Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

কে বেশি জনপ্রিয়?

প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার
বিজ্ঞানের বদৌলতে মত প্রকাশের এখন নানা মাধ্যম। একসময় শুধু গণমাধ্যম ছিল। পত্রপত্রিকার পাশাপাশি এখন শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনেরও আবির্ভাব ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগ মত প্রকাশে নতুন দিগন্তের দুয়ার খুলে দিয়েছে। প্রতিটি মাধ্যম নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে নিত্যনতুন পন্থা-কৌশল উদ্ভাবন করছে। মত প্রকাশে বর্তমানে গণমাধ্যম (পত্রপত্রিকা-রেডিও-টিভি) আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের (ফেসবুক-টুইটার-ব্লগ) মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। প্রশ্ন হলো অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগে কে বেশি জনপ্রিয়? গণমাধ্যম নাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম? কোন মাধ্যম বেশি কার্যকরভাবে মানুষকে তাড়িত করছে? গণতান্ত্রিক দেশে ভোটের অধিকারের পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পর ভোটের অধিকার কার্যত সংকুচিত হয়ে আসছে। পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে তার প্রমাণ মেলে। জনগণের ভোটের অধিকারের পক্ষে মতামত তুলে ধরা মানুষের মত প্রকাশ এবং মনের খোরাক জোগাতে কে বেশি কার্যকর। কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থান যেভাবে ঘটেছে এবং মাধ্যমটি যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তাতে গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিত পত্রপত্রিকা, রেডিও-টিভি কি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে না?
রাষ্ট্র থাকলে সরকার থাকবেই। গণতান্ত্রিক দেশে সরকার থাকলে বিরোধী দল থাকবেই। সেই বিরোধী দলের কাজ হলো দেশের মানুষের স্বার্থ নিয়ে সংসদে কথা বলা। সারাবিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রেওয়াজ হলো যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা জনগণের প্রত্যাশা-আশা-আকাক্সক্ষার কথা তুলে ধরেন জাতীয় সংসদে। বর্তমানে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কার্যত গৃহপালিত। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় তারা সংসদে শোপিস। সরকার খেলনা পুতুলের মতোই তাদের ব্যবহার করছে। সুবিধাবাদী মিডিয়াগুলো প্রকৃত চিত্র পৃঃ ৫ কঃ ৬
কে বেশি জনপ্রিয়?
আড়ালে-আবডালে রেখে খবর প্রচার করছে। এ সময় দেশের গণমাধ্যম জগতে স্যাটেলাইট চ্যানেলের ‘বিপ্লব’ ঘটায় টকশোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। কিন্তু সেখানে টকারুদের মধ্যে তাঁবেদার, চাটুকার, মোসাহেবি, তোষামোদী, একচোখা এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর বিচরণ বেড়ে যাওয়ায় মানুষ টিভির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আর গণমাধ্যম নামের পত্রপত্রিকার অধিকাংশই রূপান্তর ঘটেছে প্রচার মাধ্যম। মিডিয়াকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করায় সরকারের তাঁবেদারি করাই যেন হয়ে গেছে প্রচার মাধ্যমের কাজ। কিছু মিডিয়া চোখ-কান খোলা রেখে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করলেও তাদের মাথার ওপর রয়েছে ‘কালোমেঘে’র ছায়া। ফলে জনগণের অনেক দুঃখ-দুর্দশা, কিচ্ছা-কাহিনী রয়ে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে। অন্যদিকে বাঁধাধরা নিয়ম না থাকায় নিখাদ মত প্রকাশ ঘটছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অপ্রাসঙ্গিক দায়িত্বহীন কিছু মতামত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখা গেলেও আমজনতা যথার্থভাবেই সেখানে মত প্রকাশ করতে পারছে। ইদানীং যে কোনো ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কের ঝড় উঠছে। ইস্যুগুলোর সপক্ষে জনমত গঠিত হচ্ছে। গতকাল বুধবার দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকায় কর্মরত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার উপস্থিতির সময় একদল তরুণ-তরুণীর প্রতিবাদের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। ৪৫ সেকেন্ডের এ ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে ১৫ থেকে ২০ জন তরুণ-তরুণী হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বাগেরহাটের সুন্দরবনের পাশে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন। দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, ভারতকে খুশি রাখতেই সরকার ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে ‘ইন্ডিয়া বাংলাদেশ’ শীর্ষক আর্ট প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ভিডিওতে দেখা যায় শ্রিংলার গাড়িবহর চারুকলায় প্রবেশের মুহূর্তে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তরুণ-তরুণীরা সুন্দরবন এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন। ফেসবুকে এ দৃশ্য পোস্ট করায় এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মানুষ এ নিয়ে নানা মন্তব্য করেন, লাইক দেন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন হচ্ছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে সেখানে চলছে কারফিউ। এই এক মাসে সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নিহতের পাশাপাশি জনতা বনাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আন্দোলনকারী মুসলমানদের ওপর ভয়ঙ্কর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো (পত্রিকা-টিভি) গুরুত্ব না দিয়ে দায়সারাভাবে এসব খবর প্রকাশ করছে। ভাবখানা যেন ভারত অখুশি হবে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ ও টুইটারে এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তা-ব এবং কাশ্মীরিদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। প্রতিবাদী বক্তব্য কেউ শেয়ার করছেন, আবার কেউ লাইক দিচ্ছেন।
ইদানীং পত্রপত্রিকার তাঁবেদারি কৌশল এবং টিভির টকশোয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী টকারুদের তোষামোদীর কারণে গণমানুষের কাছে মিডিয়াগুলোর ভূমিকা কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ। সম্প্রতি কয়েকটি জেলায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বন্যায় দুর্গত মানুষের আহাজারি-চিৎকারের চিত্র যথাযথভাবে মিডিয়ায় আসেনি। যা এসেছে তা বিচ্ছিন্নভাবে। অথচ এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছিল সোচ্চার। বাস্তবতা হলো দেশ-বিদেশে ঘটে যাওয়া যেকোনো ইস্যুতে এখন সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তীব্র প্রতিবাদ হচ্ছে। তুরস্কের সাম্প্রতিক ঘটনা এবং সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে ফেসবুক-ব্লগ-টুইটার সরগরম। এমনকি গুশলানের জঙ্গি হামলা এবং কল্যাণপুরে জঙ্গি হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মেসবাড়িতে অভিযান চালান। তারা ঢাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে মেস করে থাকা ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া না দেয়া নিয়ে মালিকদের নিরুৎসাহী করায় বিপাকে পড়ে লাখ লাখ ব্যাচেলর। পরে যদিও পুলিশ দাবি করে তারা ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দেয়ায় নিরুৎসাহী করেননি, কিন্তু এর প্রতিবাদে গণমাধ্যম যত না আগ্রহ দেখিয়েছে তার শতগুণ আগ্রহ দেখিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র ইস্যুই দেখুন। সুন্দরবনকে রক্ষায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঠেকাতে জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নেয় সরকার। বাধ্য হয়ে আন্দোলনকারীরা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার শুরু করে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের বরাতে রাষ্ট্রের মালিকানা দাবি করে আন্দোলনকারীরা ফেসবুকে পোস্ট করেন ‘সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না’। তারা রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে নানা যুক্তি, নেতিবাচক দিক ও তথ্য-উপাত্ত ফেসবুকে হাজির করেন। অন্যদিকে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষের ব্যক্তিরা নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না; বরং দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প। চমৎকার বিতর্ক। সিলেট ও খুলনায় দুই শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা, কুমিল্লায় তনু হত্যা ইত্যাদি ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ফুঁসে উঠে সাধারণ মানুষ। প্রশ্ন হলো সোশ্যাল মিডিয়া কি ক্রমান্বয়ে বিকল্প গণমাধ্যম হয়ে উঠছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেসবুক-ব্লগ-টুইটার সামাজিক গণমাধ্যম নতুন মিডিয়া। গণমাধ্যম তথা পত্রিকা-রেডিও-টিভির মালিকপক্ষের নীতি, রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন এবং গ্রাহক-দর্শক-পাঠকদের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে অনেক বিষয় প্রচার করে না। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বাধ্যবাধকতা না থাকায় মানুষ সহজেই সে মত-তথ্য প্রচার করছে, যা মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য চ্যালেঞ্জ। মূলত নানা কারণে গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা থাকলেও ফেসবুক-ব্লগ-টুইটার তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখনো মুক্ত। ওই মাধ্যমগুলোর হাত বাঁধা নেই, তাদের চোখ খোলা। তারা যা দেখেন তা লেখেন। নিজেদের মতামত প্রকাশ করেন নিঃসংকোচে। সরকারের আজ্ঞাবহ মূলধারার মিডিয়া কোনো খবর চাপা দিতে চাইলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেগুলো প্রকাশ ঘটে। চাপের মুখে পড়ে সে সংবাদ প্রকাশে বাধ্য হয় গণমাধ্যম। যার জন্য গণমাধ্যমের মতোই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বর্তমানের এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হচ্ছে, কে বেশি জনগণের কাছাকাছিÑসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, না গণমাধ্যম?



 

Show all comments
  • মিজান ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১০:৩১ এএম says : 0
    অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
    Total Reply(0) Reply
  • মনজু ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:২৩ পিএম says : 0
    সাংবাদিকরা যে চুপ করে আছেন, এভাবে চলতে থাকলে গণমাধ্যম আর গণমাধ্যম থাকবে না হবে নিয়ন্ত্রিত তথ্যমাধ্যম।
    Total Reply(0) Reply
  • A.HANNAN ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:৩৪ পিএম says : 0
    মানুষ মিডিয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Tania ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১:০১ পিএম says : 0
    Sposto o saolil sikarukti
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কে বেশি জনপ্রিয়?

১৮ আগস্ট, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ