Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

অবশেষে ‘বঙ্গবাহাদুর’-এর মৃত্যু

প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালপুর জেলা সংবাদদাতা : বঙ্গবাহাদুর নামের সেই হাতিটি অবশেষে গতকাল মঙ্গলবার সকালে উদ্ধারকারী দলের হাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। উদ্ধারকারীদের চেতনানাশক ওষুধে দ্বিতীয় দফায় অচেতন হয়ে সকাল সাড়ে ৬টায় সরিষাবাড়ী উপজেলার সোনাকান্দর গ্রামের ফসলি জমির মাঠে হাতিটি মারা গেছে। এদিকে উদ্ধারকারীদের হাতে হাতিটি মারা যাওয়ায় স্থানীয় দর্শনার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উদ্ধারকারীদের শাস্তির দাবিতে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছে। অপরদিকে হাতিটি মারা যাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ দর্শনার্থীদের রোষানল থেকে মুক্তি পেতে উদ্ধারকারীদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসিম মল্লিক ও স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে কক্সবাজার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি মেডিকেল টিম মৃত হাতিটির সুরতহাল রিপোর্ট ও প্রাথমিক ময়নাতদন্ত শেষে এলাকাবাসীর সহায়তায় হাতিটিকে ঘটনাস্থলেই সমাহিত করেন।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, ভারতের আসাম রাজ্যের শিশুমারা পাহাড়ী এলাকা থেকে গত ২৮ জুন দলছুট হয়ে বুনো হাতিটি ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীপথে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তের আন্তর্জাতিক মেইন পিলার নম্বর ১০৫২-এর কাছ দিয়ে বন্যার পানিতে বাংলাদেশে ভেসে আসে। এরপর হাতিটি বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা তীরবর্তী বিভিন্ন চরে দাপিয়ে বেড়ায়। ওই হাতিটি সিরাজগঞ্জের ছিন্নারচরে অবস্থানকালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা অঞ্চল ঢাকার বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিকের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি হাতি উদ্ধারকারী দল গত ২০ জুলাই ছিন্নারচরে আসে। ওই উদ্ধার কমিটিতে দুজন ভেটেরিনারি সার্জন ও একজন মাহুত ছিলেন। তারা একাধারে ৭ দিন ছিন্নারচরে অবস্থান করে স্থানীয় পরিবেশ পরিস্থিতি এবং হাতিটির গতিবিধি ও স্বভাব-চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে ঢাকায় ফিরে যান। এরপর বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিকের নেতৃত্বে প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ঢাকা অঞ্চলের ১৭ সদস্যের একটি উদ্ধার দল সরিষাবাড়ীতে এসে হাতিটিকে উদ্ধার করতে গত ৩০ জুলাই আবারও মাঠে নামেন। সেদিন থেকেই শুরু হয় দ্বিতীয় দফার উদ্ধার তৎপড়তা। এদিকে বুনো হাতিটি উদ্ধারের জন্য গত ৩ আগস্ট বুধবার বিকালে বাংলাদেশে আসেন ভারতের তিনজন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ। ভারতীয় ওই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ রিতেশ ভট্টাচার্য, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ডা. কুশল কুমার শর্মা ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ এ এস তালুকদার। তারা বাংলাদেশে এসেই ঢাকা বনভবনে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের সাথে হাতিটি উদ্ধারের ব্যাপারে মতবিনিময় সভা করেন। ওই সভায় বাংলাদেশের ডিসিএফ শাহাবুদ্দিন আহাম্মেদ ও সাবেক উপ-প্রধান বন সংরক্ষক ডা. তপন কুমার দে উপস্থিত ছিলেন। এরপর ৫ আগস্ট শুক্রবার সকালে জামালপুর সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসক ও ভারতীয় প্রতিনিধি দল সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে বন্যার পানিতে ভেসে বেড়ানো হাতিটি বর্তমানে অত্যন্ত দুর্বল হয়েছে। হাতিটি উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ১৫ দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ওই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন আসামের হাতি বিশেষজ্ঞ ও বন কর্মকর্তা রিতেশ ভট্টাচার্য, হাতি বিশেষজ্ঞ কুশল কুমার শর্মা, বাংলাদেশের সাবেক বন কর্মকর্তা ড. তপন কুমার দে প্রমুখ। এরপর বাংলাদেশ ও ভারতীয় উদ্ধার দল যৌথভাবে হাতিটি উদ্ধারের জন্য সরিষাবাড়ীর ইজারাপাড়া এবং ভাটিয়ানী এলাকায় পরপর দুই দিন চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ভারতীয় দল হাতি উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে নিজ দেশে ফিরে যায়। তবে ভারতে ফিরে যাওয়ার সময় আসামের হাতি বিশেষজ্ঞ ও বন কর্মকর্তা রিতেশ ভট্টাচার্য এ প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশী উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের জানান, হাতিটি বন্যার পানি থেকে শুকনো জায়গায় না ওঠা পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব নয়। হাতিটিকে ট্যাংকুলাইজিং গান নামে বন্য প্রাণী অচেতন যন্ত্র দিয়ে অজ্ঞান করে ট্রাকে উঠিয়ে নিতে হবে। হাতিটি অজ্ঞানের সময় শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। ওই সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য ¯িপ্রট ব্যবহার করতে হবে। আর হাতিটিকে উদ্ধারের জন্য এক দিনে একবারের বেশি ট্যাংকুলাইজ করা যাবে না।
সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভারতের আসাম রাজ্য থেকে বুনো হাতিটি বানের পানিতে ভেসে আসার ৫১ দিনের মাথায় সরিষাবাড়ী উপজেলার সোনাকান্দর গ্রামে ফসলি জমির মাঠে মারা গেছে। হাতিটি মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে গত ১১ আগস্ট বাংলাদেশের উদ্ধারকর্মীরা ট্যাংকুলাইজার গান দিয়ে মেটাল ডার্টে শুট করে জাইলাজিন ও কেটামিন নামক চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করে। ওইদিন ঢাকা অঞ্চলের সাবেক বনকর্মকর্তা ড. তপন কুমার দে এবং ময়মনসিংহ বিভাগীয় বনকর্মকর্তা গোবিন্দ রায়ের নির্দেশে কক্সবাজার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন দক্ষ শুটার ডা. মোস্তাফিজুর রহমান খুব কাছ থেকে টাংকুলাইজার গান দিয়ে একবার মেটাল ডার্টের শুট করে হাতির শরীরে অচেতন করার ওষুধ পুশ করেন। ওই সময় টাংকুলাইজার গানের আঘাতে হাতিটি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে হাতিটি ধানাটা গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরে সরিষাবাড়ী উপজেলার কামরাবাদ ইউনিয়নের কয়রা গ্রামের মনু ম-লের বাড়ির পাশে কচুরিপানাযুক্ত গভীর পানিতে গিয়ে অচেতন হতে থাকে। ওই সময় উদ্ধারকারীরা-সহ শত শত দর্শনার্থীরা মনু ম-লের বাড়ির পাশে কচুরিপানার ধারে গিয়ে দেখেন হাতিটি ধীরে ধীরে গভীর পানিতে ডুবে যাচ্ছে। তখন অচেতন হাতিটিকে উদ্ধারের জন্য ঢাকা অঞ্চলের সাবেক উপ-প্রধান বনকর্মকর্তা ড. তপন কুমার দে পানিতে নেমে সকলের সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। এ সময় শতশত দর্শনার্থী পানিতে নেমে মোটা নাইলনের রশি দিয়ে হাতিটির পা, গলা ও শুঁড় বেঁধে টেনে প্রায় একশ মিটার দূরে ডাঙ্গায় তোলেন। পরে উদ্ধারকারীরা হাতিটির পিছনের দুই পা বেঁধে ফেলেন এবং হাতিটিকে দুটি বৃহৎ আমগাছের সাথে আটকে রাখেন। এর ১০ ঘণ্টা পর হাতিটি চেতনা ফিরে পেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়েই ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এ ঘটনার তিন দিন পর গত ১৪ আগস্ট হাতিটি পায়ের রশি ছিঁড়ে দৌড়ে পাশর্^বর্তী সোনাকান্দর গ্রামের ফসলি জমির মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওই সময় ঢাকা অঞ্চলের সাবেক উপ-প্রধান বনকর্মকর্তা ড. তপন কুমার দে’র উপস্থিতিতে তার নির্দেশে ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান খুব কাছ থেকে টাংকুলাইজার গান দিয়ে মেটাল ডার্টের মাধ্যমে পরপর চারটি শুট করে একইভাবে চারবার চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগে দ্বিতীয় দফায় হাতিটিকে অচেতন করে। এরপর হাতিটি আর চেতনা ফিরে দাঁড়াতে পারেনি। একপর্যায়ে হাতিটি কাদা মাটিতে পড়ে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে অবশেষে ১৬ আগস্ট মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
সরিষাবাড়ীর সোনাকান্দর গ্রামে মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে আরও দেখা গেছে, মৃত হাতির পাশে উৎসুক দর্শনার্থীর ভিড় পড়েছে। ওই সময় উদ্ধারকারীদের কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে উপস্থিত সকলের চোখে-মুখে বিষণœতার ছাপ লক্ষ করা গেছে। ওইসব দর্শনার্থীর মধ্য থেকে কয়রা গ্রামের মিনহাজ উদ্দিন উত্তেজিত কণ্ঠে এ প্রতিনিধিকে জানান, উদ্ধারকারীরা হাতিটির শরীরে গত রোববার দুপুরে পরপর চারবার শুট করে অতিমাত্রায় চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগে অচেতন করেছে। এরপর হাতিটির চারটি পা শিকল ও রশি দিয়ে বেঁধে খুঁটির সাথে আটকে রাখে। এ ঘটনার পর হাতিটি আর চেতনা ফিরে উঠে দাঁড়াতে পারেনি এবং কোনো খাবার গ্রহণ করেনি। তাই উদ্ধারকারী দলের অদক্ষতা ও গাফিলতির কারণেই হাতিটি মারা গেছে। একই সময় বুনো হাতিটি উদ্ধারের নামে হত্যার অভিযোগে সরিষাবাড়ীর শিমলা বাজার গ্রামের মাহাবুব আলম, সোনাকান্দর গ্রামের মো. সেলিম, একই গ্রামের নুর মাহমুদ, শহীদ, শ্যামগঞ্জের রবিউল ইসলাম ও আদ্রা গ্রামের জাহিদুল ইসলামসহ স্থানীয় দুই শতাধিক দর্শনার্থী মৃত হাতিটির কাছে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। ওই সময় বিক্ষুব্ধরা উদ্ধারের নামে হাতিটিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ করেন এবং তারা বুনো হাতিটিকে নির্মমভাবে হত্যা করার অপরাধে উদ্ধারকারী দলের সকলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অবশেষে ‘বঙ্গবাহাদুর’-এর মৃত্যু
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ