Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রেডিওতে আরবি অনুষ্ঠান চালু করা ছিল বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী
১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাস মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া নামে অভিহিত ইসরাইল মিসর আক্রমণ করে। সারা বিশ্বের মুসলমানদের ন্যায় বাংলাদেশের মুসলমানগণও  মিসরের পূর্ণ সমর্থনে এবং আগ্রাসী ইসলাইলের বিরুদ্ধে নিন্দা, প্রতিবাদ ও ক্ষোভে ফোটে পড়ে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে মিসরের সমর্থনে তার পাশে থাকার কথা ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা দিয়েই সরকার থেমে থাকেনি, ত্বরিত প্রাথমিক সাহায্য হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ভ্রাতৃপ্রতিম আরব ভাইদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চা এবং কয়েকটি চিকিৎসক দল প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ প্রেরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, যুদ্ধে আরব ভাইদের সাহায্যের জন্য সংস্থা ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা পাঠাতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের এ ব্যবস্থা ও প্রতিশ্রুতিতে আরবরা মহাআনন্দিত হয়। বাংলাদেশের চা ও মেডিকেল টিমগুলো পেয়ে তারা মহা উপকৃত হয়। বিশেষত চা পেয়ে এতই আনন্দিত হয় যে, বারলেভ লাইনের হষোৎফুল মিসরীয় সৈন্যদের কাছে চায়ের অপর নাম বাংলাদেশ হয়ে যায় এবং মিসরবাসীর মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম উচ্চারিত হতে থাকে। কয়েস (মহান) মুজিবুর রহমান (মিসরে জীম বর্ণমালার উচ্চারণ সাধারণত গাইন হয়ে থাকে) বঙ্গবন্ধু আরবদের নিকট অতিপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষ হতে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের ফলে তখন পর্যন্ত মিসর ও ইরাক ব্যতীত মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়নি। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে আরবদের সমর্থন ও পাশে থাকার ঘোষণার পর বাংলাদেশকে আরব রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক স্বীকৃতি ত্বরান্বিত হয়। অপর দিকে বঙ্গবন্ধু সরকার বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি লাভের জন্য তৎপরতা জোরদার করে। এ ব্যাপারে গৃহীত নানা পদক্ষেপের মধ্যে একটি ছিল বেতারে অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করা। এ সময় আরব শ্রোতাদের জন্য আরবি অনুষ্ঠান প্রচারের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে, যার পটভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের হজযাত্রার ঘটনা স্মরণীয়। পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার বিরুদ্ধে মওলানা তর্ক বাগীশের হজ উপলক্ষে সউদী আরব সফর বিশেষ ফলদায়ক হয়েছিল এবং এ সফরে তার অর্জিত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্বের কার্যক্রম হতে আরবি অনুষ্ঠান প্রচারে মৌলিকভাবে কাজ করেছে এবং তারই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাত্র ৩ দিনের মধ্যে আরবি অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়ে যায় এবং সেই অনুষ্ঠান প্রচার এখনো চলমান আছে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কীর্তির ন্যায় এটিও বঙ্গবন্ধুর একটি সুদূরপ্রসারী কীর্তি এবং আরব ভাইদের সাথে সৌভ্রাতৃত্ব ও গভীর সম্পর্কের উজ্জ্বল নিদর্শন। মওলানা সাহেবের সান্নিধ্যে আসার সুবাদে তারই মুখে শোনা কাহিনীটি নি¤œরূপঃ
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হজযাত্রী দলের নেতা ছিলেন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতি সউদী সরকারের কূটনৈতিক স্বীকৃতি না থাকায় প্রথম দিকে কিছুটা আইনগত জটিলতা দেখা দিলেও বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে তা অচিরেই দূর হয়ে যায়। মওলানা সাহেবের নেতৃত্বে হজ প্রতিনিধি দল যথাসময়ে মক্কা শরীফে পৌঁছে এবং সেখানে অবস্থানকালে দুনিয়ার নানা স্থান থেকে আগত বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় হজযাত্রী ও স্থানীয় সরকারী ও বেসরকারী লোকজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং অনেকের সাথে মতবিনিময় হয়। নতুন স্বাধীনতা লাভকারী দেশের হজযাত্র দলের নেতা হিসেবে তিনি সকলের ভক্তি ও শ্রদ্ধা লাভ করেন এবং সকলের চমৎকার ব্যবহারে তিনি দারুণভাবে অভিভূত হন। কিন্তু তিনি অনুভব করতে পারেন যে, পাকিস্তানী অপপ্রচারের ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু কিছু লোকের মধ্যে যেন চাপা অসন্তোষ ও সন্দেহ বিরাজ করছে তার সাথে আলাপ-আলোচনার পর তারা সন্দেহমুক্ত হতে থাকে। সাথে সাথে মওলানা সাহেব এটাও উপলব্ধি করেন যে, সউদী আরবসহ বিভিন্ন দেশের হাজীদের মধ্যে বাংলাদেশ ও এদেশের মুসলমানদের সম্পর্কে জানার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। হজের অনুষ্ঠানাদি শেষ করে মদীনা মোনাওয়ারায় রওজা শরীফ জিয়ারত করতে গিয়ে সেখানে অবস্থানকালেও ঠিক একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য আরবদের কাছে তুলে ধরার উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে সেখানে পাকিস্তানীরা একতরফা বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত। এ সম্বন্ধে মওলানা তর্কবাগীশ বলেন যে, হারামাইন শরীফাইনে অবস্থানকালেই তিনি স্থির করেন যে, ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রস্তাব রাখবেন বেতারে আরব ¯্রােতাদের জন্য আরবি অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করতে। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করার পর মওলানা তর্কবাগীশ প্রস্তাব করেন যে, আরবদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদ্যমান সংশয় এবং পাকিস্তানের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার বন্ধ করতে বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমগুলোকে  জোরদার ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি বিশেষভাবে আরব বিশ্বের জন্য স্বতন্ত্র একটি প্রচার মাধ্যম করা উচিত এবং তা হতে পারে আরবি ভাষায়। কেননা আরবি তাদের একমাত্র ভাষা। পাকিস্তান নানাভাবে আরবি ভাষায় আরবদের মধ্যে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে, এমন কি তাদের রেডিও থেকে আরবি ভাষায় একটি বিশেষ অনুষ্ঠানও প্রচারিত হয়ে থাকে যার মাধ্যমে তারা আরবদের বিভ্রান্তে করে চলেছে। তাই তাদের যথার্থ জবাবদানের জন্য বাংলাদেশ বেতার হতে একটি আরবি অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করাই হবে বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ বললেন, তাই করা হবে।
একটি ঘরোয়া বৈঠকে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এসব তথ্য জানান এবং তার প্রস্তাবটি বঙ্গবন্ধু কীভাবে বাস্তবায়িত করেন তা বলতে গেলে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞার কথা এসে যায়। এই লেখক ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্বের কার্যক্রমের উর্দু অনুষ্ঠানে কথিকা লেখক হিসেবে যোগদান করেন। মূলত অনুষ্ঠানটি ছিল পাকিস্তানীদের জন্য যা এখনো অব্যাহত আছে। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষভাবে অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানী নেতৃবর্গের নানা বক্তব্যের জবাব দেয়া হতো সংবাদ পর্যালোচনা ও কথিকা প্রচারের মাধ্যমে। আমার কথিকা লেখার বিষয়গুলো নির্ধারণ করা হতো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। আমার লিখিত কথিকাগুলো পাঠ করতেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এবং উর্দু অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জাহেদ সিদ্দিকী। তখন বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ মোহাদ্দেস। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন আপনাকে আর উর্দু অনুষ্ঠানে থাকতে হবে না, আমরা অচিরেই আরবি অনুষ্ঠান চালু করতে যাচ্ছি, আপনি সে অনুষ্ঠানেই থাকবেন। মোহাদ্দেস সাহেব জানালেন প্রধানমন্ত্রী জরুরি নির্দেশ দিয়েছেন ৩ দিনের মধ্যে আরবি অনুষ্ঠান চালু করতে হবে। তিনি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার গ্রহণের জন্য জাপান গমন করছেন আগামী রোববার সেখান থেকে আরবি শুনতে চান। মোহাদ্দেস সাহেব বললেন হাতে মাত্র তিনদিন সময় আছে এ সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান প্রচারের আয়োজন শেষ করতে হবে। এমন কিছু আলেমের নাম বলুন যারা ভালো আরবি জানেন এবং আরবিতে অনুষ্ঠান করার উপযুক্ত। আমি তৎক্ষণাৎ  মওলানা আলাউদ্দীন আজহারীর নাম উল্লেখ করলাম। পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় বললাম, ঢাকা সরকারী আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষাপ্রাপ্ত। আবাসিক ঠিকানা জিজ্ঞাসা করায় তাও বললাম। সঙ্গে সঙ্গে মোহাদ্দেস সাহেব একজন সহকারী পরিচালককে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত মগবাজারস্থ মওলানা আজহারী সাহেবের বাস ভবনে চলে যান এবং তার সাথে কথাবার্তা চূড়ান্ত করে ফিরে আসেন। পরের দিন আমিসহ আরো কয়েকজনের কণ্ঠ পরীক্ষা করার হয়। আমিসহ আরো দু’জন ছিলেন মওলানা হাফেজ মোহাম্মদ জাকারিয়া ও মওলানা হাফেজ মোহাম্মদ আকরাম ফারুক। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী মাত্র তিনদিনের মধ্যই অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর রোববার রাতে মওলানা আজহারীর পরিচালনায় মোট চারজন নিয়ে প্রথম আরবি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।
উল্লেখ্য, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রম বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি প্রশতু, পাঞ্জাবী এবং উর্দু ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার চলে আসছিল। এক ঘণ্টাব্যাপী হিন্দি অনুষ্ঠানকে আধা ঘণ্টায় হ্রাস করে বাকি আধা ঘণ্টা আরবি অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য বরাদ্দ করা হয়। প্রচারের সময়ে পরিবর্তন আনা হলেও প্রচারের সময় আধাঘণ্টা (৩০ মিনিট) অক্ষুণœ থাকে। প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন রাত সাড়ে ১১ থেকে ১২টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচারিত হতে থাকে। অতঃপর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত, ফের রাতে এবং এখনো রাতে চলে।
২০ অক্টোবর সূচনা অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ মিসরীয় রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ওয়াফা হেজাজী এবং ঢাকাস্থ ইরাকি দূতাবাসের চার্জ দ্য এফেয়ার্স হাসান আল আনবারী মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে দুটি কথিকা পাঠ করেন। এ দুই কূটনৈতিক মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে আরবদের সমর্থন দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি বিশেষ প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রেডিওতে আরবি অনুষ্ঠান চালু করা ছিল বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত
আরও পড়ুন