Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শাস্তির আরেক নাম ‘পা-ধোয়া পানি’

প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) উপজেলা সংবাদদাতা : “শিশুরা পড়াশোনায় অমনোযোগী হলে অনেক ক্ষেত্রেই কড়া মেজাজের মা তার সন্তানকে ‘অমুকের ছেলে তমুকের’ পা-ধোয়া পানি পান করার কথা বলে তিরস্কার করে থাকেন।” যদিও কখনো কোনো শিশু কারো পা-ধোয়া পানি পান করেছে বলে শোনা যায়নি।
তবে সত্যি সত্যিই চাঞ্চল্যকর অমানবিক ব্যতিক্রমী এ শাস্তির ঘটনা ঘটেছে রাজবাড়ী জেলা সদরের বাণিবহ ইউনিয়নের লক্ষিনারায়ণপুর গ্রামের জনৈক আলমের বাড়িতে ভাড়া থাকা এনজিও ব্র্যাকের শিশু নিকেতন স্কুলে। ওই স্কুলে আগত ব্র্যাকের শিশু নিকেতন স্কুলের কর্মসূচি সংগঠক তাহমিনা খাতুন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়–য়া ২০ জন শিক্ষার্থীকে একই ক্লাসের সাতজন শিক্ষার্থীর পা-ধোয়া পানি পান করিয়েছেন। যে পানি আনা হয়েছিল ‘টয়লেটে ব্যবহার করা পাত্রে (বদনা) এবং পাট জাগ দেয়া নোংরা পুকুর থেকে।’ আর যারা ওই পানি পান করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে তাদেরকে তিনি পিটিয়েছের মনমতো।
এদিকে ওই ঘটনা ঘটানোর দায়ে গত রোববার ব্র্যাকের পক্ষ থেকে কর্মসূচি সংগঠক তাহমিনা খাতুনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেইসাথে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে তাহমিনা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বর্তমান যুগ এমন বর্বর শাস্তির ঘটনা ‘কেন ঘটেছে তা জানতে চেয়ে’ জেলা ব্র্যাক প্রতিনিধি নেফাজ উদ্দিনকে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শনোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে অমানবিক ওই ঘটনার পর গত শনিবার সকালে বিদ্যালয়ের সকল অভিভাবক সমবেত হয়ে ব্র্যাকের শিশু নিকেতন স্কুলের কর্মসূচি সংগঠক তাহমিনা খাতুনের বিচার দাবি করেন। যে কারণে ওই বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতির নেতৃত্বে গ্রাম্য সালিশেরও আয়োজন করা হয়। তবে জনরোষের ভায়ে ঘটনাস্থলে যথা সময়ে যাননি ওই সংগঠক।
ছলছল চোখে ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর সাকিব মিয়া বলে, তাদের ক্লাসে ৩২ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। স্কুল থেকে এসব শিক্ষার্থীকে আগেই বলা হয়েছিল গত বুধবার অভিভাবকদের সাথে করে স্কুলে আনতে হবে। যদিও সেদিন বাবা বাড়িতে না থাকায় এবং মায়ের সাংসারিক কাজ থাকায় তারা তার সাথে আসেননি। তার মতো ২০ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবক সেদিন উপস্থিত হননি। কয়েকজন ছিলেন অনুপস্থিত। মাত্র সাতজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক সেদিন স্কুলে আসেন। ওইদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত চলে তাদের ক্লাস। এরই মাঝে সেখানে আসেন ব্র্যাকের শিশু নিকেতন স্কুলের কর্মসূচি সংগঠক তাহমিনা খাতুন। তিনি বেশির ভাগ অভিভাবক না আসায় প্রচ-ভাবে ক্ষেপে যান। একপর্যায়ে আগত অভিভাবকদের চলে যেতে বলেন এবং বাঁশের লাঠি উঁচিয়ে আমেনা নামে এক ছাত্রীকে বাথরুম থেকে পাত্র (বদনা) নিয়ে পাশে থাকা পুকুর থেকে পাত্রটি ভরে আনার নির্দেশ করেন। আমেনা পানি আনতে না চাইলে তাকে লাঠিপেটা করার ভয় দেখান। যে কারণে সে ওই পুকুর থেকে পানি আনে। যদিও সেই পুকুরের পানি ছিল পাট জাগ দেয়া অপরিষ্কার। যার কিছু দূরেই রয়েছে খোলা বাথরাম। নোংরা অমন পানি আনার পর অভিভাবকসহ আগত শিশুদের ওই পাত্রের পানিতে পা ধুতে বলেন। তারা পা ধোয়ার পর ওই পানি হয়ে যায় আরো বেশি নোংরা। অথচ ওই নোংরা পানিই অভিভাবক নিয়ে না আসা ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে তুলে দেয়া হয়। যারা খেতে অস্বীকার করেছে তাদের পেটানো হয় লাঠি দিয়ে। আর যারা ওই পানি পিটুনির ভয় উপেক্ষা করে খেয়েছে, তাদের বেশির ভাগই করেছে বমি, হয়েছে তাদের পেটের পীড়া।
একই শ্রেণীর ছাত্রী খাদিজা খাতুন বলে, সে ওই পানি না খাওয়ায় তাকে তাহমিনা ম্যাডাম বেধড়ক লাঠিপেটা করেছেন। এতে তার হাতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। ব্যথার কারণে সে জ্বরেও ভোগে। পরে তাকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়।
খাদিজার মা নুরজাহান বেগম বলেন, এটা কোনো মানুষের কাজ নয়। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেছি পড়াশোনা শেখার জন্য, নেংরা পানি পান করতে আর মার খাওয়ার জন্য নয়। এমন কর্মকর্তা আমরা চাই না।
একই ক্লাসের অপর ছাত্র রবিউল সেখও জানায়, ওই নোংরা পানি পান না করায় তাহমিনা ম্যাডাম তাকেও পিটিয়েছে।
ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক পারুল আক্তার বলেন, এ বিদ্যালয়ে সকালে তৃতীয় এবং বিকালে প্রথম শ্রেণীর ক্লাস হয়ে থাকে। শিক্ষক রয়েছেন মাত্র দুজন। এখানে দুই শিফটে ৬৪ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। সকালের ক্লাস তিনি নেন এবং বিকালের ক্লাস নেন অপর শিক্ষক পারভীন আক্তার। কর্মসূচি সংগঠক তাহমিনা খাতুন মাঝেমধ্যেই তাদের স্কুলে আসেন এবং মনিটরিং করেন। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গত বুধবার অভিভাবকদের না আসা এবং আগত শিক্ষার্থীরা পড়া না পারায় তিনি চরমভাবে ক্ষিপ্ত হন। যে কারণে তিনি টয়লেটের পাত্রে পুকুর থেকে নোংরা পানি আনান এবং কিছু ছাত্রছাত্রীর পা ধোয়ান। সেই পানি অভিভাবক না আসায় শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক পান করান। এ ঘটনা না ঘটানোর জন্য তিনি তাহমিনাকে নিষেধও করেন। তবে তার কথায় তিনি কর্ণপাত করেননি।
মুঠোফোনে কথা হয়, ব্র্যাকের শিশু নিকেতন স্কুলের কর্মসূচি সংগঠক তাহমিনা খাতুনের সাথে। তিনি পড়া না পাড়ায় কয়েকজন শিশুকে মারপিট করার কথা স্বীকার করে বলেন, পা-ধোয়া পানি পান করার কথা তিনি বলেছিলেন, তবে অন্য শিশুরা যে পুকুর থেকে পানি এনে বাচ্চাদের খাওয়াবে তা তিনি বুঝতে পারেননি।
জেলা ব্র্যাক প্রতিনিধি নিফাজ উদ্দিন বলেন, বিষয়টি তারা গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পাশাপাশি ঘটনার তদন্ত শুরু করেছেন। সেইসাথে কর্মসূচি সংগঠক তাহমিনাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছেন।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দা নুর মহল আশরাফি জানান, ঘটনাস্থলে জেলা সদরের বানিবহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বাচ্চুকে পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন। যে কারণে ব্র্যাকের শিশু নিকেতন স্কুলের কর্মসূচি সংগঠক তাহমিনা খাতুন এবং শিক্ষক পারুল আক্তারকে কার্যালয়ে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তাহমিনা ঘটনা স্বীকার করেছে। ফলে বর্তমান যুগ এমন বর্বর শাস্তির ঘটনা ‘কেন ঘটেছে তা জানতে চেয়ে’ জেলা ব্র্যাক প্রতিনিধি নেফাজ উদ্দিনকে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শনোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শাস্তির আরেক নাম ‘পা-ধোয়া পানি’
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ