Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ক্ষমা করো ঐরাবত

প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৪ পিএম, ১৬ আগস্ট, ২০১৬

স্টালিন সরকার : ঐরাবত! শিশুদের ‘আদর্শ লিপি’তে প্রথম শেখা-চেনা-জানা পশুর মধ্যে অন্যতম ঐরাবত (হাতি)। বইয়ে বিশালদেহী প্রাণী হাতির হাঁটার দৃশ্য। শিক্ষাজীবনের হাতেখড়িতে শিশু বুলি আওড়ায়- ‘ঐ’তে ঐরাবত; ঐরাবত ওই যাচ্ছে হেঁটে।’ হাতি চেনা হয় শিশুদের। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জে শত শত গ্রামের যে শিশুরা বানের পানিতে ভেসে আসা একটি হাতির ওপর দিনের পর দিন পৈশাচিক জুলুম দেখেন; দু’টি বন্য হাতিকে বৈদ্যুতিক তারের খুঁটিতে বেঁধে ফাঁদ পেতে নৃশংসভাবে ভিনদেশী হাতিকে ধরার চেষ্টা তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার দৃশ্য দেখেন; সে দৃশ্য দেখে ওই শিশুমনে রক্তক্ষরণের যন্ত্রণায় হয়তো ঠোঁটে বিড় বিড় করে আওড়ান ‘ঐ’তে ঐরাবত, ঐরাবতকে ফেলছি মেরে’। ক্ষমা করো ঐরাবত।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি ‘হার্ট এ্যাটাকে’ মারা গেছে ভারতের আসাম থেকে বানের পানিতে ভেসে আসা বন্যহাতি ‘বঙ্গ বাহাদুর’। সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগে হাতির মৃত্যুর অভিযোগ তুললে বন্য প্রাণী অধিদপ্তরের ভেটেরেনারি সার্জন ডা. মুস্তাফিজুর রহমানের দাবি, অতিরিক্ত গরম ও পানিশূন্যতার কারণে মারা গেছে হাতি। সরিষাবাড়ির কামরাবাদ ইউনিয়নের সোনাকান্দা গ্রামের যে ডোবায় হাতিটি পড়ে যায় সেখানে ছিল পানি কম। ১৫ আগষ্ট প্রচ- রোদে পানি গরম হয়ে যাওয়ায় হাতি হার্ট এ্যাটাক করে। তিনি বলেন, হাতিটাকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। হাতি উদ্ধারের ৬ দিন পরও কেন স্থানান্তর করা হল না এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের সাবেক বন সংরক্ষক কর্মকর্তা ড. তপন কুমার দে বলেন, যেখানে হাতিটি উদ্ধার করা হয়েছে সেখান থেকে পাকা রাস্তার দূরত্ব ২ কিলোমিটার। এই পথ পাড়ি দিয়ে হাতিকে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি।
ভিনদেশী একটি হাতির মৃত্যু হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল। আমাদের প্রশাসনের দক্ষতা, যোগ্যতা, নিষ্ঠাকে প্রশ্নের কলো প্রশ্নবিদ্ধ। বনের পশুর মৃত্যুতে চোখের পানি ফেলেছেন হাতি দর্শনে আসা হাজার হাজার মানুষ; আর দূর-দূরান্তের লাখ লাখ উৎসুক মানুষ শোকাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল টিভি পর্দার দিকে। বেদনাহত মানুষ। যেন আপনজন কেউ মারা গেছেন। ভারতের আসাম থেকে বানের পানিতে ভেসে আসা হাতিটিকে ভালবেসে নাম দেয়া হয় ‘বঙ্গ বাহাদুর’। বাহাদুরই বটে! দীর্ঘ দেড় মাস যেভাবে বানের পানিতে ভেসে ভেসে নিজের বাহাদুরির নজীর সৃষ্টি করেছে; তাতে সার্থক তার নামকরণ। দলছুট হয়ে পানিতে ভেসে আসা হাতির বাহাদুরির দৃশ্য পত্রিকা ও টিভি পর্দায় দেখে প্রাণীটির ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা দেড় মাস ধরে উৎসুক-উদ্বিগ্ন ছিলেন; তাদের আর বঙ্গ বাহাদুরকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফাঁদে ফেলে তাকে সাফারি পার্কে নিয়ে যাওয়ার কষ্টকর তোড়জোড়ের নেই প্রয়োজন। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র-যমুনার চরে সে আর মাটি কাঁপিয়ে ছুটবে না। প্রাণভয়ে দৌড়াবে না তার কা-কারাখানা দেখতে ভিড় করা ছেলে-বুড়োর দল। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেছে। হাতিটি এখন জামালপুরের সরিষাবাড়ীর মানুষের কাছে কেবলই স্মৃতি। তবে এই চিহ্ন বোধ হয় বেশ প্রগাঢ়। চাইলেই মুছে ফেলা যাবে না হাতিদর্শন স্মৃতি। নাহলে বানের পানিতে ভেসে আসা পরদেশী এই হাতির জন্য হাজার হাজার মানুষ চোখের পানি ফেলবে কেন? তুরস্ক থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইউরোপে যাওয়ার পথে সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা আয়লানের নিষ্পাপ মুখের দৃশ্য বিশ্ববিবেককে যেমন সজোরে নাড়া দেয়; ইউরোপীয়দের মানবতাবোধকে সজোরে আঘাত করে; সে রকমই বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি মানুষের বিবেককে নাড়া দেবে হাতি?
দলছুট হয়ে বানের পানিতে ভেসে আসা হাতিটি তো আর দুই বা চার দিন ধরে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার চরে ঘুরে বেড়ায়নি! ৪৭ দিন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ৪৮ দিনের মাথায় প্রাণ হারায়। বন্যায় ভারতের আসাম রাজ্য থেকে বানের পানিতে ভেসে হাতিটি গত ২৬ জুন বাংলাদেশে আসে। ব্রহ্মপুত্র নদ বেয়ে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্ত দিয়ে তার আসা। এরপর গাইবান্ধার ফুলছড়িতে দু’দিন থাকার পর বগুড়ার সারিয়াকান্দি হয়ে যমুনা নদীর পানিতে ভেসে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার মনসুর নগর ইউনিয়নের দুর্গম ছিন্নারচরে ১১ দিন অবস্থান। ২৭ জুলাই হাতিটি জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় যায়। সেই থেকে হাতিকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ঘোষণা দেয়া হয় হাতি উদ্ধারে ভারতের ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল আসবে। শুরু হলো অপেক্ষা! দুই দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে কয়েকদিন হাতিটি পানিতে ঘুরতে থাকে। ভারতের বিশেষজ্ঞরা ৪ আগষ্ট এলেন কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না। অন্ধের হাতি দেখার মতো বলে গেলেন এ হাতি তোমরা নাও। হাতি উদ্ধারে শুরু হয় লঙ্কাকা-। হাতিটিকে পর্যবেক্ষণ করেন বাংলাদেশ বন বিভাগের ৩টি ইউনিটের ১৭ সদস্য। তিনদফা চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করে উদ্ধার অভিযানে ব্যর্থ হন তারা। হাতি উদ্ধারে তিনটি পোষ্য হাতি নিয়ে যাওয়া হয়। দুইটি হাতি বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফাঁদ পেতে হাতি ধরার চেষ্টা চলে। ব্যর্থ হয় সব চেষ্টাই। মূলত, ‘মশা মারতে কামান দাগা’র মতোই একটি হাতি উদ্ধারে মহাযজ্ঞ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নিরীহ প্রাণী হাতিটিকে দেখতে আসে। ভিড় কমাতে প্রশাসন ‘হাতি দেখা নিষেধ’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বৃহস্পতিবার হাতিটি সরিষাবাড়ি উপজেলার কামরাবাদ ইউনিয়নের কয়ড়া গ্রামের ডাঙায় ছিল। দুপুর দুইটার দিকে তার শরীরে চেতনানাশক ছোড়া হয়। হাতিটি তখন দৌড়ে পাশের ডোবায় পড়ে যায়। অচেতন হয়ে পড়ায় প্রাণীটি তলিয়ে যেতে থাকে। উদ্ধারে এলাকাবাসী এগিয়ে আসেন। ব্যর্থ বন অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা এ সময় উল্টো স্থানীয় জনতার সহযোগী হন। ঢাকার বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল এবং বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট জানায়, হাতি উদ্ধারের অংশ হিসেবে বন অধিদপ্তর ঢাকার সাবেক উপপ্রধান বন সংরক্ষক তপন কুমার দে এবং ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোবিন্দ রায়ের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে যান। গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন আবু সাইদ বন্য হাতিটির শরীরে বন্দুকের মাধ্যমে চেতনানাশক ওষুধ দেন। ওই ওষুধ দেয়ার ২০ মিনিট পর হাতি ওই গ্রামের আবদুস সালামের বাড়ির পাশের ডোবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতঃপর ধীরে ধীরে পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে। এ সময় উদ্ধারকারী বিশেষজ্ঞ দল থেকে বলা হয় হাতিটি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে; তোমরা হাতিটাকে উদ্ধার করো। এলাকাবাসী হাতি উদ্ধারে কোমড় বেঁধে পড়েন। পানিতে ডুব দিয়ে তলিয়ে যাওয়া হাতির পায়ে রশি বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর এলাকায় দুই থেকে তিনশ’ লোক রশি টেনে পানি থেকে ডাঙায় তোলে মুমূর্ষু হাতি। পরে কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক থেকে আসা ভেটেরিনারি সার্জন মোস্তাফিজুর রহমান হাতির হুঁশ ফিরিয়ে আনার জন্য ওষুধ প্রয়োগ করেন। হাতির চার পায়ে শিকল বেঁধে এবং মোটা রশি দিয়ে আমগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। হাতিটি একটু একটু নড়াচড়া করতে থাকে। অতঃপর মারা যায় হাতি। হাতি মারা যাওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে কামরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুনসুর আলী খান বলেন, ১৯ দিন ধরে হাতিটি আমার ইউনিয়নে অবস্থান করে। সব ধরনের সহযোগিতা করেছি। মারা যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছি। মুকুল মিয়া বলেন, এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সেবা দিয়েও হাতিকে বাঁচাতে পারলাম না। আমাদের কাঁদিয়ে সে অজানার পথে পাড়ি দিল। হাজী মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ বলেন, বানের পানিতে আমার দুই বিঘা জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। তাতে কষ্ট নেই। কিন্তু হাতিটি মরে যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছি। খোদেজা বেগম বলেন, গ্রামবাসীর অনেকেই কেঁদেছে। পাঁচ দিন ধরে লোকজনের জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করেছি। কিন্তু হাতি মরে যাওয়ার কান্না চেপে রাখতে পারছি না। শুভা বেগম বলেন, হাতিটি কারও কোনো ক্ষতি করেনি। আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেল। হাতির মৃত্যুতে এলাকাবাসীর আফসোসের পাশাপাশি ক্ষোভও রয়েছে। একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং অতিরিক্ত ওষুধ দেয়ার কারণে হাতি মারা গেছে। তবে বন কর্মকর্তা তপন কুমার দে ও অসীম মল্লিকের দাবি চেতনা-নাশক ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে হাতির মৃত্যু হয়নি। প্রয়োজনের চেয়েও কম ডোজের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে তারা স্বীকার করেন হাতি উদ্ধারের ক্ষেত্রে বন বিভাগের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল; আন্তরিকতার কোন কমতি ছিল না। ওই দুই বন কর্মকর্তা জানান, হাতি শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। বাংলাদেশের ভূখ-ে ঢোকার পর বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয় চরে। হাতিরা সাধারণত তাদের পরিচিত পথ ধরেই চলাফেরা করে। বাংলাদেশের ভেতরে সে ছিল পানিতে। পথঘাট অচেনা। বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ না পাওয়ায় হাতি ছিল পরিশ্রান্ত ক্লান্ত। ভেসে আসার পর ৪৯ দিনে হাতিটি তার প্রয়োজনীয় খাবার পায়নি। আসামের জঙ্গলের হাতি যে ধরনের খাবার তথা গাছের পাতা, গুল্ম, ফল-পাকুড় ইত্যাদি খায়; সেগুলো বাংলাদেশে পায়নি। চরাঞ্চলে তাকে নির্ভর করতে হয় মূলত ঘাস এবং ধানী ফসলের ওপর। ফলে তার দেহে পুষ্টির অভাব এবং পানিশুন্যতা দেয়া দেয়। জনবসতির কাছাকাছি আসার পর থেকেই হাতিটি ছিল মানসিক চাপে। পুরোপুরিভাবে বুনো হওয়ায় মানুষের সঙ্গে তার কোন পরিচয় ছিল না। মানুষের প্রবল আগ্রহ ছিল হাতির জন্য ক্ষতিকর। সব সময় উত্তেজিত থাকতো। হাজার হাজার মানুষ তাকে সব সময় ঘিরে থাকতো। চারপাশে দিনের বেশিরভাগ সময় হৈচৈ চলতো। আসামের ভূমি উঁচু এবং শুকনো। যমুনা নদীর দু’পাশে জমি নিচু। কাদাময় পরিবেশে ৪৫ দিন কাটতে হয়। ফলে সে মারা যায়।
প্রবাদে রয়েছে ‘হাতি মরলেও লাখ টাকা বাঁচলেও লাখ টাকা’। প্রবাদের সেই হাতির খাবার আহামরি কিছু নয়। কলাগাছ, ঘাস, ফলপাকড়, লতাপাতাই খাদ্য। মাঝে মধ্যে লোকালায়ে মানুষের ফসল নষ্ট করলেও হাতির দাপটে বনজ সম্পদের লুটপাট হয় কম। মানুষকে বিনোদন দেয়া সার্কাসের অন্যতম পশু হাতি। ক্রীড়া-কৌতুকে হাতি নানা কারিশমা দেখায়। আদিকাল থেকে যে পশুপাখির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সখ্য; তার অন্যতম হলো হাতি। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে হাতি সবচেয়ে বড়। শরীর যেমন বিশাল শক্তিও অসীম। বুদ্ধিতে পাক্কা। তারপরও এই বিশাল প্রাণী হাতিকে মানুষ বশ করে নিজের কাজে লাগায়। এক সময় রাজা-বাদশাহদের বাহন বলতে ছিল হাতি আর ঘোড়া। ঢাল-তলোয়ার-বল্লমের যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো হাতি। দুর্গম পাহাড়ি পথে এখনো বাহন হিসেবে ও ভারী জিনিস স্থানান্তরে পোষা হাতির ব্যবহার হয়। পার্বত্য জেলায়ও গাছের বড় বড় গুঁড়ি হাতি দিয়ে টানা হয়। হাতির দাঁত সংগ্রহে তো অনেক কল্প-কাহিনী বিদ্যমান। হাতি দলবদ্ধভাবে বাস করে। প্রাণীটির মমত্ববোধ শিক্ষণীয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফী ও ডিসকোভারী চ্যানেলে দেখা যায়, একটি বাচ্চা হাতির কাদায় আটকে গেলে কেবল মা-ই নয়; পুরো হাতির পাল নেমে পড়ে। বাচ্চা আক্রান্ত হওয়ায় বাঘ-সিংহের সঙ্গে লড়াই করছে হাতি এ দৃশ্য দেখা যায়। পালের কোনো সদস্য বিপদে পড়লে অন্যরা জীবন বাজি রেখে সহযোগিতা করে। তাদের বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতাবোধ অনুকরণীয়। হাতির এই বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে; সিনেমা তৈরি হয়েছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’ গল্পের কথা মনে পড়ে? এই গল্পের নাম চরিত্রে রয়েছে একটি হস্তিনী। এক কর্মচারী জমিদারের বাড়ি দাওয়াত খেতে যেতে একটি হাতির জন্য আবেদন করেন। জমিদার তাতে আমল দেননি। এতে ওই কর্মচারী অপমানবোধ করেন। তিনি অল্প বয়সী এক হাতি কিনে সঙ্গীদের নিয়ে জমিদার বাড়িতে যান দাওয়াত খেতে। এই ‘আদরিণী’ এক সময় কর্মচারীর পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যান। এক সময় এই হাতি যাত্রী বহন করে তার পরিবারের আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাভাবে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে হাতিকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন মালিক। পরের ঘরে যাওয়ার আগেই আদরিণীর করুণ মৃত্যু ঘটে। হাতি নিয়ে অনেক সিনেমা রয়েছে। ’৭০ দশকে রাজেশ খান্না’র হিন্দি ছবি ‘হাতি মেরে সাথি’ ছবিতে হাতির নানা কর্মকা- দর্শকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। হাতির ক্যারিশমায় ছবিটি দর্শকপ্রিয়তা পায়।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পের ‘আদরিণী’র মতো ‘বঙ্গ বাহাদুর’ পোষ্য হাতি নয়। বানের পানিতে ভেসে আসা ৫টন ওজনের দলছুট বুনোহাতি। এই বানভাসি হাতিটিকে জামালপুরের সরিষাবাড়ীর মানুষ ভিনদেশি বলে গ্রহণ করেনি; বরং আপন করে নিয়েছে। শুধু জামালপুর কেন, গোটা বাংলাদেশের মানুষ যারা দেড়মাস টিভিতে সচিত্র খবর দেখেছে এবং পত্রিকায় পড়েছেন তারা সবাই আপন করে নিয়েছেন। প্রথমে দুই দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং প্রশাসনের অদূরর্শিতায় হাতিকে চর থেকে চরে ঘুরতে হয়েছে। উদ্ধারের সময় চেতনানাশক প্রয়োগের পর হাতিটি যখন ডোবায় পড়ে পানিতে ডুবে যাচ্ছিল; তখন গ্রামবাসী সবাই মিলে যেভাবে তাকে উদ্ধার করেছে তা নিখাদ ভালোবাসার উদাহরণ। হাতিটি মারা যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজনের অনেকেই চোখের পানি ফেলেছেন; আপনজন মারা গেলে যেমন হয়। টিভি পর্দায় দেখে এবং পত্রিকায় দুরবস্থার খবর পড়ে দূর-দূরান্ত থেকেও লাখ লাখ মানুষ জানিয়েছেন নীরব সহানুভূতি। বাস্তবতা হলো উদ্ধারকারীদের কাজে অবহেলা ও অদক্ষতার ছাপ ছিল। হাতি উদ্ধারের পুরো প্রক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে এ ধরনের বন্য প্রাণীকে বাগে আনা বা তাকে বাঁচানোর মতো দক্ষতা আমাদের নেই। হাতির এই করুণ পরিণতি হয়তো তুরস্কের আয়লানের মতো মর্মস্পর্শী নয়; কিন্তু বিবেককে কম দংশন করছে না। দেড় মাসেও একটি হাতিকে বাঁচাতে যে প্রশাসনের কর্তারা ব্যর্থ হন; আন্তরিকতার অভাব দেখান; তারা অন্য কাজে কেমন সফলতা দেখাতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। পরদেশী একটি হাতির করুণ মৃত্যু গোটা জাতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিলো।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • জুয়েল ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ১১:৩৭ এএম says : 0
    তবে এই হাতির ক্ষেত্রে আন্তরিকতার কোন ঘাটতি ছিলো না এটা ১০০%
    Total Reply(0) Reply
  • সাব্বির ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ৩:৩০ পিএম says : 0
    মরে গেলো বঙ্গ বাহাদুর, আমরা হলা দোষী
    Total Reply(0) Reply
  • Ashique ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ৪:২২ পিএম says : 0
    we are shamed
    Total Reply(0) Reply
  • Mahmodul hasan Rimin ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ৮:১৭ পিএম says : 0
    খুবই দুংখজনক একটি ঘটনা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্ষমা করো ঐরাবত

১৭ আগস্ট, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ