Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আশা-নিরাশার ‘রংপুর এক্সপ্রেস’

প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

৫ বছরে সেবার মান বাড়েনি : এসি কেবিনসহ কমেছে কোচের সংখ্যা : নতুন কোচ প্রাপ্তির সম্ভাবনাও ক্ষীণ
নূরুল ইসলাম : রংপুর এক্সপ্রেস। কেউ বলে বাহের দেশের ট্রেন। কেউ বলে মফিজ ট্রেন। অনেকের কাছে এটি গরিবের ট্রেন। ২০০১ সালের ২১ আগস্ট ঢাকা-রংপুর রেলপথে চালু হয় আন্তঃনগর ট্রেনটি। ৫ বছরে এর যাত্রীসেবার মান বাড়েনি। বরং অবহেলায় দিন দিন ট্রেনটি তার স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা পুরাতন কোচ দিয়ে চলছে ট্রেনটি। শুরুতে এসি কেবিন কোচ থাকলেও এখন নেই। ১১টি কোচ দিয়ে শুরু হলেও এখন আছে মাত্র ৯টি। যাত্রীসেবা বলতে যা বোঝায় তার সিংহভাগই অনুপস্থিত। তারপরেও রংপুরবাসীর প্রিয় ট্রেন রংপুর এক্সপ্রেসে যাত্রীসংখ্যার কমতি নেই। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানীকৃত লাল-সবুজ কোচের দাবিতে সরব রংপুরবাসী। আজ থেকে ঢাকা-খুলনা রেলপথে চিত্রা এক্সপ্রেস চলবে নতুন এলএইচবি কোচ দিয়ে। কাল থেকে নতুন কোচ পাবে একই রুটের সুন্দরবন এক্সপ্রেসও। দু-এক দিনের মধ্যে ঢাকা-সিলেট রেলপথের পারাবতেও যোগ হবে নতুন কোচ। এরপর ঢাকা-জামালপুর রেলপথের তিস্তার পালা। এ তালিকায় রংপুর এক্সপ্রেসের নাম নেই। এতে হতাশ এই ট্রেনের যাত্রীরা। অথচ ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানী করা লাল-সবুজ কোচ সর্বপ্রথম যোগ হওয়ার কথা ছিল রংপুর এক্সপ্রেসে।
এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৬ সালের ১৬ মার্চ চালু হয় আন্তঃনগর ট্রেন তিস্তা এক্সপ্রেস। উত্তরবঙ্গের সাথে ঢাকার রেল যোগাযোগের এটিই ছিল প্রথম উদ্যোগ। দিনাজপুর থেকে পার্বতীপুর ও রংপুর হয়ে গাইবান্ধার তিস্তামুখঘাট পর্যন্ত চলত ট্রেনটি। এরপর যমুনায় ফেরি পারাপারের মাধ্যমে যাত্রীদের আনা হতো বাহাদুরাবাদ ঘাটে। সেখানে অপেক্ষা করত তিস্তার আরেক অংশ। সেই তিস্তা সরাসরি আসত ঢাকায়। তিস্তা এক্সপ্রেস চালু করার পর যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যাত্রীর চাহিদা দেখে রেল কর্তৃপক্ষ একই রুটে আরেকটি আন্তঃনগর ট্রেন একতা এক্সপ্রেস চালু করে। বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৫ সালের ২৫ জুলাই তিস্তামুখঘাট-বাহাদুরাবাদ ঘাট রেলওয়ে ফেরি সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়। তিস্তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস। এই ট্রেনের যাত্রাপথ নির্ধারণ করা হয় দিনাজপুর থেকে রংপুর হয়ে প্রথমে বোনারপাড়া এবং পরে বগুড়া হয়ে সান্তাহার পর্যন্ত। একই সাথে একতা এক্সপ্রেসকে দিনাজপুর থেকে রংপুরের দিক থেকে ঘুরিয়ে সান্তাহার-ঈশ্বরদী হয়ে ঢাকার দিকে যাত্রাপথ নির্ধারণ করা হয়। এতে করে রংপুরবাসী ঢাকার সাথে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে একেবার বঞ্চিত হয়। রাজধানীর সাথে রেল যোগাযোগের জন্য একটা ট্রেনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে রংপুরবাসী। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার রংপুরকে নতুন বিভাগ ঘোষণার পর  ট্রেনের দাবিতে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ২০ বছরের আন্দোলনের ফসল হিসেবে ২০১১ সালের ২১ আগস্ট রংপুরবাসী পায় তাদের স্বপ্নের ‘রংপুর এক্সপ্রেস’। ওই দিন বিকাল ৪টায় ২৯১১ নম্বরের লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) নিয়ে হুইসেল বাজাতে বাজাতে ট্রেনটি যখন রংপুর স্টেশনে পৌঁছায় তখন রংপুরবাসীর আনন্দের সীমা ছিল না। রংপুরের বাসিন্দা শওকত হোসেন পাঁচ বছর আগের সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, রংপুর এক্সপ্রেস উদ্বোধন করেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। ট্রেনটি স্টেশনে প্রবেশের পর আমাদের আনন্দ অনেকটাই শেষ হয়ে যায়। কারণ আমরা জানতাম ট্রেনটিতে নতুন কোচ দেয়া হবে। কিন্তু তার পরিবর্তে ছিল পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে রিপিয়ারিং করা পুরাতন কোচ। এ বিষয়ে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ করি। মন্ত্রী আবুল হোসেন আমাদেরকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, শিগগিরই নতুন কোচ লাগানো হবে। একই সাথে ঢাকা-রংপুর রেলপথে আরও একটি ট্রেন চালু করা হবে। মন্ত্রীর সেই আশ্বাস গত ৫ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি।
আলাপকালে নিয়মিত রংপুর এক্সপ্রেসে ভ্রমণ করেন এমন কয়েকজন যাত্রী জানান, শুরুতে রংপুর এক্সপ্রেসে কোচ ছিল ১১টি। রেলওয়ের ভাষায় লোড ছিল ১১/২২। শুরুতে একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন কোচও ছিল এই ট্রেনে। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় সেই কেবিন কোচ খুলে নেয়া হয়। এখন লোড কমিয়ে ৯/১৮ করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন এই ট্রেনের কোচ মাত্র ৯টি। এর মধ্যে একটি পাওয়ার কার। প্রথম শ্রেণির কোচটি একেবারে নি¤œমানের। ৩১৩ কিলোমিটার পথ দূরত্বে এরকম নি¤œমানের কোচে ভ্রমণ করা কষ্টকর বলে যাত্রীদের অভিমত। পুরাতন কোচ দিয়ে চললেও রংপুর এক্সপ্রেসের ভালো দিক হলো এই ট্রেনের গতিবেগ সুবর্ণর মতো ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে যাত্রাপথে ৩১৩ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রমকালে ট্রেনটি থামে ১৩টি এবং ঢাকায় আসার পথে ১৪টি স্টেশনে। অবিরাম চলমানতার কারণেও ট্রেনটিতে ভ্রমণ করতে অনেকেই পছন্দ করেন। কিন্তু দিন দিন এর যাত্রীসেবার মান কমতে থাকায় যাত্রীরা হতাশ। তারা জানান, অনেকটা সময় মেনে চললেও ট্রেনের কোচের মান একেবারে লোকাল ট্রেনের মতো। বাথরুমগুলো থাকে অপরিষ্কার, লাইটগুলো সময়মতো জ্বলে না, ফ্যান ঠিকমতো চলে না, জানালাগুলো একবার খুললে আর লাগানো যায় না। চলন্ত ট্রেনে হকার, ভিক্ষুক ও হিজড়াদের উৎপাত লেগেই থাকে। অ্যাটেনডেন্টরা বিনা টিকিটের যাত্রী তুলতে ব্যস্ত সময় কাটায়। ট্রেনের যাত্রীদের দিকে তাদের কোনো নজর থাকে না।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানীকৃত লাল-সবুজ কোচ সর্বপ্রথম যুক্ত হওয়ার কথা ছিল রংপুর এক্সপ্রেসে। কিন্তু লবিং করার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা না থাকায় নতুন কোচের তালিকা থেকে ট্রেনটি বাদ পড়েছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা-সিলেট রেলপথে আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেসে নতুন কোচ যুক্ত করার জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সুপারিশ করেছেন। তার কারণেই পারাবতে দু-এক দিনের মধ্যেই নতুন কোচ যুক্ত হচ্ছে। ‘রংপুর এক্সপ্রেসের জন্য এরকম সুপারিশ করার মতো কেউ কি নেই?’ এমন প্রশ্নের জবাবে রংপুর অঞ্চলের বাসিন্দা একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শ্বশুরবাড়ি রংপুর। এরপর আর সুপারিশের প্রয়োজন পড়ে? রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলেই যে কোনো মুহূর্তে ট্রেনটিতে নতুন কোচ যুক্ত করতে পারে।  রংপুর অঞ্চলের রেলফ্যান আব্দুল মজিদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘বাহে হামরা মফিজ বলি কী অংপুরের ট্রেনও মফিজ? ঢাকাত যাওয়ার একখানই ট্রেন রংপুর এক্সপ্রেস। হামার দাবি, ট্রেনখান ভালো হউক, উন্নত হউক।’
 



 

Show all comments
  • Md Sayed ২৩ আগস্ট, ২০১৬, ১১:২৯ এএম says : 0
    আমরা সবাই চাই কর্তৃপক্ষ, নতুন লাল-সবুজ কোচ দিয়ে রংপুর এক্সপ্রেসকে নতুন আঙ্গিকে পরিচালনা করুক...
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আশা-নিরাশার ‘রংপুর এক্সপ্রেস’
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ