Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমরা কোথায়?

প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৭ পিএম, ২২ আগস্ট, ২০১৬

স্টালিন সরকার : ‘একটি জাতির আসল পরিচয় হলো সংস্কৃতি-কৃষ্টি। যে জাতির সংস্কৃতি যত বেশি সমৃদ্ধ; সে জাতি তত উন্নত’। এটা ঋষি-মুনিষীদের কথা। জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সংস্কৃতির ঐতিহ্য। মা-মাটি ও মানুষের কৃষ্টি-কালচারে সমৃদ্ধ জাতি হয়েও আমরা মনের অজান্তে ক্রমান্বয়ে বিজাতীয় সাংস্কৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছি। জারি-সারি-মুর্শিদী-ভাটিয়ালী, হাছন-লালন-কানাই-নজরুল-আলিম-আব্বাস-শিল্পাচার্য জয়নুলের দেশে এখন বিজাতীয় সংস্কৃতির রমরমা প্রসার। দেশের মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি ছেড়ে অপরের সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে জাতিকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? গত রমজানে রংপুরে কয়েকটি গ্রামে ঘুরে দেখেছি; হিন্দুয়ানী সাংস্কৃতির কি রমরমা রাজত্ব। এই অপসাংস্কৃতি জাতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি কি বিজাতীয় সংস্কৃতির শ্রোতে হারিয়ে যাবে? ক’দিন আগে পত্রিকায় ছোট্ট করে খবরটি ছাপা হয়। ‘কিরণমালা’ দেখাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত। খবরটি এমন- ‘হাবিগঞ্জ জেলার ধলগ্রামে এক দোকানের টিভিতে ‘কিরণমালা’ সিরিয়াল দেখার জন্য দর্শকেরা ভিড় করে। কিন্তু কিছু দর্শক অন্য অনুষ্ঠান দেখতে চায়। এ নিয়ে প্রথমে কথা কাটাকাটি; পরে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। দু’পক্ষের এই সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখা নিয়ে এ সংঘর্ষের খবর শুধু দেশেই নয়; ভারতের গণমাধ্যম এবং বিবিসিতে প্রচার হয়। এর আগে বিগত কয়েকটি ঈদে কিরণমালা সিরিয়ালের পাখি চরিত্রের আদলে তৈরি পোশাক ‘পাখি ড্রেস’কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে কয়েক স্থানে ঘটে লঙ্কাকা-। এ ড্রেসকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পারিবারিক কলহ। আমাদের ঈদের বাজারে পাখি ড্রেস বিক্রী করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। টিভি সিরিয়ালে উদ্বুদ্ধ হওয়া তরুণীরা বাবা-মায়ের কাছে পাখি ড্রেস চায়। অর্থাভাবে বাবা-মা মেয়ের পছন্দের পাখি ড্রেস কিনে দিতে না পারায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে। শুধু তাই নয় পাখি, মাসাক্কালি ড্রেস নিয়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর হাতে স্বামী হত্যার মতো ঘটনা ঘটে। প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীন দেশে বিজাতীয় সাংস্কতি নিয়ে এতো মাতামাতি কেন?
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তুরস্কের ইতিহাস কি আমরা পড়িনি? মুসলমানদের নের্তৃত্বে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের ইতিহাস সবার জানা। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক এলাকা ছিল তুরস্কের অংশ। উসমানীয়া সাম্রাজ্যের শেষের দিকে পশ্চাত্যের ইন্দনে ধর্মনিরপেক্ষতার ধূঁয়া তুলে উসমানী খিলাফতের অবসান ঘটানো হয়। ১৯২১ সালে কামাল পাশা ক্ষমতা দখল করে তুরস্ককে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ওই সময় তুরস্ক ইসলামী শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাচুর্যে ছিল পরিপূর্ণ। কামাল পাশার সময় ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে বিজাতীয় সংস্কতি চর্চা শুরু হলে ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে এবং তারা লোভ-লালসা, অলসতা ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলমানদের তাহযীব-তমুদ্দুন ও ইসলামী চিন্তা ধারা সঙ্কুচিত হতে থাকে। ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে তুরস্কের মানুষ পাশ্চাত্য জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়েন বিজাতীয় কৃষ্টি কালচারের প্রতি। মিশ্রিত হতে থাকে তাদের চিন্তা ধারার সাথে বিজাতীয় আদর্শ। এই দুই ধরণের সংস্কৃতির সংমিশ্রনের ফলে এক সময় মুসলমানরা তাদের স্বকীয়তা যেমন হারিয়ে ফেলেন; তেমনি তারা তাদের দ্বীনের মূল সুচিন্তা চেতনা, জীবনী-শক্তি থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যান। এ সুযোগেই নব্য জাহিলিয়াত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মুসলিম দুনিয়ায় তার আগ্রাসি জাল বিস্তার করে। তথাকাথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর মুসলমান ইসলামকে খ্রিস্টানদের ধর্মের ন্যায় উন্নতি ও প্রগতির অন্তরায় মনে করেন। তারা ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ইউরোপীয় চিন্তাধারায় যেমন ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতির মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়; সে রকম নীতি মুসলমান সমাজের মধ্যেও বিস্তৃত হয়। পরবর্তীতে তার পরিণতি কি সে ইতিহাস সবার জানা। আমরাও কি সেদিকে যাচ্ছি?
আমাদের দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ শুধু নয়; দিল্লীর শাসকরা যেন আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রাখতে চায়। যার জন্য সুকৌশলে আমাদের কিছু বিবেকহীন বুদ্ধিজীবী, শিল্প সাংস্কৃতিসেবীদের ব্যবহার করছে। আমাদের কিছু পরমুখাপেক্ষী সংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বকে ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশের জমিনে শুরু করেছে সংস্কৃতির আগ্রাসন। বাংলাদেশের টিভি ভারতে নিষিদ্ধ অথচ ভারতের সব টিভি আমাদের দেশে অবাধে প্রচার হচ্ছে। প্রশ্ন হলো স্টার জলসা, জি-বাংলা, স্টার প্লাসসহ কলকাতার টিভি চ্যানেলগুলোতে কি মুসলমানদের সংস্কৃতি আছে? সেগুলোতে কি দেখানো হয়? কোলকাতার টিভিগুলোর নিত্যদিনের সিরিয়াল-নাটকে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, মন্দিরের ঘণ্টা, ঢোলবাদ্য, পূজার সরঞ্জাম প্রাধান্য দেয়া হয়। তাদের সংস্কৃতি ভাইফোঁটা, ভালবাসা দিবস, উল্কি, হোলিখেলা, রাখি বন্ধন ইত্যাদি প্রচার করা হয়। হিন্দুয়ানী সাংস্কৃতি প্রসারে তারা বিজ্ঞাপন, সঙ্গীত শিক্ষালয়, নাট্যবিদ্যালয়, নাট্যশালা, আর্টস্কুল, ফ্যাশন-শো, সঙ্গীত-অভিনয়-সুন্দরী প্রতিযোগিতা, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, সেমিনার, এনজিও, হাসপাতাল, রূপচর্চা, শিক্ষাবৃত্তি, ক্লাব-সমিতি, সাংস্কৃতিক সফর, চলচ্চিত্রকে মাধ্যমে ফেরি করছে। আর টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি আমাদের দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ওই সব টিভি সিরিয়ালে শিক্ষার কিছু নেই; থাকে কপটতা, অনৈতিকতা, পারিবারিক কলহ, কুটিলতা, শিশুদের মিথ্যা বলা, ছলাকলা, চাতুরি শেখানোর কলা-কৌশল। ওই কলাকৌশলে আমাদের সমাজ হচ্ছে কলুষিত।
কয়েকটি ঘটনা : ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর বড়দাপ গ্রামে কিরণমালা সিরিয়াল দেখার সময় ১৬টি পরিবারের বসতবাড়ি-জিনিসপত্র পুড়ে যায়। রাতে ‘কিরণমালা’ সিরিয়াল দেখার সময় রান্নাঘরের চুলার আগুন ঘরে ছড়িয়ে পড়লে বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গত শনিবার সাতক্ষীরার শ্যামনগরে মা টিভির কিরণমালায় মজে থাকায় পুকুরে পড়ে দুই শিশু মারা যায়। খবর হলো রাতে শ্যামনগর উপজেলার বাদুড়িয়া গ্রামের সবুর মোল্লা নামের এক পরিবারের সবাই একত্রে দেখে কিরণমালা। ওই সময় পুকুর পাড়ে খেলা করছিলেন সবুর মোল্লার ছেলে আসাদুর রহমান ও তার চাচাতো বোন মনিরা খাতুন মারা যায়। এর আগের দিন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার চকহরিপুর গ্রামের খলিলুর রহমানের স্ত্রী সোকেলা খাতুন দুই শিশু কন্যাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে কয়েকজন দল বেঁধে অনতিদূরের দোকানের টিভিতে ভারতীয় সিরিয়াল কিরণমালা দেখতে যায়। এরই মাঝে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন ধরে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ১০ বছরের সায়মা জানালা দিয়ে বেরুতে পারলেও আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয় ছোট মেয়ে ৭ বছরের ঋতু। কিরণমালা দেখা নিয়ে ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বোড়াবাড়ি এলাকায় চিত্তরঞ্জন সাহার দুই মেয়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। পরে রাগে দুঃখে বড় বোন সঞ্জিতা সাহা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।
ভারতীয় চ্যানেলগুলোর বেশি দেখানো হয় পরকীয়া, কুটিলতা, নানামুখী দ্বন্দ্ব, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে ফেলার ছলাকলা। এ সব আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। বরং এগুলো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর আঘাত। আজ থেকে প্রায় শত বছর আগে তুরস্কের মুসলমানরা ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে নিজস্ব সংস্কৃতি সিঁকেয় তুলে রেখে; বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চায় মেতে উঠে স্বকীয়তা হারিয়েছিল; আমরাও কি সেভাবেই বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চার নামে নিজস্ব কৃষ্টি কালচার মাটিচাপা দিচ্ছি না? গত কয়েক বছরে দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিপ্লব ঘটেছে। ভারতীয় চ্যানেলগুলো হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বাংলাদেশের দর্শকদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে; অথচ আমাদের চ্যানেলগুলো নীরব কেন? তারা আমাদের সংস্কৃতি ভারতের দর্শকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া দূরের কথা নিজস্ব কৃষ্টি কালচার তুলে ধরতেও কুষ্ঠাবোধ করছে।



 

Show all comments
  • Sajjad ২৩ আগস্ট, ২০১৬, ১:৪৪ পিএম says : 0
    Indian cinema bangladesh e release bondho korte hobe
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমরা কোথায়?
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ