দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে জাতিসত্তা ও সভ্যতার অবকাঠামো। জাতীয় চরিত্র গঠন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী সৎ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে শিক্ষার মাধ্যমে। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অবাধ ভোগবাদী সিলেবাস চালু আছে, যা আলোকিত লোক তৈরীতে সম্পূর্ণ অক্ষম। বর্তমানে লক্ষ্য করা যায়, দুর্নীতিবাজদের একটা বিরাট অংশ বর্তমান প্রচলিত শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত। যারা কলমের খোঁচায় ও ফাইল আটকিয়ে রেখে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, অথচ এ শিক্ষাকেই বলা হয় ‘শিক্ষাই আলো’। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এ সমস্ত উচ্চশিক্ষিত লোক কেন আজ অন্ধকার জগতের বাসিন্দা? প্রকৃতপক্ষে উচ্চশিক্ষিত হওয়া আর সৎ লোক হওয়া এক কথা নয়। সৎ ও আধুনিক যোগ্য লোক গঠনের জন্য অবশ্যই আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত হিসাবে গড়ে তোলার পাশাপাশি অপরাধের প্রতি ঘৃণা এবং অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার মনোভাব সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন, তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাষ্ট্রকেই পালন করতে হবে।
আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ গড়ার কারিগর মুহাম্মদ স. দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত একটি সমাজকে উদ্ধারের নিমিত্তে কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তা লক্ষণীয়। সে শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাস ছিল -আল-কুরআন ও আল-হাদীস। এ শিক্ষা গ্রহণ করে গড়ে উঠেছিলেন আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী রা.-এর মত মানবেতিহাস খ্যাত শাসক ও মনীষী। এ ব্যবস্থা আত্মস্থ করে এমন একদল মানুষ তৈরি হলেন যে, যারা অপরাধের পর বিবেকের কশাঘাতে টিকতে না পেরে নিজেদের অপরাধের বিচার প্রার্থনার জন্য রসূলের বিচারালয়ে হাজির হতেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অভুক্তকে নিজের খাদ্য বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠলো। এতে এমন এক দল চরিত্রবান নেতৃত্ব গড়ে ওঠলো, যারা এক সময় মানুষের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রæর জন্য হুমকি ছিল, পরবর্তীতে তাদের পরিচালিত রাষ্ট্রে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রাতে-দিনে সুন্দরী, মূল্যবান সব অলঙ্কার পরিহিতা মহিলা একাকি পথ চলেছে কিন্তু কেউ তাকে জিজ্ঞাসাও করেনি, কেউ তার দিকে চোখ তুলে দৃষ্টিপাতও করেনি। প্রত্যেকটি মানুষ পরস্পরের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রæর বিশ্বস্ত আমানতদার বনে গেল। আল-কুরআন এমন সোনার মানুষ তৈরি করল যে, অর্ধেকটা পৃথিবীর বাদশাহী হাতের মুঠোয় পেয়েও দায়িত্বের ভার তাকে এমনভাবে তাড়া করে ফিরতো যে, আরামের ঘুম দূরে ঠেলে দিয়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়লো অভুক্ত মানুষের সন্ধানে। কোথাও কি অসহায় মানবতা জুলুমের শিকার হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করছে? কেউ কি তাঁর শাসন কাজে অসন্তুষ্ট? এ সমস্ত প্রশ্ন তাকে সদা অস্থির করে তুললো। প্রয়োজন পূরণে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দু’টি কাপড় নয় বরং অন্যান্য নাগরিকদের ন্যায় একটিই গ্রহণ করলো। কিন্তু এক টুকরা কাপড় দিয়ে তার জামা হওয়ার কথা নয়; ছেলের ভাগের কাপড় দিয়ে নিজের জামা তৈরি করে নিল।
সুতরাং দুর্নীতির সব ব্যবস্থা উন্মুক্ত রেখে দুর্নীতি দমন অসম্ভব। এ জন্য রসূলের স. পন্থায় আলোকিত মানুষ তৈরির জন্য আমাদের সেই কুরআন-যা আজো অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেটিকে আমাদের সকল কাজে মূলনীতি রূপে গ্রহণ করতে হবে।
রসূলুল্লাহ স. বিদায় হজ্জ অনুষ্ঠানে অমূল্য বাণী শুনিয়েছিলেন যে, ‘‘তোমরা সবাই একে অপরের ভাই এবং একজন অনারবও আরববাসী থেকে অধিক মর্যাদাশীল নয়।’’ এভাবে হজ্জ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে এবং সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়নীতির ভাবধারা চালু হয়। ইসলামের এই রুলসগুলো আইনের আওতায় এনে বাস্তবায়ন করা হলে সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতি থাকবে না। যেই মহান রব মানুষকে সৃষ্টি করে মানুষেরই চির শত্রæ শয়তানের অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিলেন, শয়তানের সাথে যুদ্ধ করে নৈতিকতার সাথে টিকে থাকার জন্য সেই মহান রব উল্লেখিত বিধানগুলো আমাদের দিয়েছেন। এছাড়াও আল-কুরআন ও আল-হাদীস ক্রমাগতভাবে একটি সুন্দর সমাজ তথা রাষ্ট্র কায়েম করার উপড় অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। এমন কি মানুষের কষ্ট হয় এমন একটি ছোট ব্যাপারও ইসলাম বাদ দেয়নি। আবু মূসা রা. বলেন, ‘‘সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! কোন মুসলিমের ইসলাম সবচেয়ে ভাল? তিনি বলেন, ঐ মুসলিমের ইসলাম সবচেয়ে ভাল যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে।’’ ইসলাম এক সর্বজনীন ও কল্যাণকামী জীবনব্যবস্থা।
আজ থেকে পরেনো শত বৎসর আগে রসূলুল্লাহ স. এর হাতে গড়া রাষ্ট্রটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায়, তিনি আল্লাহর দেয়া ঐ কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে এমন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যে সমাজের অধিবাসীরা কতটুকু আল্লাহর ভয় পোষণ করার ফলে সাধারণ কোন অপরাধ করার পর পরই বিবেকের ক্রমাগত কশাঘাতে টিকতে না পেরে সাথে সাথে রসুলুল্লাহ স.-এর বিচারালয়ে নিজের দুর্নীতির বিচার প্রার্থনা করতেন। আর এ ধরনের তাকওয়া ভিত্তিক রাষ্ট্রের উন্নয়নকল্পে আল্লাহ আসমান ও জমিনের দুয়ারসমূহ খুলে দেন। আল্লাহ বলেন, “লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ঈমান আনতো ও তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করতো তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। সুতরাং তাদের কর্মকান্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।” “আল-কুরআন, ৭ : ৯৬”
এ ধরনের তাকওয়া সম্পন্ন জনগোষ্ঠি নিয়ে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠবে, সেটিই হবে আল-কুরআনের সমাজ, ইসলামী সমাজ ও আল্লাহর পছন্দের সমাজ। এ সমাজের প্রতিটি লোক ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হবেন। দুর্নীতির মূলোচ্ছেদে পৃথিবীর কোন জীবন ব্যবস্থাই সম্পূর্ণরূপে সফল হতে পারে নি; যেমন পেরেছে ইসলাম। তাই ইসলামের ঈড়ফব ড়ভ বঃযরপং গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের অর্থনীতির জন্য, রাজনীতির জন্য, ব্যবসার জন্য, জীবনের সর্বক্ষেত্রের জন্যই রয়েছে ঈড়ফব ড়ভ বঃযরপং. বিশেষ করে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায়, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে। মানুষের মজ্জাগত অভ্যাসকে পরিবর্তন করার জন্য ইসলামের শাশ্বত বিধান ও পদ্ধতির অনুসরণ একান্ত প্রয়োজন। দুর্নীতি একটি মজ্জাগত পদ্ধতি। দুর্নীতির মধ্যে ব্যক্তি স্বার্থ নিহিত রয়েছে। কিন্তু খারাপ দিকটি ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে বেশী। সুতরাং দুর্নীতি সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। এ জন্য ব্যাপক প্রচার ব্যাপক প্রপাগান্ডা চালাতে হবে।
আল্লাহ মদ সম্পর্কে তাঁর চূড়ান্ত মতামত জানালেন, “হে মুমিনগণ! মদ শয়তানী কাজ। সুতরাং তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” “আল-কুরআন, ৫ : ৯০” একইভাবে দুর্নীতি একটি শয়তানী কাজ। সুতরাং তা বর্জনীয়। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাংক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়।” “আল-কুরআন, ২৪ : ২১” আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য যে, দুর্নীতি মন্দ কাজের অন্যতম।
আল্লাহ বলেছেন, “যে সব লোক আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের শান্তি হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করতে হবে কিংবা শূলিবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদের নির্বাসিত করা হবে।” “আল-কুরআন, ৫:৩৩”। সাধারণ আইনে অপরাধ সংক্রান্ত সকল শাস্তিকেই ‘দন্ডবিধি’ নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ইসলামের শাস্তি আইনগুলো একটু কঠিন মনে হলেও প্রতিটি শাস্তির আলাদা আলাদা বিধান রয়েছে।
‘অপরাধ’ বলতে শরীয়তের এমন আদেশ ও নিষেধ বুঝায় যা লঙ্ঘন করলে হদ্দ বা তা’যীর প্রযোজ্য হয়। দুর্নীতি একটি অপরাধ, যে সম্পর্কে আল্লাহ হদ্দ (বিধিবদ্ধ শাস্তি) অথবা তা’যীর (দন্ডবিধি) দ্বারা হুমকি প্রদান করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তির ওয়াদা করা হয়েছে। শাস্তির মাত্রার দিক থেকে অপরাধ তিন প্রকার: যেসব অপরাধের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে শাস্তি নির্ধারিত। যেমন: যিনা (ব্যভিচার), যিনা এর মিথ্যা অপবাদ (কায্ফ), চুরি (সারাকা), ডাকাতি (কাতউত তারীক), মাদক গ্রহণ (শুরবুল খাম্র) এবং ইসলাম ধর্ম ত্যাগ (ইরতিদাদ); যেসব অপরাধের জন্য কিসাস (মৃত্যুদন্ড বা অঙ্গহানী) অথবা দিয়াত (রক্তপণ) নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন: ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হত্যা এর অন্তর্ভূক্ত এবং আল্লাহ বা মানুষের অধিকার সংশ্লিষ্ট যে সব অপরাধের জন্য শরীয়ত নির্দিষ্ট কোন শাস্তি কিংবা কাফ্ফারা নির্ধারণ করে দেয়নি সে সব অপরাধের শাস্তিকে তা’যীর (অনির্ধারিত শাস্তি) বলে।
তা’যীর পর্যায়ের অপরাধগুলোর মধ্যে দুর্নীতিসমূহ অন্যতম। এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে, অন্যায় অপকর্ম থেকে অপরাধীকে বিরত রাখা। মানুষের মৌলিক বিষয়সমূহের সংরক্ষণ; সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন এবং অপরাধীকে পবিত্রকরণ। হুদুদ ও কিসাস জাতীয় কয়েকটি অপরাধ ছাড়া অবশিষ্ট সব অপরাধই তা’যীরী অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু দুর্নীতি তা’যীরের পর্যায়ের একটি অপরাধ সেহেতু এর শাস্তিও তা’যীরের অনুরূপ। তা’যীরা শাস্তি হচ্ছে: অপরাধের ভিন্নতার কারণে শাস্তির ভিন্নতা হবে। ইসলামী ফৌজদারী আইনের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তা’যীরের আওতায় কাউকে হত্যা করা সমীচীন নয়। আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা এমন কাউকে বিনা অধিকারে হত্যা করো না, যার হত্যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন”। “আল-কুরআন, ৬ : ১৫১” ইমাম ইবনু তাইমিয়া র. বলেন, “বিপর্যয় সৃষ্টিকারী আক্রমণকারীর মতই। যদি আক্রমণকারী হত্যা ছাড়া অবদমিত না হয়, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে”। বেত্রাঘাত করা, বন্দী করা, নির্বাসন বা দেশ থেকে বহিষ্কার, শূলে চড়ানো, উপদেশ বা তিরষ্কার কিংবা ধমকদান, অপমান করা, বয়কট, আদালতে তলব, চাকুরীচ্যুতকরণ, সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়া, কাজ কারবারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, উপায় উপকরণ ও সম্পদ নষ্ট করা, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং আর্থিক দন্ড আরোপ করা। (চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।