Inqilab Logo

শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বসুন্ধরা সিটিতে আগুন

প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫০ পিএম, ২১ আগস্ট, ২০১৬

কয়েকজন আহত : ষষ্ঠ তলায় জুতার দোকানে সূত্রপাত : শতাধিক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত : ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিট আগুন নেভাতে অংশ নেয় : বসুন্ধরায় বারবার কেন আগুন লাগে -মেয়র আনিসুল হকের প্রশ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এতে কেউ নিহত না হলেও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ষষ্ঠ তলায় একটি জুতার দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক গত রাত ৮টায় সাংবাদিকদের জানান, আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। ফায়ার কর্মীরা ভবনটির ছাদ এবং বিভিন্ন ফ্লোরে আটকেপড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করেন। ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বসুন্ধরা শপিং মলে বারবার আগুন লাগায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। আগুন নেভাতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ফায়ার সার্ভিসকে সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অভিজাত এ শপিং কমপ্লেক্সটির চারতলার এক পোশাকের দোকানের কর্মী জানান, ভবনটির আটতলা অংশের ছয়তলায় জেনিস সু স্টোর থেকে গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে হঠাৎ আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। সেখানকার একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, সকালে আগুন লাগার পর বসুন্ধরা সিটির নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক বাহিনীই প্রথমে কাজ শুরু করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে তারা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সকে খবর দেয়। ততক্ষণে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীদের দাবি, সঠিক সময়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যেত। আগুন লাগার পর মার্কেটটির সবগুলো লিফট বন্ধ করে দেয়া হয়। অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা ভবনটির পেছনের জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি দিয়ে বের হয়ে আসেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলে অনেকে ভেতরে আটকে পড়েন। আত্মরক্ষার্থে অনেকেই ছাদে আশ্রয় নেন।
মার্কেট সমিতির এক ব্যবসায়ী জানান, শপিং মলটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রয়েছে মোবাইল মার্কেট, জুতা-মার্কেট, লেভেল ৮-এ রয়েছে সিনেপ্লেক্স, রেস্টুরেন্ট ও মার্কেট অফিস। লেভেল ৭-এ রয়েছে মেগা শপ। সব মিলিয়ে এখানে ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, শপিং মলের স্টাফসহ বিশ হাজারের বেশি লোকের অবস্থান সেখানে।
আব্দুল মোমিন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, সকাল ৯টার মধ্যে শপিং মলটির কর্মচারীদের উপস্থিত থাকতে হয়। আর ১০টা থেকে বেচাকেনা শুরুর নিয়ম রয়েছে। ঘটনার সময় সবাই কেবল দোকান খুলছিলেন। ক্রেতার তেমন উপস্থিতি ছিল না। পৌনে ১১টার দিকে ৬তলার একটি বন্ধ দোকান থেকে কেবল ধোঁয়াই বের হতে দেখা গেছে। আগুন চোখে পড়েনি। লোকজন কম থাকায় সিঁড়ি বেয়েই নিচে নেমে আসতে সক্ষম হন তিনি।
বিকেল ৪টার দিকে বসুন্ধরার জ্যেষ্ঠ ফোরম্যান আনোয়ার হোসেন মোবাইল ফোনে জানান, যখন আগুন লাগে তখন তিনি নবম তলায় ছিলেন। ধোঁয়া দেখে তিনি ছাদে ওঠেন। বের হতে না পেরে সেখানেই আটকে পড়েন। ছাদে তার সঙ্গে আরো ছিলেন, উপ প্রকৌশলী শামীম হোসেন, ফোরম্যান কবির হোসেন, মামুন হোসেন, হারুন, আসাদ, ইখতিয়ার, জয়, রফিক ও শামীমা নামের এক নারী আটকে পড়েছেন। ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান সাংবাদিকদের বলেন, কমপ্লেক্সের ১০ তলার ওপরে অন্তত ১০ জন লোক আটকে ছিলেন। উদ্ধারের জন্য তারা সহায়তা চান।
এদিকে বেলা আড়াইটার দিকে মার্কেটটির ৫ম তলা থেকে আল-মামুন নামে এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। তিনি বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের একজন স্টাফ বলে জানান। তিনি জানান, ঘটনার পর পর সবাই যখন মার্কেট থেকে বের হয়ে আসছিলেন। তখন তিনি তখন ৪র্থ তলায় ছিলেন। মার্কেটের নিজস্ব ফায়ার কর্মীদের সাথে যোগ দিতে তিনিও ৬তলার দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ধোঁয়ার কারণে তিনি উপরে উঠতে না পেরে ৫ম তলায় আটকে পড়েন।
বেলা ১১টারও আগে আগুন লাগলেও ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, ভবন থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাপকভাবে কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। ধোঁয়ায় ভবনের চারপাশ আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ধোঁয়ার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে। শুরুতে তারা ভবনের গ্লাস ভাঙার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বসুন্ধরা সিটি কর্তৃপক্ষ তা ভাঙতে দেয়নি। যথা সময়ে গ্লাস ভাঙা গেলে ধোঁয়া বেরিয়ে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হতো। অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে গেলে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ক্রেনের সাহায্যে ওপরে উঠে বিভিন্ন তলার গ্লাস ভেঙে দেন। সেসব জায়গা থেকেও ধোঁয়া বের হতে থাকে। একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বাইরের দিক থেকে কমপ্লেক্সের ভেতরে পানি ছিটিয়ে দিতে থাকেন। দুপুরের দিকে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স এলাকার আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা যায়। আগুন নেভাতে পানির ব্যবহার কম করা হয়েছে। অগ্নিনির্বাপনী ফোম ও অন্যান্য গ্যাসের ব্যবহার করা হয়েছে বেশি।
শপিং মলটির লেভেল ৮-এর স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (মিডিয়া অ্যান্ড সেলস) মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, ঘটনার সময় মাল্টিপ্লেক্সে সকালের কয়েকটি ছবির প্রদর্শনী চলছিল। পাশাপাশি দুপুরের শোয়ের জন্যও দর্শকেরা জড়ো হচ্ছিলেন। তবে বৃষ্টির কারণে দর্শকের চাপ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। আগুন লাগার খবর পেয়েই তারা ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেন। দর্শকদের নিরাপদে শপিংমলের বাইরে বের করে দেওয়া হয়।
সড়ক বন্ধ, তীব্র যানজট
আগুন লাগার পর নিরাপত্তার স্বার্থে শপিং কমপ্লেক্সের সামনের সড়ক বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান। তিনি বলেন, পুরো এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। মার্কেটটির সামনের রাস্তার যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও মোতায়েন করা হয় ঘটনাস্থলে। এদিকে আগুন লাগার পর থেকে শপিং কমপ্লেক্সের সামনের রাস্তায় জড়ো হন মার্কেটের ভেতরে আটকে পড়াদের স্বজনরা। এছাড়া সেখানকার ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা সেখানে ভিড় করেন। সকলের চোখে-মুখেই ছিল উদ্ধেগ-উৎকণ্ঠা। ভবনটির লেভেল-৬-এর ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম রুবেল বলেন, শনিবার রাতে দোকানের ক্যাশে নগদ আড়াই লাখ টাকা রেখে আসেন তিনি। রাতে ব্যাংক খোলা না থাকা এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি টাকাগুলো দোকানেই রেখে যান। আগুন লাগার পর থেকে তিনি মার্কেটের সামনের রাস্তায় পায়চারি করছিলেন। আর পরিচিতজনদের কাছে পেলেই বলছিলেন, ঈদকে সামনে রেখে দোকানে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মালামাল কিনেছিলেন। তার আশঙ্কা যেহেতু ৬তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, তাই হয়তো তার দোকানও পুড়ে গেছে। এতক্ষণে হয়তো তার সব শেষ হয়ে গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মী মার্কেটের ভেতরে প্রবেশ করেন। তারা জানান, ৬তলার ৮-১০টি দোকান পুড়ে গেছে। তবে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফায়ার কর্মীরা জানান, ওই সময় পর্যন্ত আগুন নেভানোর কাজ চলছিল। এ সময় পর্যন্ত কতগুলো দোকান পুড়ে গেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একাধিক ব্যবসায়ীর দাবি, কোটি টাকারও বেশি মালামাল ছিল তাদের প্রত্যেকের প্রতিষ্ঠানে।
এদিকে মার্কেটটির বিপরীত দিকে রাস্তার পশ্চিম পাশে পান্থপথে রয়েছে বিশাল ফার্নিচার মার্কেট। বসুন্ধরা শপিং মলে আগুন লাগায় পান্থপথের ওই ফার্নিচার মার্কেটটি গতকাল বন্ধ করে দেয়া হয়। কেউই দোকানপাট খোলেননি। ওই সড়কটি বন্ধ থাকায় আশপাশের সবগুলো সড়কেই দেখা দেয় তীব্র যানজট। মতিঝিল থেকে ফার্মগেট যেতে সময় লেগেছে দুই ঘণ্টারও বেশি। যানজটের কারণে ফার্মগেটের অনেক যাত্রীই শাহবাগ নেমে পায়ে হেঁটেই বাকি পথ পাড়ি দিয়েছেন।
বসুন্ধরায় বারবার কেন আগুন লাগে : মেয়র
বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স সিটিতে বারবার অগ্নিকা-ের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। আগুন লাগার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই দুপুরে ঘটনাস্থলে ছুটে যান তিনি। এ সময় সাংবাদিকরা মেয়রের কাছে অগ্নিকা-ের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমিও জানতে চাই, বারবার কেন এ মার্কেটে আগুন লাগে। এ পর্যন্ত তিন বার এই মার্কেটে আগুন লেগেছে। মার্কেটটিতে কেন বারবার আগুন লাগেÑবিষয়টি আমি নিজেও জানতে চাই। রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ এই শপিং কমপ্লেক্সে লাগোয়া দুটি ভবন রয়েছে। এর পান্থপথ সড়কমুখী আটতলা ভবন এবং পেছনের ১৯তলা ভবন। পেছনের এই ভবনের উপরের দিকে ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ভয়াবহ আগুনে সাতজনের মৃত্যু হয়, আহত হন শতাধিক। এর পর ওই বছরেরই আগস্টে এবং ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা সিটিতে অগ্নিকা- ঘটে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান জানিয়েছেন, শপিং মলটির ৮ম তলা থেকে ফায়ার কর্মীরা ক্রেনের সাহায্যে ১২ জনকে উদ্ধার করেন। তিনি আরো জানান, প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অগ্নিকা-ের কারণ জানতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পরেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে। রাত ৮টায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। এ সময় পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে নিরলস চেষ্টা করছিলেন ফায়ার কর্মীরা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • রুমানা ২২ আগস্ট, ২০১৬, ১:০৮ পিএম says : 0
    সঠিক সময়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া উচিত ছিলো।
    Total Reply(0) Reply
  • Mamun ২২ আগস্ট, ২০১৬, ১:১৫ পিএম says : 0
    সঠিক সময়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়তো এড়ানো যেত।
    Total Reply(0) Reply
  • সাব্বির ২২ আগস্ট, ২০১৬, ১:২০ পিএম says : 0
    হতাহতের হাত থেকে যে মানুষগুলোকে বাঁচানো গেছে এটাও কম কথা নয়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বসুন্ধরা সিটিতে আগুন

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ