেই সমস্যা আছে, তারতম্য শুধু ব্যাপকতার ও জটিলতার। ঢাকা নগরী অবশ্য এদের মধ্যে অদ্বিতীয়, এর অনেক সমস্যা ও জটিলতা মানুষের তৈরি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা। নগরায়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছাপ জনবহুল নগরী ঢাকায় খুঁজে পাওয়া সত্যিই দূরূহ ব্যাপার। রূঢ় হলেও বাস্তব, নগরী ঢাকা গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ডিআইটির মাস্টার প্লান সুপরিকল্পিতভাবে হয়েছে এটা বিশেষজ্ঞমহল মানতে চান না। বিশেষভাবে যারা বিদেশে ঘুরেছেন, তাদের অভিমত ডিআইটি প্রণীত নগরী ঢাকা মাস্টার প্লানের সবচেয়ে বড় খুঁত হলো, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বুড়িগঙ্গা নদীকে কাজে লাগানো হচ্ছে না আজ অবদি। প্রসঙ্গক্রমেই স্থপতিদের কথা উল্লেখ করতে হয়- নগর সম্প্রসারণের কাজ সাধারণত বৃত্তায়ন ধারায় হয়। কিন্তু ঢাকা সম্প্রসারণ লম্বালম্বি হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশেই নগরায়ন হয়েছে নদীকে কেন্দ্র করে। তাইতো আমরা দেখি সিন নদীর দু’পারের প্যারিস নগরী সমভাবেই উন্নত। নদীর দু’পারকে কাজে লাগানোর ফলে সেই সব নগরী অপরিসর রাস্তাঘাট, জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে বিবর্ণ হয়ে যায়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্থিত ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার সবরকম বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও তা গড়ে তোলা হয়নি সুদূরপ্রসারী প্লানের অভাবে। একটা কথা অবশ্য অনস্বীকার্য যে, ঢাকা জন্মলগ্ন থেকেই টিকে থাকার লড়াই করছে। এ লড়াই আজও চলছে।
ঢাকা মহানগরীতে বিগত কয়েক দশক ধরে প্রতিবছরই পানিমগ্নতার সমস্যা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। উৎসগত দিক বিবেচনা করলে এর প্রধান কারণ হিসেবে দু’টো বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত অধিক বর্ষণের ফলে অপেক্ষাকৃত নি¤œভূমি ও পানি নিষ্কাশন সুবিধা বঞ্চিত এলাকাগুলো ডুবে যায়। দ্বিতীয়ত খাল ও নদীবাহিত পানির ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে দু’কূল বাহিত করে পানিমগ্নতার সৃষ্টি করে। খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে বর্ষা ও বন্যা এর কোনটিই এই পানিমগ্নতার জন্য দায়ী নয়। পরিকল্পিতভাবে শহরের উন্নয়নে ব্যর্থতার ফলে আজ এ বিরাট সমস্যা লাখ লাখ মানুষের জন্য বয়ে আনছে অসহনীয় দুর্ভোগ। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শত মাইল নগর সড়ক, বাড়িঘর, পণ্যদ্রব্য। যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে ও মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির। পানিমগ্নতা আজ একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এ ধরনের পানিমগ্নতার সমস্যা কিন্তু এ শতাব্দীর গোড়াতেও ছিল না। ক্রমাগত অপরিকল্পিতভাবে শহর বিস্তারের ফলে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যত্রতত্র বাড়িঘর তৈরি, মার্কেট স্থাপন ও সড়ক নির্মাণের ফলে বর্ষার পানি দ্রুত সরে যেতে পারছে না। তাছাড়া শহরের অভ্যন্তরীণ ও আশপাশের খালগুলো ভরাট করে সেখানে বাড়িঘর কল-কারখানা ও দোকানপাট নির্মাণ করায় বৃষ্টির পানি সরে যেতে বেশ সময় নিচ্ছে। অপরপক্ষে নগরীর খাল, চড়া প্রতিটি ময়লা-আবর্জনা দ্বারা ভরাট হয়ে পানি ধারণ ও পরিচালন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে, পানি বদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
ঢাকা শহর প্রাচীন শহর। এক সময়ে এটি একটি পরিচ্ছন্ন ও প্রকৃতিগতভাবে ভারসাম্যপূর্ব শহর ছিল। যাতায়াত ও পণ্যদ্রব্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হতো নগরীর চারপাশের নদী ও অভ্যন্তরীণ খালগুলো। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বালু ও তুরাগ নদী বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল। অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হত ধোলাই খাল, সেরনী খাল, বেগুনবাড়ী খাল ও টঙ্গী খাল। এই নদী ও খালগুলো শুধুমাত্র যাতায়াতের মাধ্যমই ছিল না বরং সুষ্ঠু ও দ্রুত পানি নিষ্কাশনে এদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই খাল ও নদী ছিল গভীর ও সংস্কারের জন্য সময়ে সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। কিন্তু কালক্রমে ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৪৭-এর ভারত বিভক্তির পর যখন এ নগরী পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে মর্যাদা লাভ করে তখন দ্রুত জনসমাগম হতে থাকে। ফলে এ নগরীর নানা সমস্যা দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। জমির দারুণ অভাব দেখা দেয়। শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে নিচু জমি ভরাট করে সেখানে বাড়িঘর তৈরির প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় নগরীর যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা স্রোতস্বিনী খালগুলো বাদ পড়েনি। ধীরে ধীরে এ খালগুলো ভরাট হয়ে যায় এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নজলাভূমি প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। পরিণামে যা হলো, তা হচ্ছে পানি নিষ্কাশন প্রণালীর অভাবে প্রতি বছর বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে পানিমগ্নতা ও পানিবদ্ধতা।
১৯৭১ সালে ঢাকা নগরীকে পরিকল্পিতরূপে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাব করা হয়। একটি মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়। নগরীর নিষ্কাশন ও পানিমগ্নতার ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে অভ্যন্তরীণ প্রতিটি খালকে সংস্কারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গতি দানের জন্য এ মহাপরিকল্পনায় জোর সুপারিশ করা হয়। যে খালগুলোর সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়, সেগুলো হচ্ছে দেব দুলাই ধোলাই খাল, বেগুন বাড়ি খাল, সেগুনবাগিচা খাল, গিরনী খাল এবং পশ্চিম জাফরাবাদ খাল। কিন্তু এ যাবত এ মহাপরিকল্পনার ভিত্তিতে কোন খালের সংস্কার কর্মসূচি সম্পন্ন হয়নি। মাঝে মধ্যে কিছু কিছু কাজ কোন কোন স্থানে শুরু হলেও সমাপ্ত প্রায় হয়নি। বরং বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, সেই সমস্ত খাল ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কিছু কিছু এলাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনে স্টর্ম স্যুয়ারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- যেটা প্রয়োজনীয় পানি নিষ্কাশনের তুলনায় অপ্রতুল। অন্যদিকে এই সমস্ত স্টর্ম স্যুয়ারের নিষ্কাশন পথ বিভিন্ন জায়গায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে সামান্য বৃষ্টির পানিতে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এবং তা পুরোপুরি সরে যেতে প্রায় দু’তিন দিনের মতো সময় লাগে।
তাই বলা যায় যে, ঢাকা নগরীর মহাপরিকল্পনা ও অন্যান্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদনে যে সমস্ত সুপারিশ দেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং পানিবদ্ধতা সমস্যার গুরুতর অবনতি ঘটেছে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি স্ফীত হলে এই সমস্ত খালে বর্ষার পানি ঢুকে যায় এবং নাব্যতার অভাবে পানি দ্রুত সরে যেতে পারে না। এই কারণে নগরীর বিভিন্ন জায়গা বর্ষা মৌসুমে পানির নিচে ডুবে যায়। এমনকি নগরীর প্রধান সড়কগুলোর বেশ কিছু অংশে ১ থেকে ১.৫ মিটার পানির নিচে চলে যায় এবং যানবাহন চলাচল বিঘিœত হয়। নগরীর পানি নিষ্কাশন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ সমস্যা গত তিন দশক যাবত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এবং অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে এর সমাধান করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। অন্যথায় আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে বন্যার ফলে ঢাকা নগরীর জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পূর্ববর্তী আলোচনায় পানিবদ্ধতার কারণসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং এইসব সমস্যার সমাধানকল্পে নি¤েœ কিছু প্রস্তাব রাখা হলো। সমস্যার প্রকৃতি অনুসারে দু’ভাগে এর সমাধানের প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। ১। পানি নিষ্কাশন, ২। বন্যা প্রতিরোধ। নগরীর পানি নিষ্কাশনের নিমিত্তে যে খালগুলো এখনও বর্তমান আছে সেগুলোকে খননের মাধ্যমে গভীরতা বাড়াতে হবে যাতে এগুলোর পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যে সমস্ত জায়গাতে স্টর্ম স্যুয়ার আছে সেগুলোকে ভেঙে না ফেলে নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করে পানি বহন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এই খাল ও স্টর্ম স্যুয়ারসমূহ নিকটবর্তী নদী যেমন- বালু নদী, শীতলক্ষ্যা নদী, তুরাগ নদী ও বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনবোধে এগুলোর সংগম স্থলে পাম্প স্টেশন নির্মাণ করে পানি দ্রুত সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে পাম্পিংয়ের মাধ্যমে মূল নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
অতি সম্প্রতি ঢাকা নগরীর আশপাশে ও নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকা নগরীর বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুতরাং উক্ত সমস্যা সমাধানকল্পে কিছু প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন যেহেতু ঢাকা নগরীতে বিভিন্ন নালা, খাল দিয়ে নগরীতে পানি ঢুকে যায়, সেহেতু ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাকে ঘিরে একটি বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়েছে। উক্ত বাঁধটিকে রিংরোড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া এই বাঁধের মাধ্যমে নগরীর পার্শ¦বর্তী নি¤œাঞ্চল নগরীর সম্প্রসারণে সহায়ক এলাকা হিসেবে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। বেড়িবাঁধটি অন্ততপক্ষে সর্বোচ্চ বন্যা উচ্চতা থেকে ১.৭৫ থেকে ২.০ মিটার উপরে নির্মাণ করা উচিত নয়। কারণ, ২০০৪ সালের বন্যার দেখা গেছে যে, এই ধরনের উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁধ ছাড়া বড় রকমের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। উক্ত বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এক কিলোমিটার এলাকােেক গ্রিন বেল্ট হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এতে অপরিকল্পিতভাবে নগরীর সম্প্রসারণ রোধ করা সম্ভব। উক্ত বেড়িবাঁধ যে সমস্ত খালের মুখ অবস্থিত সে সমস্ত জায়গায় স্লুইচ গেট ও পাম্প স্টেশন নির্মাণ করার মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যৌথভাবে সমাধান করা যেতে পারে। তবে সবার আগে খালের দু’দিকের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে এগুলোর প্রশস্ততা ও গভীরতা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় (স্বর্ণপদক ১ম) পুরস্কার প্রাপ্ত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজধানীর পানিবদ্ধতা : কারণ এবং প্রতিকারের উপায়
আরও পড়ুন