Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর সুবে বাংলার নবাবী ও বাঈজী বংশ

প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব
সুবে বাংলার সিংহাসন আরোহণ করে দেশপ্রেমিক ও প্রজাবৎসল নবাব সিরাজুদ্দৌলা ঘরে-বাইরে গভীর ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন। নবাব আলীবর্দী খান সিরাজুদ্দৌলাকে উত্তরসূরি ঘোষণা ও নির্বাচিত করায় নবাব পরিবারের একাংশ নাখোশ ও নারাজ ছিল। বিশেষত নবাব সিরাজের খালা ঘসেটি বেগম এবং খালাতো ভ্রাতা অযোগ্য ও অপদার্থ শওকত জং নবীন নবাবকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। সিপাহসালার মীরজাফর আলী খাঁনের বরাবরই নজর ছিল সুবে-বাংলার সিংহাসনের দিকে। নবাব আলীবর্দীর ভগ্নিপতি হিসাবে সিংহাসনের দাবিদার ছিলেন তিনিও। ধনকুবের জগৎশেঠ, রাজা রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ প্রমুখ ক্ষমতালোভী স্বার্থপর ও ধান্দাবাজ স্বাধীনচেতা সিরাজুদ্দৌলাকে কখনও সমর্থন করেননি। বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ এবং সৈন্য সমাবেশের ঘোর বিরোধী ছিলেন সিরাজুদ্দৌলা। কোম্পানী কোলকাতায় কুঠি নির্মাণ, শক্তি সঞ্চয় ও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সিরাজুদ্দৌলা সসৈন্যে কোলকাতা আক্রমণ ও দখল করেন। কোলকাতা বিজয় ও বেনিয়া বৃটিশদের বিতাড়িত করে তিনি প্রিয় মরহুম দাদুর নামে কোলকাতার নামকরণ করেন আলীনগর। শক্ত হস্তে রাজ্য শাসন ও দূষমন দমনে কঠোরতার কারণে সিরাজুদ্দৌলার প্রতিপক্ষ কোম্পানী কর্মকর্তা, মীরজাফর জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ-রাজা রাজবল্লভরা ভাবলেন বাংলার নবাবকে আর সময় দেয়া যায় না। সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়। সেই মর্মে ধনকুবের জগৎশেঠের বাড়িতে সিপাহসালার মীরজাফর, রাজা রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ, ইংরেজ প্রতিনিধি ওয়াটসের উপস্থিতিতে এক গোপন বৈঠক ও চুক্তি হয় নবাবকে সিংহাসন থেকে হটিয়ে সেনাপতি মীরজাফর আলী খানকে সুবে বাংলার নবাব নিযুক্ত করার। বিনিময়ে মীরজাফর কোম্পানীকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা দেবেন। এই গোপন চুক্তির ফল ও ফসল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ।
পলাশীর যুদ্ধে সুবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়-পতন ও শাহাদাত বরণে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য চির অস্তমিত হয়। ২৯ জুন রবার্ট ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ হিরাঝিল প্রাসাদে পৌঁছে মীরজাফর আলী খানকে হাতে ধরে বাংলার মসনদে বসিয়ে লোক দেখানো একটি সেলিউট করেন। সিরাজুদ্দৌলার পতন ও মৃতুর এবং বিদেশী বেনিয়া কোম্পানীর দয়া দাক্ষিণ্য ও করুণায় সিপাহসালার মীরজাফরের সিংহাসন আরোহণের মধ্যদিয়ে স্বাধীন নবাবী শাসনের অবসান ঘটে। নবাবী নিমন্ত্রন নিয়ে নেয় বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। এই প্রেক্ষিতে স্যার যদুনাথ সরকার যথার্থই বলেন- “ঞযঁংবহফবফ সঁংষরস ৎঁষব রহ নবহমষধ, ঃযব ভড়ৎরমহ সধংঃবৎ ড়ভ ঃযব ংধিৎফ যধফ নবপধসব রঃং শরহম সধশবৎ.”
পলাশীর যুদ্ধের আশু ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল ভয়াবহ। পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক বিজয়ের পর কোম্পানী শক্তিশালী মারাঠা, মহিশূরের অধিপতি মহাবীর টিপু সুলতান এবং ১৮৫৭ সালে ‘সিপাহী বিদ্রোহে’ দিল্লীর শেষ মুঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে সমগ্র ভারতবর্ষে শাসন ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করে। পলাশীর যুদ্ধের পর বিশ্বাসঘাতকের আরেক নাম হয়ে যায় মীরজাফর। মীরজাফর আর বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায় সমার্থক।
পলাশীর বিপর্যয়ের পর নবাবী ও প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা-অনাচার-বিপর্যয় দেখা দেয়। মীরজাফর রাজ্য পরিচালনায় অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিলে কোম্পানী তাকে হটিয়ে তার জামাতা মীর কাসেমকে নবাব বানায়। বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও বিপর্যস্ত প্রশাসনের মধ্যে মীর কাসিম ও রাজ্য পরিচালনায় কোন পারঙ্গমতা প্রদর্শন করতে পারেননি।কার্যত কোম্পানী-মীর কাসেম দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ বেধে যায়। কোম্পানী মীরজাফরকে পুনরায় নবাবের গদিতে বসালে মীর জাফর ক্ষমতার লোভে নিজ জামাতা মীর কাসিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। মীর কাসিম দুর্ভাগ্যজনকভাবে উদয়নালার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যান। পরে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে বহু কষ্ট ভোগের পর মীরজাফর কিরীটেশরী দেবীর পাদোদক পান করতে করতে করুণভাবে প্রাণ ত্যাগ করেন। শাহ খানমের গর্ভজাত এবং মীরজাফরের ঔরসজাত সন্তান মীর সাদেক আলী খান মিরনের ইতিপূর্বে বর্জপাতে মৃত্যু হওয়াতে সুবে বাংলায় শুরু হয়-বাঈজী বংশের শাসন। মীরজাফরের ঔরসজাত এবং বাঈজী মুন্নী বাঈর গর্ভজাত নজমউদ্দৌলা (১৭৬৫-৬৬ খ্রিঃ)-কে কোম্পানী বাংলার নবাব বানায়। ঐতিহ্যবাহী বাংলায় শুরু হয় বাঈজী বংশের কুশাসন-দুঃশাসন। বাঈজী বংশের দ্বিতীয় নবাব হন মুন্নী বাঈর অপর সন্তান সাইফউদ্দৌলা। বাঈজী বব্বু বাঈ ও ভাগ্যবতী রমণী। নবাব মাতা হতে তিনিও বাদ পড়েননি। সুবে বাংলায় পরবর্তী নবাব হন বব্বু বাঈর গর্ভজাত সন্তান মোবারক উদ্দৌলা (১৭৭১-৯৩)। মুন্নী বাঈর চাইতে বব্বু বাঈ ভাগ্যবতী রমণী। অতঃপর তারই পুত্র ও নাতিগণ ধারাবাহিকভাবে বাংলার পুতুল নবাব হন। নবাব হুমায়ুন জাহ ছিলেন সুবে বাংলার শেষ নবাব। ১৮২৪ থেকে ৩৮ সাল পর্যন্ত নামকাওয়াস্তে বাংলার সিংহাসনে ছিলেন হুমায়ুন জাহ। অতঃপর কোম্পানী আর সমগ্র সুবে বাংলা নয়, শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদের নবাব নিয়োগ দিত। মুর্শিদাবাদের প্রথম নবাব ছিলেন ফারেদুন জাহ (১৮৩৮-৮১) এবং শেষ নবাব ছিলেন ওয়ারেশ আলী মির্জা (১৯৫৯-৬৯)। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে বৃটিশ বিদায় ভারত বিভক্তি এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন দেশের জন্মলাভের পর সুবে বাংলা ও নবাবী অস্তিত্বহীন হলেও ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ভারত সরকার মীরজাফরের বংশধরকে নবাব মনোনয়ন ও ভাতা প্রদান করে। পাকিস্তান আমলে প্রজাস্বত্ব আইন নামে খ্যাত স্টেইট এ্যকুইজিমান এন্ড টেনেন্সী এক্ট পাসের ফলে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং ভূমিতে রায়ত-প্রজার স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায় নবাব ওয়াসিফ আলী থেকে এই বংশ মির্জা পদবী ধারণ করে।
দ্বাদশ শতাব্দীর দিল্লীর স¤্রাট কুতুব উদ্দীন আইবেক মামলুক বংশীয় ক্রীতদাস হলেও যুদ্ধ ও রাজ্য পরিচালনায় ছিলেন প্রশংসারপ্রাপ্ত ও কৃতিত্বের ভাগিদার। তারাইনের যুদ্ধে দিল্লীর মহা শক্তিশালী শাসক পৃথ্বিরাজের তিন লক্ষধিক বিশাল সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র সোয়া লাখ সৈন্য নিয়ে ভারত বিজয় করেন শাহাবুদ্দীন মোহাম্মদ ঘোরি তার সেকেন্ড ইন-কমান্ড ছিলেন ক্রীতদাস কুতুব উদ্দীন আইবেক। পৃথ্বিরাজের পরাজয় ও মোহাম্মদ ঘোরির বিজয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। দিল্লী বিজয়ের পর মোহাম্মদ ঘোরি কুতুব উদ্দীন আইবেককে দিল্লীর শাসনভার দিলে তিনি কৃতিত্ব ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। তার অমর কীর্তি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার কুতুব মিনার মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন ইতিহাস গবেষকদের গবেষণার বিষয়। মামলুক বংশীয় ক্রীতদাস কুতুব উদ্দীন আইবেক দ্বাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিহীন অন্ধকার যুগেও যুদ্ধ রাজ্য শাসন ও স্থাপত্য শিল্পে বিপুল অবদান রেখে গেছেন। অথচ সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইরাকের নজাফি সৈয়দ মীরজাফর আলী খার অধস্তন বংশধর নজমউদ্দৌলা থেকে ওয়ারেশ আলী মির্জা (৫১-৬১) পর্যন্ত কেউ দেশ-জাতি ও মানব কল্যাণে কোন কাজ করেননি। বরং হালি হালি পতœী, ডজন ডজন উপপতœী এবং শত শত রক্ষিতা রেখে সুরা আর বাঈজীতে ব্যস্ত থেকেছেন। বৎসরান্তে বেহিসেবি সন্তানের পিতা হয়েছেন, বৎসরান্তে ইংরেজদের নিকট থেকে ভাতা গ্রহণ করেছেন। এসব অকর্মন্য, অপদার্থ, চরিত্রহীন, মদ্যপ পুতুল নবাবদের কাজ ছিল মীরজাফরের বংশ বৃদ্ধি করা, ইংরেজদের মোহসাহেবী করা, বেতন ভাতা নেয়া।
সুবে বাংলার শেষ স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজুদ্দৌলার বংশকে নিরবংশ করার জন্য মীরজাফর-ক্লাইভ-জগৎশেট-রায় দুর্লভ চক্র নবাবের পুরুষ বংশীয় সকলকে হত্যা করে। মীরজাফরের বংশ বৃদ্ধির জন্য সুবে বাংলার বদমায়েশ ও পুতুল নবাবেরা কেবল সন্তন প্রজনন করেন। মীরজাফরের বাঈজীপুত্র মুবারকউদ্দৌলার দশ জন স্ত্রীর গর্ভে বারো পুত্র, তেরো কন্যা সন্তান ছিলেন। মীর বংশের শেষ নবাব ফারেদুন জাহর বহু বিবাহের ফল ও ফসল ষোল পুত্র, চৌত্রিশ কন্যা সন্তান। অর্ধশত সন্তানের পিতা হওয়া উপমহাদেশীয় শাসকদের মধ্যে একটি রেকর্ড বটে। অবস্থাদৃষ্টে সন্তান ও সন্ততির সংখ্যায় মনে হয় অপদার্থ শাসকদের সন্তানের জন্ম দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। বাঈজী বংশের কথিত নবাবগণ ছিলেন কোম্পানীর বেতনভুক কর্মচারী। নবাব নজমউদ্দৌলার বার্ষিক ভাতা ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ১৬১ টাকা হলেও পরবর্তী পর্যায়ে তাদের প্রভুরা বেতন ভাতা কমিয়ে দেয়। নবাব হাসান আলীর আমলে তা বার্ষিক মাত্র ২২ হাজার টাকায় নেমে আসে। বেনিয়া কোম্পানী ও ধূর্ত ক্লাইভরা তাদের মনোনীত-নিযুক্ত নবাবদের বার্ষিক ভাতা দিলেও বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার সহধর্মিণী বেগম লুৎফুন্নেসাকে তার ও পরিবার বর্গের ব্যক্তিগত ধনসম্পদ, টাকা পয়সা ফেরত দেয়নি। বেগম লুৎফুন্নেছা তাঁর নিজের এবং একমাত্র কন্যা সন্তান উম্মেজোহরার ভরণপোষণের জন্য নিজ ধনসম্পদ ফেরত চাইলেও পাননি। খোশবাগের শাহী কবরস্থানের মোতাওয়ালী হিসাবে তিনি তিনশ পাঁচ টাকা ভাতায় কবর পরিচর্যার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় এক মুসলিম নারী যে উন্নত নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন তা প্রশংসনীয়।
লেখক: সেক্রেটারী, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিয়র এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর সুবে বাংলার নবাবী ও বাঈজী বংশ
আরও পড়ুন