ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
কল্যাণকামিতা থেকে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্যই সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন। সরকার চালানোর দায়িত্ব অর্পিত হয় রাজনৈতিক শক্তির ওপর। মূলত রাজনৈতিক সংগঠন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, রাজনীতি নয় ব্যবসার অনুসঙ্গও। রাজনৈতিক বাতাবরণে উদোরপূর্তি করাও সুস্থধারার রাজনীতির কাম্যও নয়। আসলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এমনটিই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু আমাদের দেশের রূঢ়বাস্তবতায় বিষয়টির বোধহয় অনেকটাই বিচ্যুতি ঘটেছে। একশ্রেণীর আত্মপূজারি অসাধু ব্যক্তির কারণে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত। ফলে রাজনীতি হয়ে উঠেছে শ্রেণী বিশেষের কামনা-বাসনা চরিতার্থ ও ইন্দ্রিয় চর্চার অন্যতম মাধ্যম এবং বিত্ত, বৈভব, যশ, সম্মান ও খ্যাতিসহ বৈষয়িক স্বার্থ হাসিলের মোক্ষম হাতিয়ার। এই বৃত্ত থেকে সহসাই বের হয়ে আসার কোন লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
যেখানে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, দলীয়স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থই হচ্ছে অন্যতম অনুসঙ্গ, জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ সেখানে অনেকটাই অনুপস্থিত। গণতন্ত্র সুশাসন, উন্নয়ন, অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার সোপান হলেও বিষয়গুলো আমাদের ক্ষেত্রে অনেকটাই অধরা। কিন্তু কথায় আমরা কোনভাবেই পিছিয়ে নেই। তাই জনগণকে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঁচামাল হিসেবে। জনস্বার্থের কথা বলে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে দলবাজিকে। এতে আত্মপূজারি মহাজনেরা যেমন উপকৃত হচ্ছে তেমন বাদ যাচ্ছে না খয়ের খা-চুনোপুঁটি আর দালাল-ফঁড়িয়ারাও। কিন্তু জনগণের ভাগ্য অপরিবর্তিত। ভাবটা এরকম যে, ‘খায়-দায় জব্বর আর মোটা হয় মাতবর’। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের মত আমজনতা যে রাজনীতির ‘বলির পাঁঠা’ তা বুঝতে খুব পা-িত্য অর্জনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
কল্যাণ ও শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর রাষ্ট্রের এই দায়বদ্ধতার কারণেই নাগরিকরা রাষ্ট্রর প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে ম্যাকাইভার (Maciver) বলেন, The state is an association which acting through law as promulgated by a government endowed to this end with coercive power, maintaining within a community territorially demarcated, the universal external condition of social order. . অর্থাৎ রাষ্ট্র এমন একটি সংঘ যা সরকারের ঘোষিত আইন অনুসারে কার্য করে। সরকার আইন ঘোষণা এবং তা পালন করার শক্তির অধিকারী। ঐ শক্তির সাহায্যে সরকার নির্দিষ্ট ভূখ-ের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলার বাহ্যিক ও সর্বজনীন অবস্থা বজায় রাখে।
রাষ্ট্রের মূল দায়িত্বই হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা। যুগোপযোগী ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাসহ দেশকে বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে পুরোপুরি রক্ষা করা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৪ দশক অতিক্রান্ত হলেও ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে রাষ্ট্র এখনও সে লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়নি। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানে আইনের তো যথাযথ প্রয়োগ করা হচ্ছেই না বরং সামাজিক ন্যায়বিচারটা এখনও অধরাই রয়ে গেছে।
আইনের শাসন এখন অনেকটাই অনুপস্থিত। সকল ক্ষেত্রেই দলবাজির বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শাসনকাজে জনগণের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রহীনতা চেপে ধরেছে। একদিকে যেমন দেশে আইনের শাসন নেই অন্যদিকে গণতন্ত্রহীনতার কারণেই সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। আর এটিই হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে অস্থিরতা ও নানাবিধ আত্মঘাতী এবং জাতি বিধ্বংসী অপতৎপরতার কারণ। গণতন্ত্রহীনতা শ্রেণী বিশেষের জন্য মনোরঞ্জিকা হলেও দেশ ও জাতির জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়। এ কথা আমরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবো ততই কল্যাণ।
সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশের রাজনীতি এখনও গণমুখী হয়ে উঠেনি। মানুষের কল্যাণ আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য আমাদের দেশের আর্ত-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছতে এখনও সম্ভব হইনি। আমরা কথামালার ফুলঝুরিতে পারঙ্গম হলেও বাস্তবতাটা একেবারে অন্তসারশূন্য। আমরা ক্ষমতার পালাবদল কম দেখিনি। এসব ক্ষেত্রে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলা হলেও অর্জনটা খুবই নগন্য। যারা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কর্মসূচি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়েছেন মূলত ভাগ্যের পরিবর্তনটা তাদের ক্ষেত্রেই বেশ দৃশ্যমান। দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও অসুস্থ রাজনীতিই এ জন্য মূলত দায়ী। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ বৃত্ত থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
কোন রাষ্ট্র বা সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না থাকলে সেখানে অশুভশক্তির উত্থানের বিষয়টি প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। সুশাসনের অনুপস্থিতি গণমানুষের অধিকার বঞ্চিত হওয়ার প্রধান অনুসঙ্গ। রাষ্ট্র যখন গণমানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয় তখন প্রাসঙ্গিক কারণেই নাগরিকরা রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। আর এ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, আত্মঘাতী হানাহানি, গুপ্তহত্যাসহ নানাবিধ অপরাধমূলক তৎপরতা দেখা দিতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণে যেমন দেশে আইনের শাসন প্রয়োজন ঠিক তেমনিভাবে জাতীয় ঐক্যের বিষয়টিও অনস্বীকার্য। দেশে যেভাবে জঙ্গিবাদী অপতৎপরতাসহ অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে তার লাগামটা এখনই টেনে ধরতে না পারলে হয়তো তা অনেক মাসুল আদায় করে নেবে। দেশে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ধ্বংসের মুখোমুখি উপনীত হয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশের পথটা খুবই সীমিত হয়ে এসেছে। রাজনৈতিক ময়দানে বিরাজনীতিকরণের প্রভাবটা খুবই স্পষ্ট। ফলে জাতীয় ইস্যুতে কোনভাবেই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। সরকার সমস্যাগুলোকে বিরোধী দল বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সৃষ্টি বলেই দায় সারার চেষ্টা করছে। কোন ঘটনার গভীরে পৌঁছার চেষ্টা করছে না। আবার বিরোধী দল ও সব কিছুর জন্য সরকারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।