Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রথা ভেঙ্গে ও হুমকি মোকাবেলা করে চাকরি করতে চায় ভারতীয় নারীরা-২

প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

(গত সংখ্যার পর)
ইনকিলাব ডেস্ক : গীতার পরিকল্পনা লাগামছাড়া, আরো অবাস্তব। সে লেখাপড়া জানে না। অক্ষর চেনে না, সংখ্যাও নয়। তারপরও সে ভুলভাল অনবরত তার সেলফোন ব্যবহার করে। গ্রামের নারীরা যে সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছে গীতা সেখানে ঋণ সংগ্রহে অত্যন্ত যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। তার টাকার দরকার হলে সে তার মজুরির বিপরীতে অগ্রিম নেয়, আর এভাবে সে গ্রামের ঋণ কারবারিদের হতাশার কারণ হয়েছে।
গত বসন্তে গীতা তার নিজের জন্য দ্বিতীয় একটি বাড়ি করে সবার নজর কেড়েছে। গোলাপি, নতুন ইঁট দিয়ে তৈরি বাড়িটি গ্রামের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি রোশানের বাড়ির সীমানা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে।
পিপলি খেরার নাত সম্প্রদায়ের প্রধান হচ্ছে রোশান। সে একজন ভূত তাড়ানোর ওঝা। রীতিমত আসর বসিয়ে এ কাজ করে সে। সবার উদ্দেশ্যে লাজুক কন্ঠে একটি প্রশ্ন রাখে সেÑ আপনারা কি আসল নাটক দেখতে চান? অনুষ্ঠান শুরুর পর তার সারা শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়, চোখ উল্টে যায়, কালি মাতার মত মুখব্যাদান করে থাকে, সে কাঠের গুটির তৈরি জপমালা কানের কাছে এমনভাবে ধরে রাখে যেন সেলফোনে সে কালি মাতার সাথে কথা বলছে। হাসপাতালের উপর নাত সম্প্রদায়ের লোকজনের বিশ^াস নেই, বহুমাইল দূর থেকে তাদের প্রায় সবাই আসে তার কাছে আসে নানা সমস্যায় পড়ে। রোশান বলে, সে তাদের দেহে অধিষ্ঠিত জিনকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
রোশানকে জিজ্ঞেস করা হয়, তা রোগীদের মধ্যে কত জন বাঁচে। সে হেসে জবাব দেয়, আমি কিভাবে জানব? যদি আয়ু থাকে তাহলে তারা বাঁচে।
রোশানের এ এলাকাটি দিল্লী থেকে প্রায় ৪০ মাইল উত্তরপূর্বে, কাক ওড়ার দূরত্বেই বলা যায়, কিন্তু আধুনিক পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। একটি সাদা রঙের মন্দির ঘিরে কয়েকডজন বাড়িতে বাস করে গ্রামের লোকরা। মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ একটি ফলক থেকে জানা যায় যে রোশানের পরিবার এটি তৈরি করেছিল যদিও কাউকে এটা মনে করিয়ে দেয়া নিষ্প্রয়োজন। এ গ্রামের মাত্র দু’জন বয়স্ক মানুষ পড়তে জানে। কারো নামের সাথে কোনো পদবি নেই বা নারী-পুরুষ কেউ তাদের বয়স জানে না। একজনকে জিজ্ঞেস করা হয় তার বয়স কত বলে সে মনে করে। সে জবাব দেয়, আমার সব দাঁত পড়ে গেছে এবং মরার সময় হয়ে গেছে।
সম্প্রতি একদিন সকাল বেলা উষা নামের এক মহিলা, যার পা পোলিও আক্রান্ত, ৪ মাসের ছেলে শিশুকে কোলে নিয়ে বসেছিল। বমি ও ডায়রিয়ায় কাহিল হয়ে পড়েছিল শিশুটি। এত দুর্বল যে তার কান্নারও শক্তি ছিল না। আগে উষা তিন ছেলেকে হারিয়েছিল। আরো তিন ছেলে-মেয়ে বেঁচে আছে। তারা বসেছিল তার কাছেই। একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা শুকনো টোস্ট বিস্কুট খাচ্ছিল তারা। একজন এত ক্ষুধার্ত ছিল যে পড়ে থাকা একটি আধা পচা টমোটো হাতে নিয়ে খেতে থাকে। তাদের দুরবস্থা দেখে পাশ দিয়ে যেতে থাকা এক প্রতিবেশি জিজ্ঞেস করেÑ তোমরা এত নোংরা কেন? ঊষা কর্কশ স্বরে জবাব দেয়, আমরা দরিদ্র মানুষ। নোংরার মধ্যে আমাদের জন্ম, নোঙরার মধ্যে বাস করি, নোঙরার মধ্যেই মরব।
কয়েক দশক আগে একটি কাজের জন্য রোশান ভীষণ গর্ব অনুভব করে। এক পুলিশ অফিসার ঘুষের লোভে ভুল করে তাদের গ্রামে হাজির হয়েছিল। সে তার জ্ঞাতি ভাইয়ের ঘাড় চেপে ধরে নির্যাতন করতে থাকে। রোশান তখন ছিল এক তরুণ। একটি কুঠার তুলে এনে তার হাতল দিয়ে পুলিশের মুখে প্রচ- আঘাত করে সে। তারপর থেকে আর কোনো পুলিশ তাদের গ্রামে আসেনি বলে গর্বের সাথে বলে সে। একটি সীমারেখা চিহ্নিত করা আছে যা ভারত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
কিন্তু কারখানাগুলো স্থাপিত হওয়ার পর থেকে সে সীমারেখা বিলীন হতে শুরু করেছে। তার গ্রাম এখন সম্প্রসারণশীল শহর কর্তৃক গ্রাস হতে চলেছে। তার নিজের পরিবারের লোকদের কারখানায় কাজ করা সে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু সকাল বেলা গ্রামের মেয়েরা যখন কারখানাগুলোতে কাজ করতে যায় তখন বিতৃষ্ণার সাথে সে তা চেয়ে দেখে। সে বলে, ২০ বছর আগে জীবনযাত্রা অনেক সুন্দর ছিল। আমাদের ছিল একটি সুন্দর সমাজ। এখন মেয়েরা কাজ করতে বাইরে যাচ্ছে আর অচেনা লোকদের সাথে মিশছে।
গত বছর বসন্তে গীতা তার বাড়ি তৈরি করার পর রোশানের ছেলে ধরমেন্দর বিশেষ আগ্রহের সাথে তা লক্ষ্য করতে থাকে। সে দেখে যে গীতা ভালো কাপড় পড়ে, তা ইস্ত্রি করা থাকে। তার বন্ধুদের মুখে প্রসাধনের চিহ্ন। ধরমেন্দরের সন্দেহ তারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে কাজ করে। তার কথা, গীতারা অনৈতিক কাজ করে টাকা আয় করে। তাদের সবই আছে। পরনে কাপড়, প্রচুর খাবার আছে। তাদের কাজ করার কি দরকার? তাদের এখনো স্বামী আছে। এটা তাদের স্বামীদের জন্যই শুধু অপমান নয়, গোটা গ্রামের জন্যও অপমান।
গীতা প্রতিবেশি পিংকিকে নিয়ে গুজবটি কিভাবে ছড়িয়েছিল তা বলা কঠিন। তার চেহারা ভালো, কন্ঠস্বর সুরেলা। বিবাহিতা ও এক শিশুর মা। একটি নতুন নির্মাণ সাইটে সে হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙ্গার কাজ করে। কেউ একজন কথা ছড়ায় যে পিংকিকে এক অচেনা লোকের মোটরসাইকেলে চড়ে যেতে দেখা গেছে। আরেকজন বলে, নির্মাণ সাইটের এক ব্যক্তি তার বাড়িতে এসেছিল।
মে মাসে রোশান জানায় সে গোটা বিষয়টি কালি মাতাকে জানিয়েছে। মা তাকে উদ্বেগজনক খবর দিয়েছে যে গ্রামের মেয়েরা পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত। সে বলে, মা কালি যদি বলেন যে কেউ অপরাধ করছে তা হলে সে অপরাধী।
রোশান গ্রামে সব পুরুষদের ডাকে। মাথায় পাগড়ি পরে সে যা তার সম্প্রদায়ের প্রধানের পরিচয়বাহী। ঘন্টা খানেকেরও বেশি সময় ধরে করণীয় নিয়ে সভা চলে। রোশানের প্রশ্ন, মেয়েরা কারখানায় ঢোকার পর কি ঘটে।
তার ছোট ভাই বলে, মেয়েদের মধ্যে দাবানলের মত চাকরির প্রতি আকর্ষণ ছড়িয়ে পড়ছে যা গ্রামের জন্য অসম্মানজনক। তার এক জ্ঞাতি ভাই বলে, তার স্ত্রী একটি কারখানায় কাজ করে মাসে ৫ হাজার টাকা পায়। আর সে বিয়ের মওসুমে কাজ করে সারা বছরে পায় ১৮শ’ টাকা। কিন্তু পার্থক্য হল তার টাকা অল্প হলেও তা সম্মানের সাথে আয় করা।
সভায় সিদ্ধান্ত হয় : গ্রামের মেয়েদের কারখানায় কাজ করা বন্ধ করতে হবে।
খবর জানার পর গীতা তার বাড়িতে সভা ডাকে। মোট ৭ জন তারা যাদের মধ্যে ছিল প্রেমবতী, পিংকি ও রেখা। গীতা বলে, এ নিষেধ তারা মানবে না। কেউ যদি কাজ ছাড়ে তা করবে ভয়ে। তবে এক মাস বা দু’ মাস পর এ ভয় আর থাকবে না। সে জানায়, তাদের প্রতি ভারত সরকারের পূর্ণ সমর্থন আছে।
সরকার বলতে যার কথা গীতার মনে হয় তিনি হলেন মুসলিম রাজনীতিক জহিরুদ্দিন মেওয়াটি। কয়েক বছর আগে পিপলি খেরার গ্রাম প্রধান ছিলেন। শরতে তিনি আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তিনি যখন ব্যাপারটি শুনলেন, টেবিল চাপড়ে বললেনÑ আমি সব সময় সত্যের পক্ষে। আমি ভোটের চিন্তা করি না। আমি জনগণের সত্যিকার সেবক, আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
নারী-পুুরুষ মিলিয়ে নাত সম্প্রদায়ের মোট ভোটার সংখ্যা ১৫০ জন। এটা উড়িয়ে দেয়ার মত বিষয় নয় যেখানে ২০-৩০টি ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। গীতা যখন তার কাছে এল তখন তিনি একটি সুযোগ পাবার চিন্তা করলেন। দৃঢ়তার সাথে তিনি বললেন, কেউ তাদের কাজে যাওয়া আটকাতে পারবে না। আমাদের এখানে তালিবান নেই। এটি গণতান্ত্রিক দেশ।
গীতার গ্রামের মেয়েরা স্থির করে সকালে তারা আগের মতই কাজে যাবে। সকালে তারা যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় এল দেখল প্রতিবেশি পুরুষরা দাঁড়িয়ে আছে। তারা বলল, কাজে যাওয়া যাবে না। -সূত্র নিউইয়র্ক টাইমস। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রথা ভেঙ্গে ও হুমকি মোকাবেলা করে চাকরি করতে চায় ভারতীয় নারীরা-২
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ