পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ২নং রোড। বাড়ি নম্বর ১৪। সিঁড়ি ভেঙে ৫ম তলায় উঠলেই বিরাট অফিস।
দরজায় ছোট্ট করে লেখা ‘সেবা আইডিয়াস’। বড় করে লেখা ‘প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত’।
বাহ্যত : এটি একটি বাসাবাড়ি। কার্যত : এটি একটি পুরোদস্তুর টাকার আড়ৎ। লাখ লাখ নগদ টাকার লেনদেন চলছে। সকাল থেকে রাত অবধি এ অফিসে জমা পড়তে থাকে বান্ডিল বান্ডিল টাকা। এ টাকা অন্যকিছুর নয়। মাল্টি লেবেল মার্কেটিং (এমএলএম) এর টাকা। তবে এখানকার স্টাইলটি ভিন্ন। এমএলএম’র বিদেশি পণ্য বিক্রির মতো চেনাজানা কোনো রূপ নেই অফিসটিতে। চোখে পড়ে না থরো থরো সাজানো কোনো চটকদার ব্রæশিউর। উড়োজাহাজে করে সপরিবারে থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর ঘুরে বেড়ানোর প্রলোভনও নেই এখানে। তবে যেটি আছে, সেটি হচ্ছে- অভিনব ‘আইডিয়া’।
‘সিলসিটি’ নামে আস্ত একটি শহরই দিয়ে দেয়া হচ্ছে নামমাত্র মূল্যে। ‘সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড টেকনোলজি লিঃ’ নামক কথিত এ প্রতিষ্ঠান হাউজিং প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে ‘সিলসিটি’। রাজধানী উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে এ প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন, ক্ষমতাসীন কয়েকজন ব্যক্তির আশীর্বাদ, ছাত্র নেতারা রয়েছেন নেপথ্যে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সামনে রয়েছেন জনৈক কাজী নূরুল ইসলাম। মূলত: রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে এমএলএম প্রতারণাই কথিত প্রতিষ্ঠানটির মূল কার্যক্রম। নূরুল ইসলাম বলেন, স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে, মধ্যম আয়ের মানুষদের আবাসন এবং জীবিকার ব্যবস্থা করতেই আমরা নতুন কনসেপ্ট নিয়ে এসেছি।
সিলসিটি কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শনে পাওয়া গেছে কিছু খন্ডচিত্র। মিলেছে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল ইসলামের স্বীকারোক্তিও। তবে ভুক্তভোগীরা দেন ভিন্নতথ্য। রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে সামনে রেখে প্রশিক্ষিত এমএলএম ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম এরই মধ্যে তার ‘উদ্ভাবনী ক্ষমতা’ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েকশ’ কোটি টাকা। এর আগে তিনি উত্তরা কেন্দ্রিক ‘ব্রাইট ফিউচার লিঃ’র নামক এমএলএম কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। সেই আইডিয়া নিয়েই তিনি ‘সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড টেকনোলজি লিঃ’ নাম নিয়ে এমএলএম প্রতারণায় নেমে পড়েন। ‘সিলসিটি’ নাম দিয়ে রাজধানীতেই তিনি গ্রাহককে তৈরি করে দিচ্ছেন আধুনিক শহর! সহজ শর্তে স্বল্পমূল্যে গ্রাহককে এখানে ফ্ল্যাট-প্লট দিচ্ছেন। নূরুল ইসলাম অকপটেই স্বীকার করেন, সারাদেশ থেকে অন্তত: ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া প্রতিষ্ঠান ‘ইউনিপে টু ইউৎ এবং ‘ব্রাইট ফিউচার লিঃ’ নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছেন এখানে।
তারই অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, ‘সিলসিটিতে’ বুকিং দিলে গ্রাহকরা প্লট পাবেন। বুকিংয়ের পর কেউ যদি লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত নিতে চান, তাহলে প্লটের বিপরীতে অর্থ লগ্নিকৃত ১ লাখ টাকার বিপরীতে মাসে সাড়ে ৮ হাজার টাকা লভ্যাংশ ফেরত দেয় এ কোম্পানি। তাই প্লট কিংবা ফ্ল্যাট নয়- ‘লভ্যাংশ’র প্রলোভনেই গ্রাহকরা এখানে অর্থলগ্নি করেন। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-স্বজনদের কানেকশনে এখানে গ্রাহকরা বুকিং দেন। এ কারণে এটির কোনো প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন হয় না বলে জানান তিনি। কোনো বিজ্ঞাপনও নেই। কোথায় তার প্রকল্প- সেটিও গ্রাহকরা জানতে চান না।
টাকা খুইয়ে নিঃস্ব ভুক্তভোগী আবু তাহের জানান, কাজী নূরুল ইসলামের কোম্পানির মূল টার্গেট অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, গৃহবধূ, প্রবাসী এবং বেকার-তরুণ-তরুণী। এরা অধিক মুনাফার প্রলোভনে সারাজীবনের সঞ্চয় তুলে দেন নূরুল ইসলামের হাতে। পরে লগ্নিকৃত অর্থ প্রতিশ্রুত লভ্যাংশসহ ফেরত চাইলে কিছু অর্থ ফেরত দেন। অনেক ক্ষেত্রেই টালবাহানা করেন। কিছু অর্থ ফেরত দেন কৌশল হিসেবে। গ্রাহকের মাঝে অর্থ ফেরত দেয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। আস্থা সৃষ্টির জন্য। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফেরত দেয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে নিরীহ লগ্নিকারীদের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, প্রভাবশালী এবং মাস্তানদের দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়। জড়ানো হয় মিথ্যা মামলায়।
ভুক্তভোগী আলী হোসেন জানান, অধিক মুনাফার লোভে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তিনি এ কোম্পানিতে ২ লাখ টাকা লগ্নি করেছেন। অথচ এখন তিনি মুনাফা তো দূরে থাক, আসল টাকাই পাচ্ছেন না। দেবো-দিচ্ছি করে টালবাহানা করছেন।
আরেক ভুক্তভোগী জানান, ‘সেবা আইডিয়াস রিয়েল এস্টেট কোম্পানি’ হিসেবে অর্থলগ্নিকারীদের মাঝে প্রচার চালালেও কোথায় তাদের সাইট অফিস, কোথায়ই বা তাদের জমি-প্লট-ফ্ল্যাট তা দেখায় না। রিয়েল এস্টেট কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)রও কোনো অনুমোদন নেই। ‘কাগজপত্র’ বলতে রাজউকে কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য করে রাখা একটি ‘আবেদনপত্র’ দেখাচ্ছে সিলসিটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহককে ওই আবেদন ফরম দেখিয়ে এই বলে বিভ্রান্ত করা হয় যে, রাজউক কর্তৃক তাদের প্রকল্প অনুমোদিত। এরই মধ্যে নাকি কোম্পানির নামে শত শত বিঘা জমি কেনা হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, রাজধানীর দক্ষিণখান বাজারের শেষ প্রান্তে কাচকুড়া মৌজায় জলাশয়ে রয়েছে ‘সিলসিটি’ নামক কয়েকটি সাইনবোর্ড। কয়েক বর্গফুট জমি ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এসব সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোতালিব মিয়া জানান, সিলসিটি’র নামে এখানে কোনো জমি নেই। তবে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল ইসলামের দাবি- কোম্পানির নামে তাদের ১০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এখানেই ‘সিলসিটি’র ১২শ’ ফ্ল্যাট নির্মাণ হবে। এরই মধ্যে শত শত গ্রাহক এসব ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছেন। তারা মাস মাস কিস্তিতে অর্থ জমা করছেন। তবে অনেকে এককালীন ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা জমা দিচ্ছেন। যদিও এদের কোনো তালিকা নূরুল ইসলাম দিতে সম্মত হননি।
নূরুল ইসলাম বলেন, আমরা ১৫০০ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। যেসব গ্রাহক ফ্ল্যাট পাবেন না, তাদের পরবর্তী প্রকল্প থেকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হবে। ‘সিলসিটি’কে সরকার অনুমোদিত একটি বৈধ কোম্পানি বলেও দাবি করেন। তবে এটির কোনো প্রচার-প্রকাশনা নেই। প্রচার-প্রচারণায় যে অর্থ খরচ হয়, সেটি তিনি কমিশন হিসেবে যারা ‘মিডিয়া’ করেন তাদের দিয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, আমাদের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে অনেকে দুর্নাম রটাচ্ছে। এতে ইনশাআল্লাহ কোম্পানি বন্ধ হবে না। আপনি কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারবেন না যে, আমরা প্রতারণা করছি!
একপর্যায়ে এমএলএম কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দম্ভের স্বরেই বলেন, যান! পারলে যা করার করেন। আমরা সেবা আইডিয়াস কো-অপারেটিভ লিঃ-এর নামে টাকা নিয়েছি। ডেসটিনি, যুবক, আইডিয়াল কো-অপারেটিভ যেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, সেগুলো দেখেন না? ‘ব্রাইট ফিউচার’ও তো একইভাবে টাকা নিচ্ছে। তাদের ব্যাপারে কিছু বলেন না কেন?
তিনি বলেন, ১ লাখ টাকায় সাড়ে ৮ হাজার টাকা দিচ্ছি- এটি এই দেশে কে দেবে? একমাত্র আমরাই দিচ্ছি। সিলসিটিতে ৩ কাঠার প্লটের দাম ৭৫ লাখ টাকা। ১৩শ’ স্কয়ার ফিট ফ্ল্যাটের দাম ৬৫ লাখ টাকা। যারা এককালীন টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন না, তাদের জন্য রয়েছে শেয়ারের ব্যবস্থা। তাহলে বলুন, এ অফার আর কে দিতে পেরেছে? ‘প্লট-ফ্ল্যাটের পরিবর্তে লভ্যাংশ কেন দিচ্ছেন, কোত্থেকে আসছে লভ্যাংশের টাকা?’ জানতে চাওয়া হলে নূরুল ইসলাম বলেন, গ্রাহকদের টাকাই গ্রাহককে দিচ্ছি। যারা টাকা জমা রাখছেন তাদের টাকা অন্য গ্রাহকের ‘লভ্যাংশ’ দিচ্ছি। ৩ বছর ধরে চালাচ্ছি। আমরা কোনো ফ্রড কোম্পানি হলে বহু আগেই ফ্লপ করতাম। আল্লাহর রহমতে আমরা এভাবেই এখনো টিকে আছি।
সিলসিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, মূলত ‘সিলসিটি’ নামে কথিত আবাসন প্রকল্পের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছেন নূরুল ইসলাম গং। ‘সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড টেকনোলজি লিঃ’ এর প্রকল্প ‘সিলসিটি’ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। যারা ‘লগ্নিকারী’ বাগিয়ে আনতে পারেন, তাদের দেয়া হয় ১০ শতাংশ হারে কমিশন। ‘বিনা পুঁজিতে ব্যবসা’ দেয়া হয় তাদের। সাবেক এই কর্মকর্তা জানান, মূলত সিলসিটি ব্রাইট ফিউচারের নতুন একটি সংস্করণ। এমএলএম’র মাধ্যতে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেয়াই এটির মূল উদ্দেশ্য।
এদিকে নাকের ডগায় এমএলএম প্রতারণা চালালেও নির্বিকার স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ‘সিলসিটি’র কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকার উত্তরা-পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিকীকে গতকাল বিকেলে একাধিকবার ফোন করা হয়। ক্ষুদেবার্তাও পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে তিনি সাড়া দেননি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।